যে যায় চায়নায়
পাওয়ার ব্যাঙ্ক হাতে পেয়ে অভ্র তার হাতানো যন্ত্রের জীবনীরস যোগান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই, কেন যেন মনে হল দেখি একটু নিজের মুঠোফোনের রসদ আছে কি না ঠিকঠাক। যদিও বিদেশে এলে পারতপক্ষে ফোন যেহেতু করি না বা ধরিও না ফোন বিশেষত দেশ থেকে কোন কল এলে। কারণ ফোন কোম্পানির রোমিং বিলের খাড়ার নীচে পড়ার ভয়। এছাড়া বহুদিনের অভ্যাসবশত ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে যে কোন বিদেশগামি প্লেনে উঠেই ফোন নিয়ে যে কাজ করি প্রথম; তা হল ফোনের ডাটা রোমিং অফ করা। এসব নানাবিধ অর্থনৈতিক কারণে বিদেশে আমার ফোনের চার্জ যাওয়ার কথা না সহজে। তারপরও ভাবলাম সেটির রসদ ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে রাখা ভাল। কারণ ছবি তো তুলেছি ফোন দিয়ে, আর তাতেও তো যথেষ্ট জীবনীরস ব্যয় হয় ফোনের। এমিরেটস উড়াল দোকান থেকে কেনা ঐ অনির্ভরযোগ্য পাওয়ার ব্যাঙ্ক যদি অভ্রর হাতানোযন্ত্রের জীবনীরস যোগান দিতে গিয়ে এক্কেবারে ফতুর হয়ে যায়, আর এদিকে আমার ফোনের না থাকে কোন চার্জ, তবে তো পরবো মহা হাঙ্গামায়।
দ্রুত তাই পকেট থেকে মুঠোফোনটি বের করে, ওর নাভিতে চাপ দিতেই ঐটি সজাগ হতেই, চোখ প্রথমেই গেল বড় বড় অক্ষরে জ্বল জ্বল করতে থাকা সময় নির্দেশক লেখাটির দিকে; তাতেই সচকিত হয়ে উঠলাম হঠাৎ। ফোনের ঘড়িতে পৌনে চারটা বাজতে দেখেই,মনে হল এরই মধ্যে তো আমাদের বাস চলে আসা উচিৎ, যেহেতু ঐটী ছাড়বে সাড়ে চারটায়! সবার উদ্দেশ্যে সাথে সাথেই তাই ঘোষণা দিলাম, বস তোমরা এখানে, দেখে আসি বাস এসেছে কি না আমাদের গেইটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে, ফের নজর বোলালাম ফোনের পর্দায়, কারণ যে কারণে ফোন বের করেছিলাম সেটি দেখার আগেই সময়ের দিকে নজর যাওয়াতে ঐটির ভাড়ারে জীবনীরস কতটা আছে তা তো আর দেখা হয়নি তখন।
নাহ, যথেষ্ট চার্জই আছে ব্যাটারিতে দেখলাম! কমপক্ষে ৮০ ভাগ চার্জই এখনো আছে! কি ব্যাপার ব্যাটারি একদম খরচ হল না কেন? ভেবে ফের ফোনের পর্দায় নজর দিতেই, পর্দার ডান দিকের উপরের কোনায় চোখে পড়ল স্থির বসে থাকা ছোট্ট প্লেনটি! মনে পড়ল সকালে কানমিং থেকে বিমান ছাড়ার আগে আগেই ফোনটিকে একদম বন্ধ না করে যে এরোপ্লেন মুডে দিয়ে রেখেছিলাম বিমান কন্যাদের ঘোষণা মেনে, ঐটি সে অবস্থাতেই আছে এখনো। বিমান থেকে নেমে যেহেতু কাউকে ফোন করার দরকার পড়েনি, বা যেহেতু এই বিমান বন্দরের সাবেকি মলিন চেহারা দেখে এপর্যন্ত একবারের জন্যেও মনে পড়েনি যে এখানে ফ্রি ওয়াই ফাই আছে কিনা তা চেক করার কথা। এছাড়া ওয়াই ফাই থাকলেই কি আর না থাকলেই বা কি চায়নায়? যাওয়া তো যায় না তাতে ভর করে কোন সোশ্যাল মিডিয়ায়। অতএব এরোপ্লেন মুড থেকে এটিকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় আনা হয় নি। ফলাফল ব্যাটারি একদমই খরচ হয়নি এর। যার মানে তো হলো এই চায়না ভ্রমণে আমার মুঠোফোনের প্রধান কাজ হয়ে গেছে ছবি তোলা!
এরকম বোধোদয় হতেই মনে হল, যে যায় লংকায় সেই হয় রাবনের মতো, ডিজিটাল যুগের সকলের হাতে হাতে থাকা অঘটনঘটনপটীয়সী সকল কাজের কাজী এই মুঠোফোনের অবস্থা কি হয় জানি না। তবে আমার মতো ছাপোষা লোকের হাতে থাকা স্মার্টফোন যে নানাবিধ কারনে চায়নায় এসে পরিণত হয়েছে শধুই ক্যামেরায়, এই যখন অবস্থা আমার ফোনের কার্যকারিতার; তখন আর এর ব্যাটারির চার্জ থাকা না থাকা নিয়ে অতো চিন্তারই কি আছে ? কোন মহাভারতই তো অশুদ্ধ হবে না এতে। অতএবপাওয়ার ব্যাঙ্ক দিয়ে করুক না চার্জ অভ্র তার আইপডের, ভাল মতো।
এরইমধ্যে আগমনী লাউঞ্জ থেকে বের হওয়ার দরজাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যেতেই ঐটি পেরিয়ে দু তিন পা এগিয়ে পুরোপুরি হিমচ্যানেলে ঝপাত করে ঝাপ না দিয়ে, বারান্দার মতো লবিটিতে দাঁড়িয়েই যতটা পারা যায় সারসের মতো গলা লম্বা করে বা দিকে নজর দিয়েই; দ্রুত ঘুরে এগুলাম ফের সেই স্বয়ংক্রিয় দরজার দিকেই, মাত্রই যেটি দাঁতকপাটি লাগিয়ে বন্ধ করেছে তার মুখ। কারণ চোখে পড়লো যে বাসস্ট্যান্ডের নির্ধারিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাস! আমার ফিরতি উপস্থিতি টের পেয়ে ততক্ষণে স্বয়ংক্রিয় দরজার কপাট দুটো পড়িমরি করে দু দিকে সরে যেতেই, ভেতরের উষ্ণতায় ঝাপ দিয়েই, উষ্ণতর গলায় সকলের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলাম, বাস চলে এসেছে, উঠো সবে।
আমার এ ঘোষণাটি বিশেষ কোন জরুরী এলানের মতো বেজে উঠলো কি না, সকলের কানে? জানি না। তবে বাইরের হিমচ্যানেলে এ পর্যন্ত এক বারের জন্যও উঁকি দিতে সাহস না করে লাউঞ্জের ওম ওম আরামের উষ্ণতায় চেয়ারে একদম জমে বসে থাকা হেলেন আর লাজুর চকিতে উঠে দাঁড়ানো দেখে তাই মনে হল!
এখানে সবাই আসন গেঁড়ে বসার শুরুতেই, অপরিণামদর্শী পিতাপুত্ররা তিনজনে মিলে আমরা হিমচ্যানেলে ঝাপিয়ে পড়ার মতো অবিমৃষ্যকারিতাটি করার পর ফিরে এসে, সাত তাড়াতাড়ি আমি ব্যাগ সুটকেশ খুলে সবার জন্য অতিরিক্ত যে গরম জামা কাপড় বের করেছিলাম, শীতকাতুরে হেলেন তা আগে ভাগে গায়ে চড়ালেও, এখন ফের সব কিছু ঠিক ঠাক করে গায়ে জড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর যেহেতু স্ত্রীআজ্ঞার মতো স্বামীআজ্ঞা তো অলঙ্ঘনীয় অবশ্য পালনীয় কোন বিষয়ই নয় ভুলেও, তাই লাজুকে বের করে দেয়া অতিরিক্ত কাপড়গুলো, এতোক্ষণ ওর গায়ে চড়ার জন্য চেয়ারে পড়ে থেকে হা পিত্যেশই করছিল। এ মুহূর্তে লাজু সেগুলোর সদ্ব্যবহারে যখন লেগে গেল, আমি তখন সোজা আমাদের ব্যাগ সুটকেস বোঝাই ট্রলি দুটোর কাছে এসে দ্রুত তাতে চোখবুলিয়ে একটা ব্যাগশুমারি করে নিলাম। কোন দেশের আদমশুমারি করার সময় যেমন যে কোন জায়গার স্থায়ী বাসিন্দাদের গোনায় আনার সাথে সাথে, অত্র এলাকায় ঐ সময়ে অবস্থানকারী অস্থায়ি আর ভাসমান লোকজনদেরও গুনতি তে ধরার নিয়ম আছে, সেই একই সুত্র মোতাবেক ট্রলিস্থ ব্যাগ সুটকেস গোনার সময়, একই সাথে আমাদের এই অস্থায়ি আস্তানার চেয়ারে আর মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকলের পিঠব্যাগ, হাতব্যাগগুলোরও শুমারি সেরে নিয়ে সন্তুষ্ঠ হয়েই মন দিলাম ফের আমাদের জমজ ট্রলিগুলোর দিকে। ওগুলোকে সামান্য ঠেলে ঠুলে দেখে,অতঃপর ফের ব্যাগসুটকেসগুলোকে সামান্য নাড়াচাড়া করে ঠিকঠাক মতো একজনের ঘাড়ে আরেকজনকে যুত মত বসিয়ে দিলাম যাতে যে কোন মুহূর্তে ট্রলি গুলোকে চলতে বাধ্য করলে, কোন ব্যাগ বা সুটকেস গড়িয়ে পড়ে উটকো বিড়ম্বনার সৃষ্টি যাতে না করে।
“এই তোমরা এখনো উঠছ না কেন? শোন নি আমাদের বাস চলে এসেছে।“চেয়ারে বসে একমনে নিজ নিজ জটিল কাজে ব্যস্ত দীপ্র অভ্রকে লাজু তাড়া দিতেই, আমিও বললাম বাবারা উঠে নিজ নিজ ব্যাগ গুছিয়ে তুলে নাও পিঠে। আর অভ্র তুমি আপাতত পাওয়ার ব্যাঙ্ক আমাকে দাও, বাস উঠে নিও ফের।
মিনিট পাঁচ সাতেকের মধ্যে ঝটপট সবার প্রস্তুতি হয়ে যেতেই, সবাইকে আমার আগে হাঁটার কথা বলতেই সকলে মিলে লাউঞ্জ থেকে বেরুবার স্বয়ংক্রিয় দরজামুখি, একটা চলন্ত সরলরেখায় পরিণত হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। চলমান এই সরলরেখার মাঝামাঝি ট্রলি ঠেলে হাঁটতে থাকা শীতকাতুরে হেলেনের শরীরী ভাষা আর পা ফেলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাইরে বেরুবার আগেই বুঝি ওকে বেইজিং হিম তাকে জমিয়ে ফেলতে চাইছে, আগমনী লাউঞ্জের এই উষ্ণতার ভেতরেও!
অতএব ট্রলি ঠেলে ঠেলে সবার পিছু পিছু এগুতে থাকা আমি গলা উঁচু করে চলমান সরলরেখার অগ্রভাগে থাকা দীপ্রকে উদ্দেশ্য করে বললাম, বাবা বাইরে বেরিয়ে বা দিকে কিন্তু আমাদের বাস। বা দিকের শেষ মাথায় একদম এই লাউঞ্জের সবচেয়ে কাছে যে বাসটি দাঁড়িয়ে আছে, তার পরেরটাই আমাদের বাস। ওখানে দেখবে নম্বরও লেখা আছে ১৫ । ওতেই উঠতে হবে আমাদের। ওখানে গিয়ে তোমারা সবাই তাড়াতাড়ি বাসে ঢুকে যেও । আমি ট্রলি থেকে ব্যাগ সুটকেস নামিয়ে বাসের লাগেজ কেবিনে ঢুকিয়ে তারপর উঠবো বাসে।
“জানি তো বাবা, দেখে এলাম না তখন আমাদের বাস দাঁড়ানোর জায়গাটা “পেছন ফিরে কিশোরসুলভ বিরক্তি আর অস্বস্তি ঝরিয়ে হঠাত করে দৃপ্ত পায়ে সামনে হাঁটায় মনোযোগ দিল দীপ্র।
দরজা পেরিয়ে দীপ্রর পর অভ্রও নিজেদের অজান্তেই শরীর কুঁচকে নিঃশব্দে দ্রুত হিমচ্যানেলের হিমে ঝাঁপ দিলেও, গুটি গুটি পায়ে এগুতে থাকা অতি সতর্ক হেলেনের গায়ে বেইজিং হিমের প্রথম ঝাপটা লাগতেই ও আর্তনাদ করে উঠতেই, সাবধান করে বললাম থামিস না, জোরে হাঁট সামনে। একটু পরই দেখবি সয়ে যাবে গায়ে ঠাণ্ডা। মুখের কথা পুরো শেষ হবার আগেই -“ওরে বাবা কি ঠাণ্ডারে” বলে লাজু কঁকিয়ে উঠতেই দেখলাম একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছে ও। ভাবলাম এই ঠাণ্ডায় মচকে যাওয়ায় পায়ের ব্যথাটি কি তবে বাড়ল নাকি আবার ওর? কি আছে কপালে তাহলে, মনে মনে আবছাভাবে কষে রাখা আগামী কয়েকদিনের বেইজিং এর তুমুল ঘোরাফেরা করার পরিকল্পনার, আমার?
সে যাক শীতের তোড়ে কুঁকড়ে মুকরে গেলেও, অতি দ্রুতই সবাই গিয়ে বাসের সামনে জড়ো হতেই, আশেপাশের জনশূন্যতার সাথে, উইন্ডস্ক্রিন পেরিয়ে বাসের ভেতরের খা খা শূন্যতা দেখে, প্রবল বিরক্তিতে তীব্র এই শীতে লাজু ছুড়ে দিল তার অব্যর্থ শব্দঅনল-“ সব কিছুতেই সবসময় তোমার বাড়াবাড়ি, এখানে তো কোন লোকজনই নাই। কি দরকার ছিল এখনি এখানে আসার? ভেতরে গিয়ে এমনভাবে তাড়া দিলে যে, মনে হচ্ছিল ড্রাইভার বুঝি বাস ছেড়ে দিচ্ছে এখনি। এখন দেখছি বাসের কোন ড্রাইভার বা কন্ডাকটর কেউই নাই ধারে কাছে ” মহামতি সক্রেটিসের নিজেকে জানার মন্ত্রে বলীয়ান আমি অনেকদিন ধরেই এভাবে প্রতিনিয়তই নিজের সম্পর্কে গভীর বোধি লাভ করে নিজেকে জানতে পেরে নীরবতা পালন করলেও, মাঝে মধ্যেই ভুল করে, মুখ খুলে মেরে বসি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল। কারণ মানুষ মাত্রেই তো ভুল হয়। তবে এখন সেরকম ভুল করার কোনই ফুরসৎ নাই। তাই মনে মনে ভাবলাম হায় স্ত্রীমুখনিঃসৃত এরকম শব্দঅনল যদি মেজাজ গরম না করে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় গা গরম করতো তা হলে কতোই না ভাল হতো!
নিজের এই ভাবনায় নিজেরই হাসি পেল, ডুবন্ত লোকের খড়কুটো ধরার চেষ্টার মতো হিমসমুদ্রে সবাইকে নিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে আমার এই অদৃশ্য অনল ধরার চেষ্টায়। আর ঠিক তখনি হাতে পেলাম এ মুহূর্তের প্রথম অনল টুকরোটি ! আর তা হল যে, শুনতে পেলাম গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। সাথে দেখতে পেলাম অতি ধীরে হলেও কাঁপছে বাসটি! যার মানে হলো বাসটি চালু আছে। আর বাস চালু থাকলে ড্রাইভার বা কন্ডাকটর আশে পাশে না থাকার কোন যৌক্তিক কারণই নেই। ফের মনে হল এই ঠাণ্ডায় একটু পর যে বাস চলতে শুরু করবে, সেটির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখলে তো যাত্রীরা বাসে ওঠার পর আবিষ্কার করবে যে, হিমচ্যানেল থেকে বেরিয়ে তারা ঢুকে পড়েছে এক্কেবারে প্রাগৈতিহাসিক পিকিং মানবের ঠাণ্ডা গুহায়। অতএব এখানে তো বাস বন্ধ রাখার উপায়ই নাই। তাহলে কি বাসের ইঞ্জিন আর হিটার চালু রেখে, ড্রাইভার কন্ডাক্টর আশে পাশে কোথাও গুলতাপ্পি মারার জন্য গেছে নাকি ইয়ার বঙিদের সাথে?
মনে মনে কষা আমার এই সব যুক্তির কাটাকুটি খেলায়, আমার বিজয় ঘোষণা করে এ সময় উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে হঠাৎ করেই ড্রাইভিং সিটে ভূতের মতো উদয় হলেন এক চায়নাম্যান!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক