(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিন্তু এইরকম তব্দা লেগে থাকলে তো চলবে না। ঢাকা থেকে আসার আগে যেহেতু পাকাপোক্তভাবে গাড়ী চালানো শেখার সাথে ইন্টারন্যাশানাল ড্রাইভিং লাইসেন্সও করিয়ে এনেছ, অসুবিধা কী? মনের দ্বিতীয়জন এ সময় এ কথা বলতেই তব্দা খাওয়া প্রথমজন বলল সমস্যা একটু আছে অবশ্যই প্রথমত, আমেরিকার তুলনায় প্রায় ৭০/৮০ বছর আগে থেকেই সৌদিদের সাথে ব্রিটিশদের সম্পর্ক থাকলেও, কেন জানি আধুনিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ কেতার বদলে তাদের পছন্দ আম্রিকান কেতাই। তাই এখানকার গাড়ীগুলো সব হলো লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। রাস্তার নিয়মকানুনও ব্রিটিশদের উল্টা। কপাল ভাল যে গত প্রায় ১০ /১২ দিন, গ্রানাডা কমপাউন্ডের ডেরায় আমাকে ড্রপ করার পর, সাইফ সেখানকার পাকিং লটে গাড়ী পার্ক করে, চাবি আমাই কাছে রেখে আসতো বলে, রাতের বেলা কমপাউন্ডের ভেতরে গাড়ীটা চালিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে গিয়ে, উল্টা দিকের ড্রাইভিং সিটে বসে রাস্তার উল্টা দিক দিয়ে গাড়ী চালাতে গিয়ে টের পেয়েছিলাম এই দুই উল্টার অস্বস্তিটা। সে জায়গায় আজ সন্ধ্যায় তো সেলফ ড্রাইভ করেই ফিরতে হবে রিয়াদ শহরের মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি চালাতে হবে বেশ কিছুক্ষণ হাইওয়েতেও !
এ মনে হতেই মনের ভেতর মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো কী না দ্বিতীয় সমস্যা ! তা হ , যাবো কোন পথে তবে ? এতোদিন সাইফ গাড়ী চালাতো বলে এ নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাইনি। পাকা ড্রাইভার সাইফ বিশাল রিয়াদ এই শহরের রাস্তাঘাট চেনে নিজের হাতের তালুর মতোই , তাই সেও তো একেকদিন মনে হয় আনা নেওয়া করেছে একেক পথে , রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের কথা মাথায় রেখে। এখনতো মনে হচ্ছে প্রথম সমস্যাটির চেয়ে এটিই হল বড় সমস্যা । নাহ যাই , আমিনের কাছে । বলতে হবে তাকে যে দুজনেই আজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরুবো একই সাথে। আর সে যেন তার ড্রাইভারকে একটু রয়ে সয়ে গাড়ী চালাতে বলে যাতে তার পিছু পিছু গাড়ী চালিয়ে পৌছাতে পারি আমিও গ্রানাডা কমপাউন্ডে!
‘সালামালাইকুম, ডঃ সেলিম । আই এম নাদিয়া। ডঃ খলিল টোল্ড টু টেক ইউ টু দী হসপিটাল আই ওয়ার্ক ।“
আমিনের রুমে যাওয়ার জন্য নিজ রুমের দরজার মুখে এসে পৌছাতেই দেখা হল আপাদমস্তক কালো আবায়া আবৃত হলেও নেকাবহীন সুন্দর মুখশ্রীটির সাথে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবারই নীচতলায় এরকম আবায়াকে ইতি উতি ঘুরে বেড়াতে হলেও জানি না সঠিক, সংখ্যায় এনারা মোট কয়জন। যে এক বা দুজনের সাথে মুখোমুখি হয়েছি, তাতে তাদের চোখ ভিন্ন অন্য কিছু চোখে পড়েনি। অতএব জানিই না দেখেছি কাকে বা কয়জনকে? এখন যিনি এসে দাঁড়িয়েছেন আমারই দরজায়, ওনার সাথে আগে দেখা হয়েছে কি না তাও জানি না। সবসময়ই কি উনি এরকম নেকাবহীন থাকেন নাকি? বড়ই সাহসী মনে হচ্ছে তো ইনাকে!
দ্রুত পিছু হটে তাই সসম্মানে জনাবাকে রুমে ঢুকে চেয়ারাসিন হতে বলে ,ওপাশের নিজ চেয়ারের দিকে এগুতে এগুতে ভাবছি সেদিন খলিল আমার ফিল্ড ওয়ার্ক করতে যাবার বাসনা শুনে হাসতে হাসতে যে বলেছিল : “ঠিক আছে তোমার জন্য অচিরেই পাঠাবো এক সুন্দরীকে“ ব্যাপারটাকে তখন নিছক রসিকতা মনে করলেও, এখন যিনি বসেছেন সামনে, তার শুধু মুখশ্রীতে তাকে তো আবায়াআবৃত ডানাকাঁটা পরীই মনে হচ্ছে ! মেডিটেরিনিয়ান সুন্দরীদের কথা বইপত্রে পড়লেও এখন তো বসে আছে সেই সুন্দর, আমারই টেবিলের ওপাশে।
তা কি খাবেন মিস নাদিয়া, চা নাকি কফি?
এ জিজ্ঞাসার উত্তরে, দু কানে ঝিকিমিকি করতে থাকা কানের দুলগুলো নাড়ানোর সাথে মুখেও জানালেন, এখন কিছু খেতে চাচ্ছেন না। কাজে যাবার আছে তাড়া।
হুম তা বুঝলাম । কিন্তু আমারও তো তৈরি হতে হবে। আপনি যে এভাবে হুট করে চলে আসবেন, তা তো জানতাম না। হাতের কাজ একটু গুছিয়ে নেই । এছাড়া নিজেদের তো একটু পরিচিত হওয়া দরকার । বেশী না, মিনিট দশেক লাগবে। সমস্যা হবে কি তাতে?
ফের কানের দুল নাড়িয়ে সমস্যা হবে না জানানোর সাথে সাথে, আবায়ার খোলা জানালা পথে যে নিঃশব্দ হাসি দেখা গেল টেবিলের ওপাশে, ভাবলাম তাতে বাংলায় নামটা তার “সুস্মিতা” হওয়া উচিৎ।
অতপর জানলাম, নিবাস তার জর্ডানে। ফার্মেসি গ্র্যাজুয়েট নাদিয়ার বাড়ি ইরবিদ শহরে। দুই বছর আগে সে ও তার দন্ত চিকিৎসক স্বামী সৌদিতে এসেছে ভাগ্যান্বেষণে তো নয় ভাগ্যউন্নয়নের মানে অধিক বেতনের চাকরীর আশায়। আমাদের কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে সে মাস ছয়েক হলো।
শুনে বললাম তুমি আমার দেশ সম্পর্কে কতটুকু জানো, জানি না। অবশ্য আমিও যে খুব জানি তোমার দেশ সম্পর্কে তাও না। তবে ছোটবেলায় যেহেতু স্ট্যাম্প জমাতাম, সে কারনেই জানতাম তোমাদের দেশ ও রাজধানির নাম। পরবর্তীতে দ্বিতীয় যে শহরটি আমাকে তুমুল কৌতূহলী করেছে সেটি, হল পেট্রা। তোমাদের দেশের আর যে একজনকে একটু আধটু চিনি নামে, তিনি হলেন রানী রানিয়া।
বুঝলাম না,এ কি নারীর প্রতি নারীর ঈর্ষাজনিত ব্যাপার? নাকি স্রেফ রাজনৈতিক কারনে রানী রানিয়া তার অপছন্দের বলেই, ঐ নামে নাদিয়ার চেহারায় চকিতে একটা কালো ছায়া দেখা গেল । অবশ্য সাথে সাথেই সে দ্রুত তা সামলে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জানালো, সে নিজেও নাকি যায়নি কখনো পেট্রায়। তবে আমি যখন যাবো, তখন সে নিশ্চয় যাবে সাথে !
শোন, তোমাদের দেশে এ কথাটা প্রচলিত কী না, জানি না। আমাদের দেশে, মক্কার লোক হজ পায় না বলে একটা কথা আছে। অবস্থা তো তোমার ঐ রকমই! জর্ডানকন্যা তুমি পেট্রা দেখোনি! এখন বলো, কোন হাসপাতালে যাবো আমরা কাজ করতে । ঠিকানা দাও ওটার , আমি মহসিনকে বলি ট্যাক্সি ক্যাব ডাকতে ?
“কেন তোমার গাড়ী নিয়ে যাবে না?”
নাহ। এখনো এখানকার পথঘাট তো চিনি না তো আমি। অতএব পথ হারবার রিস্ক নিয়ে কাজের বারোটা বাজাতে চাচ্ছি না।
“তাহলে, তুমি অবশ্যই আমার গাড়িতে যাবে?”
দৃঢ় তার এই ঘোষণা শুনেই ভাবলাম, আরে বলে কি! বেগানা পুরুষ আমি তার গাড়িতে উঠে পুলিশের কাছে, মানে বিশেষত মোতাওয়ার হাতে পড়ে দোররা খাওয়ার সাথে জেলে যাবো নাকি? এছাড়া মাহরাম ছাড়া এ ই বা কিভাবে এখানে চলাফেরা করে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। এমনিতে তো জানতাম সৌদিতে নারীদের অফিস আদালতে কাজ করা একদম নিষিদ্ধ। এখানে আসার কিছুদিন পর বস ফিল জানিয়েছিল, কোম্পানির ডাইভারসিটি বিষয়ক গ্লোবাল পলিসি কার্যকর করার মানসে, সৌদির আইন মেনেই “মেডিক্যাল এডুকেটর” নামে সেলসে চাকুরী করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে সে, মেয়েদের জন্য। তবে ঐ ব্যাপারটির আগাপাশতলা জানি না এখনো।
“ডঃ সেলিম, বুঝতে পারছি কি ভাবছ তুমি। চিন্তা করো না। এই নাদিয়াকে অত্র এলাকার সব পুলিশ ও মোতাওয়ারা চেনে। ভাল করেই চেনে। অতএব আমার সাথে কোন ধানাই পানাই যে তারা করবে না, এ গ্যারান্টি দিচ্ছি। কোনই সমস্যা হবে না! তুমি সেলসের যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। আরে আমার বিগ বস কে, কোন ফালতু পুলিশ বা মোতাওয়া ফালতু ঝামেলা করলে সে ব্যাটাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো নাকি আমি?”
ফুঁসে উঠে তুমুল দৃঢ়টার সাথে বলা নাদিয়ার এসব কথা শুনতে শুনতে একদিকে মনে হল, সামনে তো দেখছি বসে আছেন ছোটবেলায় শোনা সেই প্যালেস্টাইনি লায়লা খালেদ, অন্যদিকে মনে মনে গুনছি প্রমাদ তাতে এই যে, পড়লাম অবশেষে আমি তবে এ কোন ঝামেলায়?
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।