ঘণ্টাখানেক আগে দাম্মামে নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ফিলের নেতৃত্বে এক ট্যাক্সিওয়ালার শরণ নিলে, একটানা ৪৫/৫০ মিনিট সে কোন একটা হাইওয়ে ধরে ট্যাক্সি দাবড়িয়ে এইমাত্র এই রিসোর্টের নির্ধারিত স্থানে এনে আমাদের নামাতেই, সাইনবোর্ড জানালো যদিও জানতাম হবে মিটিং দাম্মামে, আদতে পৌঁছেছি অবশেষে আল খোবারে?
আই সি ইটস আল খোবার, নট দাম্মাম। আনমনে অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারিত আমার কথা কটি ফিলের কর্ণগোচর হতেই বলল সে, পার্সিয়ান উপসাগরের বিখ্যাত হাফ মুন বে এর বীচের কোল ঘেষে গড়ে উঠা আল খোবারেই গড়ে উঠেছে সৌদির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের সবচেয়ে ভাল রিসোর্টগুলো। আর গিউসির ও খলিলের, মানে আমাদের মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান ও সেলসের প্রধান, দুজনেরই অতি পছন্দের হলো এই রিসোর্টটি।
এসব বাতচিতের ফাঁকে পায়ে পায়ে রিসেপশনে এসে সোফায় দুজনে গা এলিয়ে দিতেই ধোপদুরস্ত উর্দি পরা ওয়েটার ছোট ছোট দু কাপ এরাবিয়ান কফি ও প্লেটভর্তি ডাঁশা ডাঁশা উমদা খেজুর রেখে গেলে, ফিল কফির কাপ টেনে নিলেও, প্লেট থেকে তুলে নিলাম আমি, খেজুর।রাতের এ সময়ে কফি খেলে, গোটা রাততো কাটাতে হবে অধমের, বিছনায় শুয়ে শুয়ে ভেড়া গুনে!
এরই মধ্যে রিসোর্টের ফ্রন্টডেস্ক ম্যানেজার আমাদের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দ্রুত দু’জনের চেক ইন সম্পন্ন করে হাতে চাবি তুলে দিতে দিতে, কথার সাথে হাতের ইশারায় দেখালো যা, বুজলাম তাতে এখানে ঠিকানা হয়েছে আমাদের দুজনের, দুই বিপরীত ভুবনে।
এদিকে চাবি হাতে পেতেই ‘সি ইউ সুন এট ডিনার টেবিল’ বলে ফিল রিসেপশনের সামনে অপেক্ষমাণ গলফকার্টগুলোর একটির দিকে এগিয়ে যেতেই, নিজেও শরণাপন্ন হলাম আরকেটির। তাতে সেটির উর্দিপড়া উপমাহদেশিয় চেহারার কার্টড্রাইভার অধমের ভূতো চেহারা দর্শনে প্রথমে একটু ভির্মি খেলেও, পেশাগত দক্ষতায় দ্রুত তা সামলে, তমিজের সাথে আমার কাছ থেকে একটু আগে হাতে পাওয়া চাবিটি নিয়ে, ট্রাভেল ব্যাগটি গাড়িতে তুলতেই, বেশ একটা ভারিক্কী ভাব নিয়ে মাঝের সিটে উঠে বসতেই, আলো আঁধারিতে ঘেরা, গাছ গাছালিতে ছাওয়া এক চিলতে কংক্রিট পথ ধরে গলফ কার্ট এগুতে শুরু করলে, ফের মনে হলো ‘টাকায় কি না হয়’ কথাটি কে কি দেখে বিশ্বাস করেছে জানি না; তবে টাকায় যে মরুতেও সবুজ বনানী সৃষ্টি করা যায়, দেখেছি তা আমি অনেকবার, দেখছি এখনো। কৃত্রিম এই মরু–বনানির ভেতর দিয়ে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে কংক্রিট পথের উপর দিয়ে গলফকার্টট এগুতে থাকার অবসরে নানান সময়ে সৌদির এই অঞ্চল সম্পর্কে যা যা জেনেছিলাম সেসব হাতড়ানো শুরু করতেই মনে পড়ল– সৌদির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের, দাম্মাম ও আল খোবার এই দুটো শহররেই গোড়াপত্তন হয়েছিল বাদশাহ আবদুল আজিজের বদান্যতায়, বাহরাইন থেকে আসা মৎসজীবী মরু উপজাতি আল দাওয়াসির গোত্রের হাতে, ১৯২৩ সালে।
সে যাক, মজার ঘটনা হচ্ছে যতোই ১৯৮০ সালে সৌদি সরকার ক্যালিফোর্নিয়া এরাবিয়ান স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানির মালিকানা ১০০ ভাগ অধিগ্রহণ করে, সৌদি আরামকোর জন্ম দিয়ে থাকুক না কেন, এই এলাকাটি চলছে আজো আমেরিকান ধাঁচে ও মেজাজেই। রিয়াদের মতো এখানে শরিয়াহ পুলিশ, মানে মোতাওয়াদের দৌরাত্মের ছিটেফোঁটাও নাই। ফলে এই রিসোর্টটির মতো আরো বেশ কিছু রিসোর্ট তৈরি হয়েছে পার্শিয়ান উপসাগরের বিখ্যাত অর্ধ চন্দ্রাকৃতির হাফ মুন বে এর এই বীচ এলাকা ঘিরে। আরামকোর প্রভাব এখানে কতোটা যে প্রবল, তার প্রমান হিসেবে আছে এখানে তাদের নিজস্ব সংরক্ষিত প্রাইভেট বীচও! গলফ কার্টে আমার কটেজের দিকে আসতে আসতে, এদদিকে দাম্মাম বিষয়ক এসকল তথ্যের জাবর কাটা চললেও অন্য দিকে আনমনে চারদিকে তাকিয়ে তুমুল মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম, পেশাগত কারণে, দাপ্তরিক আয়োজনে নানান সময়ে নানান ধরনের উচ্চমার্গিয় হোটেল আর রিসোর্টে থাকলেও, আল খোবারের রিসোর্টটকে প্রথম দেখাতেই মনে হচ্ছে অনন্য। বোধ করি মরুর বুকের হাফ মুন বীচ পাড়ের এই রিসোর্টির প্রাকৃতিক ভাব বিনষ্ট না করার অভিপ্রায়ে এই রাতে এখানে খুব বেশী আলো জ্বালানো হয়নি; তাই আলো আধারিতে এর পুরোটা ঠিক মতো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী? যতোটুকুই দেখছি, তাতেই মনে হচ্ছে এ পর্যন্ত যতো রিসোর্টেই থেকেছি তার মধ্যে এর সাথে পাঞ্জা লড়তে পারে একটাই রিসোর্ট থেকেছিলাম যেটিতে সেই ২০০১ সালে সার্দিনিয়া দ্বীপে।
এরই মধ্যে কার্টম্যান নির্দিষ্ট কটেজের সামনে থেমে দ্রুত কার্ট থেকে নেমে সস্মভ্রমে কটেজের দরজা খুলে ধরতেই ভেতরে পা রেখেই বেশ বড় সড় বসার ঘরটি অবলীলায় পেরিয়ে, সোজা শোবার ঘরে ঢুকে কি মনে করে জানি না বিছানা পেরিয়ে এপাশে এসে, রুমটির এমাথা ওমাথা জুড়ে ঝুলতে থাকা ভারী পর্দা সরিয়ে দিতেই একটানা কাঁচের দেয়ালের ওপাশে চোখে পড়লো চকচক করতে থাকা বীচের বালি ও বালির ওপাশে থাকা দিগন্ত বিস্তৃত টলটল করতে থাকা জল! জল ও বালি এ সবই ঝিকমিক, চকচক করছে কিসের আলোয় তবে? ভাবতে ভাবতে উপরের দিকে তাকাতেই দেখি ঝুলছে আকাশে রুপার আধুলির মতো চকচকে পূর্ণ চাঁদ। আজ কি তবে পূর্ণিমা নাকি? ঠিক এসময় বিছানার পাশের ছোট টেবিলে চুপচাপ শুয়ে থাকা জবরজং ফোনটি তীব্রস্বরে আর্তনাদ করে উঠতেই, দ্রুত ধরতেই শোনা গেল গিউসির গলা “এই সেলিম করছো কী? ডিনার করতে চলে আসো। ফিল, খলিল আর আমি অপেক্ষা করছি। অচিরেই রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু । দেরী করো না।” উত্তরে ওকে ওকে, বলার সাথে রিসোর্টের ঠিক কোন রেস্টুরেন্টে তারা আছে তা জেনে, কটেজ থেকে বেরুতে বেরুতে ভাবলাম, ঠিক আছে; ডিনার সেরেই না হয় করবো গোসল। আচ্ছা এই রাতেই পার্সিয়ান গালফের পানিতে গোসল করলে কেমন হয়? এরই মধ্যে যতোটা দেখেছি, তাতে হাফ মুন বীচের ওপাড়ে আদিগন্ত লম্বমান হয়ে শুয়ে থাকা পারস্য উপসাগরকে বেশ শান্তশিষ্টইতো মনে হচ্ছে। দেখা যাক খলিল বা গিউসি রাজী হয় কি না। রেস্টুরেন্টে এসে এর ভাবভঙ্গিতে মনে হল অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবার জন্য মুখিয়ে আছে এটি। আমরা বাদে মানে, আমি এসে এখানে পা রাখার আগে ফিল, গিউসি আর খলিল বাদে অন্য কোন গেস্ট নেই। আমার দেখা মিলতেই তিনজনেই সমস্বরে দ্রুত ডিনারে যোগ দেবার তাগাদা দিতেই চালালাম পা দ্রুত, তাদের দিকে।
অতপর এক্কেবারে হাপুশ হুপুস করে না হলেও বেশ দ্রুত সবাই সৌদি শ্যাম্পেইন সহযোগে চমৎকার সব লেবানিজ ডিশের ডিনার শেষ হতেই, ফিল কাজ আছে বলে গাত্রোত্থান করলে, খলিলের প্রস্তাব মেনে তার পিছু পিছু হাজির হলাম দুজনে গিয়ে রেস্টুরেন্টটির উপর তলার কাঠের তৈরি খোলা ডেকে, মুখ করে আছে যেটি চন্দ্রালোকিত হাফ মুন বীচের ওপাশে ছোট ছোট ঢেউ তুলে টল টল করতে থাকা পারস্য উপসাগরের দিকে। “ভাইয়েরা, চমৎকার এই রাতে করা যায় কী বলোতো?” সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে করলো জিজ্ঞাসা খলিল– আমি ভাবছিলাম, এই চন্দ্রালোকিত রাতে সাঁতার কাটি ঐ সমুদ্রে তিন জনে মিলে। খলিলের জিজ্ঞাসার উত্তরে দেয়া আমার এই প্রস্তাব, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নাকচ করে দিল একবাক্যে, দুজনেই। সাথে যোগ করলো যে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষেরও ঘোরতর নিষেধাজ্ঞা আছে এ ব্যাপারে।
“তার চে বরং চল শিশা টানা যাক।” এ কথা বলেই খলিল আমাদের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই, ডেকটির ডান দিকের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা ধোপদুরস্ত ওয়েটারটিকে ডেকে তিন জনের জন্য শিশার অর্ডার করলো। ভাবলাম, ব্যাপার তো মন্দ নয়! সৌদি আসার আগেই এখানকার শিশা মানে হুক্কা কালচারের কথা জানলেও এবং তা পরখ করার তীব্র বাসনা থাকলেও, এ পর্যন্ত তা আর করা হয়ে ওঠেনি। কারণ, তুমুল মোতাওয়া নিয়ন্ত্রিত রিয়াদে কোন শিশা বার নাই। শিশা টানতে হলে যেতে হবে রিয়াদ শহরের বাইরে, মরুর গভীরে, যেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি এখনো। এই সুযোগে হাফ মুন বীচের এই ঐন্দ্রজালিক পরিবেশে সে অভিজ্ঞতা হয়েই যাচ্ছে অবশেষে।
বেশ করিতকর্মা ওয়েটার দ্রুতই তিন জনের হাতে অর্ডার মোতাবেক আপেল, কমলা ও আঙ্গুর সুবাশের তিনটি রাজকীয় হুক্কা তুলে দিতেই, টানতে শুরু করলাম তা তিনজনে, অঘোষিত এক নিরবতা পালন করে। ফলে এই শুনশান নিরবতার মধ্যে কানে বাজছে শুধুই হুক্কার গড়র গড়। সামনে চাঁদের আলোর নীচে মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ তোলা পার্সিয়ান সাগরের টলমল জল, থেকে থেকে চিক চিক করছে।
কাটলো কতোক্ষণ এভাবে, জানি না। এরই মধ্যে মনে হল শিশার ধোঁয়া তো নয় বরং পুরো পরিবেশের মাদকতায় নেশাগ্রস্ত খলিল এক মনে জাবর কাটতে শুরু করেছে জেদ্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছাত্র থাকাকালীন বন্ধুদের সাথে ওখানকার বীচে কাটানো দুরন্ত সময়ের কথা। এসব বলতে বলতেই খলিলের স্মৃতির মোড় ঘুরে গেল দেখি জেদ্দা জীবনে সে যে এক কিশোরী না তরুণীর প্রেমে পড়েছিল, সেই দিকে। অকপট বলছে সে, প্রেমিকার ঘরে বহু রাত কাটানোর কথা। জানালো সে আরো, তা করতে গিয়ে কিভাবে এক সন্ধ্যায় ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিল প্রেমিকার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের গুণে। যদিও সেই সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত কাটাতে হয়েছিল তাকে প্রেমিকার ঘরের খাটের তলায়!
কিছু মনে করো না খলিল, জানি না আমি জিজ্ঞেস করছি তাই। এও কি সম্ভব নাকি সৌদিতে? তুমুল অবাক আমি আচমকা খলিলকে এ প্রশ্ন করতেই “সবই সম্ভব ভ্রাতা। তা লাগবে নাকি তোমার কোন গার্লফ্রেন্ড? এই যে নাও দিচ্ছি নম্বর। সময় করে কথা বলো। ভাল ইংরেজি বলে। নাহ, এখানে না, এও জেদ্দাতেই থাকে। দেখি দৌড় তোমার কতদূর।” হাসতে হাসতে বলতে বলতে খলিল ফোনে সেই নম্বর খুঁজতে শুরু করতেই বলি– নারে ভাই, ঘাড়ে মাথা আমার একটাই। আর সেই মাথার মালিক আমার একমাত্র বউই, আমার গার্লফ্রেন্ড। তোমার দেশে এসে বেহুদা সেই মাথাটি হারাতে চাই না।
“নাহ, বুঝেছি তোমাকে দিয়ে হবে না। ভিতুর ডিম একটা। আচ্ছা চল না যাই তিনজনে বাহরাইন এখন। শিশা খেয়ে পোষাচ্ছে না। আমি তো গাড়ী নিয়েই এসেছি , একটানে চলে যাওয়া যাবে ব্রিজ পেরিয়ে।”
শুনে, ঠাহর করার চেষ্টা করছি খলিলকে বাহরাইনের বারের রঙিন সুরা হাতছানি দিচ্ছে, নাকি ডাকছে তাকে সাকীরা? ঘটনা যাই হোক, ও নিশ্চয় জানে না যে আছি আমি সিঙ্গেলএন্ট্রি হাজতি ভিসায়। অতএব অন্তত এ ব্যাপারে আমাকে যাতে সে অহেতুক আর ভিতু না ভাবে, সেজন্য ব্যাপারটা খোলাসা করা দরকার। ভাবছি যখন এই, বলে উঠল গিউসি তখন
“শোন ভ্রাতা বোঝই তো আমাদের মতো বিদেশীদের এরকম ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। বলা তো যায় না, কোন না কোন কেলেংকারি হয়ে যায়।” “ঠিক আছে আমি তা হলে একাই যাবো” গিউসির উত্তরে হাসতে হাসতে কিছুটা একগুঁয়ে স্বরে ঘোষণা করে দাঁড়ালো সটান খলিল।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।