নতুন সপ্তাহের প্রথমদিন মানে শনিবার আজ। নীচতলার রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে ফিরেছি, একটু পরেই অফিসে নিয়ে যাবার জন্য সাইফ চলে আসবে; অতএব ধরাচূড়া পরে তৈরি হয়ে নেয়া দরকার। বাইরে যতোই মরু সূর্য উদ্গিরন করুক না কেন গনগনে আগুনের হল্কা, সেই শুরু থেকেই দেখছি এখানকার অফিসে স্যুট কোট টাইয়ের তুমুল প্রাদুর্ভাব । ব্যতিক্রম তিনজন, যাদের দুইজন সৌদি হওয়ায় থাকে তারা সৌদি জাতীয় পোশাক তোবে । বাকিজন হলেন আমাদের সকলের বস বিশালদেহী ফিল রাশ, থাকেন যিনি ডকাসের্র ট্রাউজারের উপর টিম্বারল্যান্ডের ঢোলাঢালা সুতি চেক হাওয়াই সার্ট চাপিয়ে, সাথে পায়ে একদম অবহেলায় আটকে থাকে একজোড়া পাম্প সু। পাম্প সু দেখলেই এমনিতে সবসময় আমার নতুন দার কথা মনে পড়লেও, ফিলের পাম্প সু দেখে মনে হয়, আর নাহ নদীতে একপাটি পাম্প সু খোয়ানো শ্রীকান্তের সেই নতুন’দার সু তো ছিল ঝকঝকে চকচকে। এদিকে ফিলেরগুলো তো হলো বেশ দোমড়ানো মোচড়ানো । তদুপরি নতুন’দার স্বভাবের সাথেও ফিলের মোটেই নেই মিল ।
সে যাক, যেহেতু যতোটা পারা যায় “যৎদেশে যদাচার” কেই শিরোধার্য করবো বলে ঠিক করেছি , নিয়েছি তাই স্যুট কোট টাইয়ের শরণ নিজেও। সমস্যা হচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিভর্র করতে হচ্ছে সুটকেসে করে আনা একটাই স্যূট আর একটা ব্লেজারের উপর। তিনমাসের হাজতি ভিসায় আসার সময় , যদিও আমার আর সব পোশাক আশাক এবং সংসার পাতার লটবহর পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কুরিয়ারে, সেই ৭/৮টি প্যাকেট এখনো তো এসে পৌছয়নি । আসলেও সেসব তো এনে তুলতে পারবো না এই হোটেলে । থাকবে আপাতত অফিসের স্টোরে । অফিস যখন এই মরুর বুকে আমার জন্য বাসা ঠিক করবে, তখনই ওগুলো লাগবে কাজে । আপাতত এয়ারলাইন্সের বেঁধে দেয়া ওজনসীমার মধ্যে সুটকেসে করে যা এনেছি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে সব পরে সপ্তাহের পর সপ্তাহ চালাতে হচ্ছে দেখে বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছে ম্যারিয়টের পাঁচতারা ধোপার শরণ।
এর আগে শুধুমাত্র সুটকোট ব্লেজার, পাঁচতারা ধোপার ছোঁয়া পেলেও, এই মরুতে আমার এই লম্বা হোটেল বাসের কারনে, আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত পেয়েছে পাঁচতারা ধোপার পরশ। মোজার স্টক যা ঢুকিয়েছিলাম স্যুটকেসে, তাতে এখন পর্যন্ত ওগুলোকে ধোপাখানায় না পাঠালেও অচিরেই পাঠাতে হবে বুজতে পারছি। কারণ ক্লজেটে ব্যবহৃত মোজাগুলোর কারনে, ক্লজেট খুললেই কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে লাগছে নাকে! এইক্ষণে ধোপাখানা থেকে পাঠানো প্যাক খুলে সুবাসিত একটি আন্ডারওয়ার হাতে নিতে নিতে মনে হল, আহারে যেই দামে ধুইয়েছি এটিকে, সেই দামে অনায়াসে ঢাকায় কেনা নতুন একটা। তাও আবার এক্কেবারে উমদা জাতের মানে এঙপোর্ট কোয়ালিটির। অফিস যতোই এসবের বিল মেটাক না কেন, ব্যাপারটা তাও কেমন যেন লাগছে গায়ে।
কিন্তু সাথে সাথেই এ সময় মনের দ্বিতীয় জন মনে করিয়ে দিল, আরে মিয়া ইমিগ্রেশনের সামান্য অবজ্ঞাতেই তো তোমার গায়ে হুল ফুটেছে। এ ছাড়া শুনেছোই তো, সৌদিরা যে বাঙ্গালিদের মিসকিন ভিন্ন অন্যকিছু গণ্য করে না। সেই জায়গায় এইসব ছোটখাট ব্যাপার নিয়া অতি ভাবাভাবি করে তাদের আবার সেই সুযোগ করে দেবে কেন? মনে যা থাকে মানুষের, যতোই তা চেপে রাখুক না কেউ, সময়ে সময়ে তা তো আচরণে বেরিয়েই পরে। ঐ যে কথায় আছে না, যার মনে যা ফাল দিয়া উঠে তা। বাদ দাও ওসব। দায় তো তোমার না! তার চেয়ে বরং এ সুযোগে যে পাঁচতারা ধোপা দিয়ে আন্ডারওয়্যার মোজা ধোয়ানোর মতো একটা বিরল অভিজ্ঞতা হল তোমার সেটাই ভাবো না কেন?
যুক্তি অকাট্য! তাই তথাস্তু বলে, ধড়াচূড়া পরতে পরতে ভাবতে শুরু করলাম আজকের দিনের পরিকল্পনা নিয়ে। আজ বসার কথা আমার গ্রুপ প্রডাক্ট ম্যানেজার আহমেদ রাদি ও তার টিমের সাথে, তাদের ব্র্যান্ড প্লান নিয়ে। গত দুইদিন শুধু সন্ধ্যার সময়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আশেপাশে একটু হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরি কর ছাড়া, হোটেল ছেড়ে বেরুইনি কোথাও। এছাড়া ফোনে কথা বলেছি দেশে, আর ফোন পেয়েছিলাম পাপ্পু ভাই আর জিয়ার কাছ থেকে। অফিসের কাজে জিয়া দাম্মাম গেছে গাড়ী চালিয়ে, ফিরেছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় , তাই আমার এখানে আসতে গোঁ ধরেছিল শুক্রবারে। অনেক কষ্টে নিবৃত করেছি তাকে।
তারপরও ইচ্ছে করলে পারতাম বেরুতে, তবে তাতে সাইফ বেচারার পারিবারিক সময়ের উপর পড়তো চাপ, যা দিতে চাইনি বেচারাকে। এই মরুতে পরিবারের সাথে সময় কাটানোর চেয়ে আর কোন উত্তম চিত্তবিনোদনের উপায় আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আর যাবোই বা কোথায় তাও তো জানি না। এছাড়া থাকতে তো হবে এই মরুতে যতোটা বুজতে পারছি অন্তত বছর তিনেক। ধীরে সুস্থে ঘুরে দেখবো গোটা সৌদি তখন। এমন কি ছুটির দিনগুলোতে যাওয়া যাবে আশেপাশের জর্ডান, বাহরাইন, সুদান, সিরিয়া মিশর, মানে মানব সভ্যতা বিকাশের আদিতম পিঠস্থান গুলোতে । তবে ইয়েমেন যাওয়া যাবে না, মনে হয় আপাতত। ওটা বেশ গোলযোগপূর্ণ। এছাড়া সৌদির সাথে মাঝে মাঝেই লাগে নাকি ইয়েমেনের সীমান্ত ক্যাচাল ! কথা হচ্ছে এই ঘোরাঘুরি করার জন্য দরকার যা, তা হল সৌদি ইকামা । এবার আসার পর এইচ আর হেড গিউসিকে আমার ইকামার জন্য, নিজের শিক্ষাগত সনদসমূহের সত্যায়িত আরবি অনুবাদ হস্তান্তর করার সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাওয়া যাবে কবে নাগাদ ওটা? কোন নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ না করলেও, বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে জনিয়েছিল গিউসি হয়ে যাবে ইকামা অচিরেই। অতএব এখন আমার হাতে “নট পারমিটেড ফর ওয়ার্ক” সিল ছাপ্পড় মারা, তিন মাস মেয়াদি সিঙ্গেল এন্ট্রির যে হাজতি ভিসাটি আছে, তা নিয়ে ঘোরাঘুরি না করাই ভাল। তদুপরি, গত সপ্তাহেই তো বুঝে গেছি এক্কেবারে কাছা বেঁধেই নেমে পরতে হবে দৈনন্দিন কাজে এখন। এখানকার অপারেশনের ধরণ ধারণ বোজার সাথে সাথে , কাজের চাকাও যে ঘোরাতে হবে দ্রুত এটি অত্যন্ত পরিষ্কার। যার কারণে, গত সপ্তাহেই এই সপ্তাহের গোটা সময়টা জুড়ে নানানজনের সাথে মিটিং ফাইনাল করে রেখেছিলাম।
সে মোতাবেক আজ প্রথমেই বসবো গিয়ে আহমেদ রাদি ও তার টিমের সাথে। কারণ এ টিমটার হাতেই আছে, এমুহূর্তে কোম্পানির যাকে বলে হেভিওয়েট ব্র্যান্ডের দু দুটি। যার একটি আছে মার্কেটে আর একটি অচিরেই লঞ্চ করতে হবে । সৌদিতে কোম্পানির মোট বিক্রি যা হয় তার প্রায় ১০ ভাগ আসে রাদির ইনমার্কেট ব্র্যান্ড থেকে । আর যেটি অচিরেই লঞ্চ করতে হবে সেটিরও আছে তুমুল সম্ভাবনা। গত বৃহস্পতিবার যে তিনটা টেলিকনফারেন্স করতে হয়েছিল গ্লোবাল আর রিজিওনাল টিমের সাথে, তার দুটোই ছিল আহমেদ রাদির পোর্টফলিও নিয়ে। যদিও নতুন আসার কারনে সেই টেলিকনফারেন্সে আমার ভূমিকা ছিল শুধুই শোনাউল্লাহর, তবে এই শোনাউল্লাহ ভূমিকাতো আমার অচিরেই বদলাতে হবে। সেজন্যই আজকের মিটিঙয়ে বসার আগে, গত দুইদিনে হোটেলে বসে বসে গভীর ভাবে দেখেছি একদিকে যেমন ঐ ব্র্যান্ড প্লানগুলো, একই সাথে ওইগুলোকে মিলিয়ে দেখেছি প্রথমত কোম্পানির বিজনেস প্লান, দ্বিতীয়ত স্ট্রাটেজিক প্লানের সাথে।
এমনিতে বিশেষত রাদির ব্র্যান্ডপ্লান বেশ সলিড মনে হলেও, তার টিমের সাদেক খাপাগার প্লানটি বেশ দুর্বল মনে হয়েছে । আর নতুন লঞ্চ ব্র্যান্ডটি নিয়ে সেদিনকার টেলি কনফারেন্সের সময় রাদি ও আহমেদ নাশাত, গ্লোবাল টিম ও রিজিওনাল টিমকে যে সব ব্যাখ্যা দিচ্ছিল, সেসব বেশ কনভিন্সনিং মনে হলেও, এখন গভীরভাবে ঐ সব দেখতে গিয়ে, বুঝলাম অনেক কিছুই পরিষ্কার নয়। থিউরিটিক্যালি এই প্লানে গ্লোবাল ও রিজিওনাল টিমকে বুঝ দেয়া গেলেও, আমার তো চলবে না তা দিয়ে। কারণ অপারেশনালি আমাকে এগুলোর সার্থক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে আমার, যার উপর নির্ভর করে কান্ট্রি হেড, মানে ফিলের পারফরমেন্স । প্লান যতো ভালই হোক, আর যতোই কাজের দাপাদাপি করা হউক না কেন বছর জুড়ে, বছর শেষে কোম্পানির কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো শুধুই তিনটা নম্বর বা সংখ্যা, যাকে ব্যবসায়িক ভাষায় বলে টপলাইন, বটমলাইন ও মিডল লাইনের নম্বর। মানে বিক্রি কতো হল, লাভ কতো হল, আর খরচ কতো হল। এবং এই তিনটার মধ্যে দুইটা লাইনের নম্বরের রাশ আছে আমার হাতে, হেড অব মার্কেটিং বা চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসাবে। ও দুটো মানে বিক্রির লাইন আর খরচের লাইন ঠিকমতো বুঝতে পারলে সামলানো সহজ। ঐ দুই লাইন সামলালে অনায়াসে চলে আসবে তৃতীয় লাইনের তৃতীয় সংখ্যা লাভ, যা হলো কিনা ব্যবসা নামক কর্মকাণ্ডের এক ও অদ্বিতীয় লক্ষ। অতএব ফিলের নির্ভরতা যে আমার উপরেই হবে বেশী, সেটাই তো স্বাভাবিক।
এরই মধ্যে ধরা চূড়া পরা সারা হয়ে যাওয়ায়, রুম থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে লবিতে পা রখাতেই, ডান দিকের সোফায় বসে থাকা সাইফ আমাকে দেখেই সালাম দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল গেইট দিয়ে পার্কিং লটের দিকে ।
সকালের এই সময়টায় রিয়াদের এদিকটার রাস্তায় থাকে দেখছি বেধড়ক গাড়ীর চাপ। এই চাপের উপর নিভর্র করে হোটেল থেকে যাত্রা করে অভিজাত তাহলিয়া স্ট্রিটের আমাদের অফিসে যেতে লাগবে কি ১৫ নাকি ২৫ তিরিশ মিনিট! আজ সপ্তাহের প্রথমদিন বলেই কি না জানি না, সাইফ গাড়ী নিয়ে রাস্তায় ওঠার পর মনে হল, সাপ্তাহিক ছুটির আমেজ কাটিয়ে, এখনো রিয়াদের এক্সপাট কমিউনিটি মানে বিদেশীরা রাস্তায় নামে নি । এই দেশটা সৌদি বেদুইনদের হলেও , এর অর্থনীতির চাকা তো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ঘোরায় বিদেশীরাই। দিনের যে সময়ে বিদেশীরা ঘোরাতে শুরু করে এখানকার যাবতীয় কল কারখানা ও অফিস আদালতের চাকা, সৌদিরা তো থাকে তখনও বিছানায়।
“স্যার, এই লোক নাকি আপনার দেশের। আপনার সাথে কথা বলতে চায়, বলেছে আমাকে বেশ কয়েকবার ।“
রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকায় মনে হচ্ছে ১২/১৩ মিনিটের মধ্যেই সাইফ চলে এসেছে অফিসে। অফিসের বন্ধ গেইট খোলার জন্য, গাড়ি থামিয়ে সাইফ তার কাছে থাকা রিমোটের বোতাম চাপতেই সেটি গেইটি সামান্য শব্দ তুলে খুলে যেতে শুরু করতেই, গেইটের পাশে থাকা সেন্ট্রিরুম থেকে একমুখ কাঁচা পাকা দাড়ি সম্বলিত লোকটি, যে নাকি স্যালুটের ভঙ্গিতে সালাম দিল, তার ব্যাপারে স্বভাবগত নিম্নকণ্ঠে সাইফ জানালো উপরের ঐ কথা। বেশ পুলকিত হলাম এতে এই ভেবে যে, যাক আছে দেশী একজন তাহলে আমার অফিসেও।
অফিসের পার্কিংলট হল মাটির তলায় মানে আন্ডারগ্রাউন্ডে। সাইফ সাধারণত পার্কিং লটে সেঁধিয়ে যাওয়ার জন্য নিম্নগামী হওয়ার আগে, অফিসে ওঠার সিড়ির গোড়ায় আমাকে নামালেও, নেমে গেলাম এখন গেইটের মুখে!
এভাবে গেইটের মুখেই আমাকে নামতে দেখে মনে হল কিছুটা ভড়কে গেছে লোকটা। কিছুটা উঁচু গলায় “আসসালামুয়ালাইকুম” হতচকিত ভাবে করে বললেন– “স্যার আমি হারুন উর রশিদ মজুমদার। জেলা কুমিল্লা”।
ওয়ালাইকুম। বাহ আপনিতো দেখি বলা চলে একদম আমার জেলার লোক। তা কুমিল্লা কোথায় বাড়ি? বলতে বলতে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াতেই– ফের মনে হল ভড়কে গেলেন মজুমদার সাহেব।
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।