দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

জানি না, অবস্থা আসলে এর অতোটাই শোচনীয় কী না? নাকি মনে মনে যেহেতু রিয়াদ এয়ারপোর্টকে দুবাই এয়ারপোর্টের সহোদর ভেবেছিলাম, সেজন্যই কি এর প্রথম দর্শনেই খেলাম এরকম বেমক্কা ধাক্কা?

আমার ও আমাদের কল্পনাশ্রিত ধারনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের, অঢেল বালির গভীরে ইং মার্কিন টেকনোলজির বরাতে বিশাল তৈলভাণ্ডার আবিষ্কৃত হওয়ার পর, ঐ পশ্চিমাদেরই বিনিয়োগ ও মেধাশক্তির জোরে যখন থেকে সেই তৈলসমুদ্র মন্থন করা শুরু হয়েছিল, সেই থেকেই এককালের মরুদস্যুকবলিত উষর হাভাতে মরুতে কল কল রবে বইতে শুরু করেছিল দুধ ও মধুর নহর। তারপর দিনে দিনে এই এলাকাটি পরিণত হয়েছিল পশ্চিমা বিলাসদ্রব্যের বিরাট বাজারেও। ফলে নানান দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পশ্চিমা সেইসব বিলাস দ্রব্যেসমূহের যে পশরা বসে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টির অবস্থনা দুবাইয়ে। তারই প্রতিবেশী এই রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কেতাবি নাম যার হলো কিং খালেদ ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট, তাতে একটু আগে পা রাখার পর থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোন কিছু চোখে পড়েনি।

অবশ্য এখনই এ ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে কোন পৌঁছানরও কিছু নেই । কারন ঐসব বিলাসদ্রব্য নিয়ে ট্যাঙ ফ্রি নামে বিমানবন্দরে বন্দরে চোখ ধাঁধানো যে বাজার সাজানো হয়, সে সবই থাকে আসলে বহির্গমন লাউঞ্জে; সে জায়গায় আছি তো আমি এখন আগমনীতে।

ঘটনা হচ্ছে পেশাগত কারনে, দাপ্তরিক নারায়নের কল্যাণে ইতিমধ্যে নিজ ঝুলিতে নানান দেশের এয়ারপোটের্র অভিজ্ঞতা জমা হলেও, মরুভূমির যে একমাত্র এয়ারপোর্টটির অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার একাধিকবার, সেটি হল দুবাইয়ের। আর আমেরিকার পর সৌদি আরবকেই যেহেতু জানি পৃথিবীর বৃহত্তম তৈল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে, সে কারণে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল মনে যে, রিয়াদ এয়ারপোর্ট অবশ্যই হবে দুবাই এয়ারপোর্টের যমজ ভাই বা বোন। তবে এখন পর্যন্ত সেরকম কিছুর আঁচই পাইনি। সে যাক, এগুচ্ছিলাম কেন জানি বলা চলে, রয়ে সয়ে, দুলকি চালে। যা মনে হচ্ছে সহসিটযাত্রীদ্বয়, মানে হামিদ মিয়া ও কবির উদ্দিন ভাইয়ের পছন্দ হয়নি। ফলে এরই মধ্যে দুজনেই আমাকে পিছু ফেলে কয়েকবার সামনে এগিয়ে গেলেও, অচিরেই নিজেদের গতি সামলে হয়েছেন তারা আমার সহপথিক। ঘটলো যেমন এইমাত্র ফের। এবার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে, হামিদ মিয়া মানে দুজনের মধ্যে যিনি একটু আলাপি ধরনের, বললেন উনি ‘ছার, একটু জোরে চলেন। ঐ যে দেখেন আরো মানুষ নামছে । আমরা তো পিছে পইড়া যামু!”

হ্যাঁ তাইতো? কোত্থেকে উড়ে এসে এখানে জুড়ে বসলো এই বিমান এখন? সামনের বাঁ দিকের আরেকটা বোর্ডিং ব্রিজ দিয়ে তো দেখছি নামছেন লোকজন একই রকম ত্রস্ততায়। পোশাকে আশাকে এবং চেহারায় তাদেরকে আমাদের সমগোত্রীয় মনে হলেও, এ বিমান যে ঢাকা থেকে আসেনি এ তো নিশ্চিত । সাউদিয়ার তো জানি একটাই ফ্লাইট যাওয়া আশা করে দিনে ঢাকা রিয়াদ রুটে।

নাহ বেশিক্ষন ধন্দে থাকতে হল না। হামিদ মিয়ার তাড়ায় আমার দুলকি চালে অতিরিক্ত গতি সসঞ্চারিত হওয়ায়, বাঁ পাশের বোর্ডিং ব্রিজ থেকে হুড়মুড় করে নামা প্রথম দলটির অংশ হয়ে এগুতে এগুতে, ঐ দলের নানান জনের বাতচিতে পরিষ্কার হল, এনারা আমাদের ঘরলাগোয়া প্রতিবেশী, মানে ভারতীয়। তবে ভারতের কোন অংশ থেকে বা ঠিক কোন বিমান বন্দর থেকে যে এনারা, এসেছেন তা বোঝা যাচ্ছে না। নানান ভাষা আর সংস্কৃতির দেশ ভারতের নাগরিকেরা, ভারতের বাইরে গেলে কথা বলেন সবাই সম্ভবত হিন্দিতে। এরই মধ্যে টুকটাক যে সব বাতচিত কানে এলো এই ভিড় থেকে, তার সবই হিন্দিই। তারপরও কেন জানি মনে হল, আচ্ছা এই দলে কোন কইলকাইত্তা বাঙালী আছেন কি?

হ্যাঁ কোলকাতার মানুষেরা নিজেদের বাঙালী মনে করলেও আমাদেরকে কিন্তু ঐ পংক্তিযোগ্য মনে করেন না। তাদের কাছে আমরা হলাম বাঙ্গাল! এ নিয়ে মনে কিঞ্চিৎ ক্ষোভ থাকলেও, কেন জানি যখনই কোন ভারতিয়র মুখোমুখি হই, মনে মনে আশা করি হবেন ইনি নির্ঘাত কলকাতার দাদা। হচ্ছে যেমন তা এখনো। এতে লাভ যে কী? জানি না তা সঠিক। বিদেশ বিভুইয়ে শুধুই আ’মরি বাংলা ভাষায় কথা বলার আনন্দের জন্যই কি মনের এই আকুতি?

ভারতীয় যাত্রীদের ভিড়টির অংশ হয়ে এগুতে এগুতে, এসব ভাবতে ভাবতেই ভিড়ের ফাঁক গলে ডান দিকে নজরে এলো রেস্টরুমের সাইন। ঐ সাইনগুলো দেখে বেশ চমৎকৃত হলাম। কারণ ঐ সাইনগুলোতেও এটা পরিষ্কার যে, এ হল সৌদি আরব ! টয়লেটের সাইনে শশ্রুমন্ডিত মুখ ও তোউব মানে সৌদি পুরুষের জাতীয় পোশাক পরিহিত পুরুষ ও আবায়াসমৃদ্ধ নারীর সাইন দেখে বেশ মজাই লাগলো। পৃথিবীর কোন দেশের টয়লেটের সাইনে, সে দেশের নিজেদের জাতীয় পোশাকের প্রতি এরকম ভালবাসার প্রকাশ দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না, ভেবে!

কথা হচ্ছে, এক্ষুনি যদিও ঐ ঘরে হাজিরা দেবার কোন শরীরবৃত্তীয় তাড়া অনুভব করছি না, তারপরও সামনেই পড়ল যখন, ওখানে একটু হয়েই আসা যাক না, মনে এরকম ভাবের উদয় হতেই সোজা সামনের বদলে ডান দিকে কান্নি মেরে এগুতেই

কী ছার , এইদিকে কি যাইতে হবে আমাগো এহন?”

ওহ, সাথে তো আছেন আমার দুই ভ্রাতা, যারা নাকি আমারই মতো প্রথম এসেছেন আজ এখানে, কথাটি কেন যেন ভুলে গিয়েছিলাম মুহূর্তের জন্য। ঘাড় ফিরিয়ে তাই হেসে বললাম, বুঝলেন না বাথরুম মানে টাট্টিখানার দেখা পাইলাম তো, ভাবলাম একটু হইয়া আসি।

খুব বালা অইছে ছার।”এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম মুখ খুললেন মুখচোরা কবির উদ্দিন। হলেন দ্রুত উনি আমার সহযাত্রী। পিছু নিলেন দেখি তখন হামিদ মিয়াও।

এ ঘরে পা রাখতেই এমনিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ না হলেও হাল্কা গন্ধ নাকে যাওয়ার পর, মেঝেতে থাকা ছোপ ছোপ পানি ও মেঝের নানান জায়গায় গড়াগড়ি করতে থাকা টয়লেট টিস্যু চোখে পড়তেই, কিং খালেদের নামের এই এয়ারপোর্টকে রাজকীয় কিছু মনে হবার তো প্রশ্নই উঠলো না, বরং মনে হল আজকাল আমাদের ঢাকার এয়ারপোর্টের টয়লেটের অবস্থা এর চেয়ে ঢের ভাল। এতো দেখছি রাজকীয় বিমানবন্দরের বেহাল না শুধু নোংরা অবস্থাই!

নাহ ফাঁকা নয় এই টয়লেট। আমরা ত্রিমূর্তি হাজির হবার আগেই আরো অনেকেই দেখছি দিয়েছেন হাজিরা এ ঘরে। হাজেরানে এই মজলিসের কারো কারো অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছে তর সইছে না তাদের। তাদের এই অস্থিরতা কি আসলে প্রাকৃতিক চাপের জন্যই হচ্ছে? না কী লাইনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে তাদের অনভ্যাসজনিত তীব্র অনীহার কারণে তাদের এই অস্থিরতা, এটা বোঝা ভার। পোশাকে আশাকে আচরণে এদের বেশির ভাগকেই উপমহাদেশীয় শ্রমজীবীই মনে হচ্ছে ।

মোদ্দা কথা হল উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে কিছুটা বিশৃংখলতার আভাস চোখে পড়তেই, ঝি কে মেরে মাকে বোঝানোর যে তরিকা আছে আমাদের দেশে, সেটি প্রয়োগ করে আমার দুই সহযাত্রিকে হাতের ইশারার সাথে মুখে বেশ জোরের সাথেই বললাম খাস বাংলায়, থাকেন যেন তারা লাইনে। মজার ঘটনা হল মনে হচ্ছে কাজ হল তাতে । নিজে আগে যাবার তাড়নার অস্থিরতা কিছুটা কমলো হাজেরানে মজলিসের!

বরাবরই দেখেছি বাথরুমেই গুরুত্বপূর্ণ সব কথা মনে পড়ে আচমকা। ব্যতিক্রম হল না এখানেও। লাইনে অপেক্ষা করে যেই না, অবশেষে পেলাম একটা ছোট ঘরের দখল, মনে পড়লো আচ্ছা আমার জন্যতো বাইরে হোটেল থেকে গাড়ী এসে অপেক্ষা করার কথা। সেই গাড়ী কি আছে এখনো? প্লেনতো এসেছে চার ঘণ্টা বিলম্বে। তদুপরি ইমিগ্রেশন করে ব্যাগ সুটকেস নিয়ে বেরুতে বেরুতে কতক্ষণ যে লাগে তা তো জানি না? অতক্ষণ থাকবে কী হোটেলের গাড়ী? যদি না থাকে তাহলে তো পড়বো ফ্যাসাদে ! কারন সাথে তো ডলার কিছু টাকা থাকলেও রিয়াল তো নাই!

আচ্ছা ঠিক আছে মানি চেঞ্জার থেকে ভাঙ্গিয়ে নেব না হয়। কিন্তু ট্যাক্সি ভাড়া যে কতো দিতে হবে? তা তো জানি না। আবার এখানকার ট্যাক্সিওয়ালাদের নিয়ে যতটুকু যা শুনেছি, তাতে তো জানি যে, কোনমতেই এই রাতে কোন সৌদি ট্যাক্সি ড্রাইভারের পাল্লায় পড়া যাবে না। খুঁজতে হবে উপমহাদেশীয় কোন ট্যাক্সিওয়ালা। আচ্ছা সৌদিরা কি আসলেই ট্যাক্সি চালায়? এরকম তেলের উপরে ভাসমান দেশের মানুষ ট্যাঙি চালিয়ে জীবনধারণ করে, এরকম ভাবতেও কেমন যেন খটকা লাগছে!

বরাবরের মতোই খুব বেশী সময় লাগলো না নিজের। ভাল বিষয় হচ্ছে টয়লেটের কিউবিকল থেকে বেরিয়ে সহযাত্রীদ্বয়ের কারোই যেহেতু দেখা পেলাম না, বোঝাই যচ্ছে এরই মধ্যে পেয়েছেন দুজনেই দখল কোন না কোন কিউবিকলের। না, এখানে দাঁড়িয়ে এমোনিয়ার গন্ধের সাথে যোগ হওয়া বিচিত্র দুর্গন্ধ শুঁকছি কেন? দাঁড়াই না গিয়ে বাইরে বরং।

কতক্ষণ যে গেল সময়, কে জানে ? হবে হয়তো গেছে সময় মিনিট পাঁচ কি সাত কি দশ ! এমনিতেই তো অপেক্ষার সময় কাটে না । ফলে এরই মধ্যে বার দুয়েক উঁকি দিয়েছি টাট্টিখানার ভেতরে । আসছে না কেন হামিদ মিয়া ও কবির উদ্দিন, ভাবত ভাবতে এবার তৃতীয় উঁকি দিতেই-“ঐ তো ছার , ঐ তো ছার” বলে এক গাল হেসে দরজার দিকে হামিদ মিয়া এগুতেই স্বস্তির হাসি হেসে এগুলেন কবিরউদ্দিনও ।

সামনের ভিড় ততোটা কমেনি মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি না, এই বিমানবন্দর খুব কী ব্যস্ত নাকি সর্বক্ষণ? এরই মধ্যে মনে হচ্ছে আরো কোন প্লেন নেমেছে। ভাবতে ভাবতে গোটা করিডোর জুড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকা ভিড়ের অংশ হয়ে এগুচ্ছি আমরাও। তবে একইভাবে বেশীক্ষণ এগুনো গেল না। অচিরেই একযোগে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই চলমান ভিড়টিতে চাঞ্চল্য দেখা দিল। তাতে সামনের অনেকেই দ্রুত পিছিয়ে বাঁয়ে সরে যেতেই দু মানুষ চওড়া একটা লাইন হয়ে গেল চলমান এই ভিড়টা। ব্যাপারটা ছোটবেলায় বর্ষার পানিতে দেখা শোল বাঁ টাকি মাছের পোনাদের মতোই মনে হল। নিস্তরঙ্গ পানিতে সোনালি বা লাল রঙ্গয়ের পোনাগুলো সব হুড়মুড় করে একযোগে সামনের দিকে এগুতে থাকলেও, কোন বাঁধা ব বিপদ টের পেলে যেমন পোনাদের সেই চওড়া দলকে দ্রুত সরু লম্বা লাইন করে এগুতে দেখেছিলাম, ঘটলো তেমনি করিডোরের এই ভিড়েরও। দশ বারো মানুষের চওড়া এই লাইনটি হঠাৎ দুই মানুষে চওড়া লাইনে পরিণত হয়ে সামনের দিক বাদ দিয়ে ডান দিকে এগুতেই ভাবলাম, ঘটনা কী? সাথে সাথে বুঝতে পারলাম যে, ডানেই হয়তো ইমিগ্রেশন হলে যাবার রাস্তা । কিন্তু সেই রাস্তা কি সরু নাকি ? না হয় হঠাত করে সবাই বাঁয়ে চেপে গিয়ে লাইন ধরে এগুচ্ছে কেন? এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই, তখনি কানে এলো উচ্চ ও কর্কশ গলার “হাউ” “হাউ” ধ্বনি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়া দশমীর বিদায় বার্তা
পরবর্তী নিবন্ধAI এবং H2H মার্কেটিং, আচরণগত বিজ্ঞান এবং জাতিসংঘ ২.০ যুগের সূচনা