এই যে ভাই মুখ খারাপ করছেন কেন? খবরদার কেউ মুখ খারাপ বা ব্যবহার খারাপ করে দেশের মান ইজ্জত ডুবাইয়েন না। খাড়ান আমি দেখতাছি। ভোমা আকারের বোয়িং ৭৭৭ এর পেটবন্দি নানান জনের বিরক্তি, রাগ, হতাশা, ক্ষোভ এতোক্ষণ গুজ গুজ গুন গুন করলেও, ঐ বাচ্চাটির কারণে সেটি এখন শোরগোলে পরিণত হয়েছে! এরকম একটা গোলযোগের মধ্যে, মুখ ফসকে চড়া গলায় সবার উদ্দেশ্যে ঐকথা কটি বলে ফেলেই, কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম মনে মনে! বলা তো যায় না, কে আবার বলে বসে, ‘আপনে মিয়া কোন জায়গার কোন তালেবর?’ কিম্বা, ‘রাখেন মিয়া আফনে কেডা? কাবিলতি করেন ক্যা গাইল তো আফনেরে দেয় নাই।’ বা ‘দালালি বাদ দিয়া আফনে বসেন মিয়া’ বলতেই পারেন এরকম কিছু, যে কেউ! এয়ারকুলার বন্ধ করা বিমানের পেটবন্দি হয়ে মধ্য ফাল্গুনে চৈত্রের উনুনের গরমে সবাইতো তেতে আছে। তদুপরি খাবার তো দূরের কথা, এতক্ষণের শোরগোলে বিমানখালারা কাউকেই এক গ্লাস পানিও দেবার প্রয়োজন মনে করেনি।
যাক বাঁচা গেল! ঐরকম কিছুই কানে এলো না। উল্টা মনে হল, একটু আগের উচ্চনিনাদের শোরগোলের গলা অনেকটাই মিইয়ে গিয়ে, বুজে এসেছে। অতএব দেরী না করে, অনেকটা ঠিক আমার পিঠের উপরে উপুড় হয়ে অসুস্থ বাচ্চাটির জন্য তুমুল উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বললাম
পানি নাই তো, যান ঐদিকে বিমানখালাদের কাছে। বলেন গিয়া যেন এখনি পানি দেয়।
আমার এই তাড়া কানে যেতেই, ঐ একজনই না, দুই দুইজনকে আইল ধরে হাঁচড়ে পাচড়ে এগুতে দেখলাম বিমানের সামনের দিকে থাকা খাবার স্টোরের দিকে, যেখানটায় আছেন সম্ভবত বিমানখালারা সবাই। পোশাকে আশাকে, চেহারায় সব মিলিয়ে নিতান্তই শ্রমিক চেহারার এই দুইদেশী ভাই ঐদিকে এগিয়ে যেতেই মনে হল, নাহ ওদের দেখলে নিশ্চয় মোটেও পাত্তা দেবে না বিমানখালারা। যেতে হবে আমাকেই। দিতে হবে গিয়ে একটা আচ্ছা ঝাড়ি, এই অপগণ্ডদের। যতোই এতক্ষণ তারা উপেক্ষা করুক এই বিমানের যাত্রীদের, এটা একটা মেডিক্যাল ইমারজেন্সি। দরকার হলে সোজা গিয়ে হাজির হব ককপিটে, ক্যাপ্টেনের কাছে।
ভাবতে ভাবতে দ্রুত পায়ে এগুলাম আইল ধরে, ভেতরে ভেতরে ফুঁসে ওঠা তুমুল ক্রোধকে প্রবল কষ্টে চেপে রেখে গজগজ করতে করতে!
হ্যাঁ, ভেবেছিলাম যা, হয়েছেও তাই। আমার আগে বিমানখালাদের কাছে এসে পানির আবেদন করা, দুই দেশিভাইয়ের উপস্থিতি অবলীলায় উপেক্ষা করে, দেখছি গুলতাপ্পি আর হাসাহাসিতে ব্যস্ত খালারা। মাথায় তাতে আগুন ধরে গেলেও, দ্রুত নিজেকে সামলে একদম শান্তভাবে বললাম
হাই লেডিস, আই ওয়ান্ট টু টক টু দি ক্যাপ্টেন, নাউ। প্লিজ, গো এন্ড আস্ক হিম, হোয়েদার আই শুড গো টু তো হিম টু দি ককপিট, ওর হি উইল কেয়ার টু কাম ডাউন হিয়ার?
রংচটা পুরানো ব্লু জিন্স প্যান্টের উপরে ততোধিক পুরানো ও রং চটে যাওয়া লাল পলোশার্ট চাপানো আমার ভূতো চেহারা দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কারণেই কিনা জানি না, অকস্মাৎ থেমে গেল খালাদের হাসাহাসি গুলতাপ্পির কলকাকলি। এমন কী সিট ছেড়েও উঠে দাঁড়ালেন বসে ছিলেন যারা, এই কিছুক্ষণ আগেও! এদের মধ্যে নেত্রী গোছের যিনি, বেশ উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, হয়েছে কী?
মনে হল তখন, নাহ আমি আদমের সুরতের কারণে না; ভির্মি খেয়ে গেছে তারা এই প্লেনভর্তি আদমদের অন্যতম এই আদমের মুখ থেকে একটু আগে দ্রুত নিসৃত ঐ আংরেজি বাতচিতেই! এমনই মাজেজা কলোনিয়াল প্রভুদের ঐ ভাষার যে, খালাদের সকলের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, বেশ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন তারা আমায়। অতএব সেই ব্যাপারটিকে আরো জোরদার করার জন্য খুব ঠাণ্ডা গলায় একটানা চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকলাম
ইউ নো? দেয়ার ইজ এ মেডিক্যাল ইমারজেন্সি ইন দি প্লেন! এ বেবি হ্যাজ গট ফেইন্টেড ইন দিস হেল লাইক স্ক্রসিং হিট, দ্যাট রেজাল্টেড এজ দি ক্যাপ্টেন সুইচট অফ দি এয়ারকুলিং সিস্টেম। এন্ড দেন ইউ লেডিস, হেভ নট গিভেন এ ড্যাম টু দি সিচুয়েশন, সো ফার! ইভেন হোয়েন দিজ টু জেন্টেলম্যান কেইম ফর ওয়াটার ইউ, সিমপ্লি ইগনোরড। নাউ আই ওয়ান্ট টু টক নান বাট অনলি টু দি ক্যাপ্টেন!
সব কথা আমার, পুরো শুনল কী না তারা ? নিশ্চিত নই। তবে এরই মধ্যে দেখছি ও শুনছি সেই নেত্রী খালা দ্রুত আরবিতে বাকি চার বিমানখালাদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলছেন,
তাতেই তাদের একজনম দ্রুত দুই গ্লাস পানি দিলেন দুই দেশী ভাইয়ের হাতে। আরেকজন হাতের ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে এগুলেন, ককপিটের দিকে।
হাতে পানি পেতেই দুই দেশী ভাই আইল ধরে এগুতে লাগলেন যখন ঐ বাচ্চাটির দিকে, তখন দেখি আরেক খালা, নিজেও ট্রেতে দু তিন গ্লাস পানি নিয়ে তার জন্য আমাকে সরে পথ করে দেবার ইশারা করতেই, কি মনে করে যেন নিজেও দিলাম ঘুরে হাঁটা বাচ্চাটির দিকে।
এরই মধ্যে সরব হয়ে উঠেছে শুনলাম প্লেনের সাউন্ড বঙ। আরবি টানের ও টোনের ইংরেজিতে বিমানখালাদের কেউ একজন ঘোষণা দিচ্ছেন, প্লেনে যদি কোনো ডাক্তার বা নার্স থেকে থাকেন, তার সাহায্যের দরকার এই মুহূর্তে। এইসব আরো কী কী যেন বলতে থাকলেন খালা। সেইসব কথা কানে ঢুকলেও মরমে পশিল না মোটেই। এছাড়া দ্রুত এগুনোর কারণে এরই মধ্যেতো এসে পড়েছি ঐ বাচ্চাটির কাছে।
এদিকে আগেই গ্লাসভর্তি পানি নিয়ে আসা দুজনের, একজনের হাত থেকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন দ্রুত এক গ্লাস পানি নিয়ে তাতে আঙ্গুল ডুবিয়ে মায়ের কোলে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাক্কা বাচ্চাটির চোখে মুখে পানির ছিটা দেবার টোটকা চিকিৎসা শুরু করে দিয়েছেন।
‘এই যে ভাই একটু সরেন, সরেন। আমাকে একটু দেখতে দেন বাচ্চাটাকে। আমি ডাক্তার।’
পেছন থেকে আসা এই কথায় দ্রুত নিজেকে আইলের ডান দিকের সিটের দিকে সরিয়ে নিয়ে পিছিয়ে যেতে যেতে সামনে জটলা করে বাচ্চাটিকে টোটকা চিকিৎসা দিতে থাকা দেশী ভাইদের বললাম, ডাক্তার সাহেবের জন্য জায়গা করে দিতে
ডাক্তার আসিতে না আসিতেই রোগী ভালো হইয়া গেল, এই রকম আনন্দময় কোনো বাক্যের ইংরেজি ট্রান্সলেশন স্কুলজীবনে করিনি। করেছিলাম যেটি সেটি বড়ই হৃদয় বিদারক! সেই ট্র্যান্সলেশনে ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রুগী মরিয়া গিয়াছিল! কপাল ভালো যে, ঘটনা ঘটলো এখানে ঐ ট্র্যান্সলেশন না করা বাক্যের মতোই!
গোটা বিমানকে সচকিত করে, খুব তীব্রভাবে না হলেও বেশ জোরে বাচ্চাটি কেঁদে উঠতেই, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তীব্র গরমে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া প্লেনের পেটভর্তি সকলেই, একই সাথে!
‘কী হয়েছিল ডাক্তার সাহেব বাচ্চাটার? হিট স্ট্রোক না তো? ট্রাভেল করতে পারবে তো বাচ্চাটা?’
দুই কানে দুইপ্রান্ত গোঁজা থাকার কারণে গলায় ঝুলতে থাকা স্টেথোটি কান থেকে ছাড়িয়ে ভাঁজ করে হাতে নিতে নিতে, ঘুরে নিজের সিটের দিকে রওয়ানা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রৌঢ় ডাক্তার সাহেব আইলে আমার মুখোমুখি হতেই, জিজ্ঞেস করলাম। ‘না, ঐরকম সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে না। সেন্স হারিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য, আর কী! একটু ওরস্যালাইন বা জুস টুস দিতে বলেন না বাচ্চাটাকে।’
বলতে বলতে আমাকে পেরিয়ে ডাক্তার সাহেব নিজের সিটের দিকে এগুতেই, আমার ঠিক পেছনে আইলের বাঁ দিকে পানিভর্তি গ্লাসের ট্রে হাতে নিয়ে কিছুটা থতমত খেয়ে কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা বিমানখালাকে দেখে, আরবিতে কিছু একটা বললেন উনি তাকে। তাতেই তড়িঘড়ি করে এগুতে লাগলেন এই বিমানখালা বিমানের খাদ্যভাণ্ডারের দিকে!
এই যে ভাই, আপনারা আর ভিড় করবেন না এখানে। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে। এবার একটু নিজ নিজ সিটে গিয়ে বসেন সবাই। প্লেনে হাওয়া বাতাস না থাকলেও, যা আছে তা একটু বাচ্চাটার গায়ে লাগতে দেন।
এরই মধ্যে আশপাশের সিট থেকে কয়েকজন উঠে গিয়ে মায়ের কোলে কাঁদতে থাকা বাচ্চাটির সিটের সামনে পেছনে পাশে গিয়ে ভিড় করাতে, বলতেই হলো কথাগুলো তাদের উদ্দেশ্যে। কাজও হলো ওতে। মনে মনে তাই নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে হৃষ্টচিত্তে ধরলাম ঘুরহাঁটা, উদ্দেশ্য; নিজের সিটে ফিরে যাওয়ার আগে ককপিটে যাওয়া।
অতপর অচিরেই বিমানখালাদের সেই স্টেশনে উপস্থিত হতেই, হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে নেত্রীখালা জানালেন সমস্যা তো মিটে গেছে। কী সেবা করতে পারে তারা আমার এখন?
বললাম আমার তো কিছুই লাগবে না। আগেই তো বলে গিয়েছিলাম, ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই। এসেছি তাই।
উত্তরে নেত্রী খালা বললেন, তার আর দরকার আছে কী? বাচ্চাটি তো সুস্থ হয়েই গেছে। তার জন্য জুস পানি সব পাঠানো হয়েছে। আবার এরই মধ্যে ক্যাপ্টেনতো এয়ারকুলিং সিস্টেমও চালু করে দিয়েছেন। আর তো কোনো সমস্যা নাই।
ওঁর কথা শুনেই মনে হল, আরে তাইতো? খেয়াল তো করিনি এতক্ষণ আগের মতো গরম তো লাগছেই না বরং একটু ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশও মনে হচ্ছে, লাগছে গায়ে! তারপরও নিজ দাবীতে অটল থেকে বললাম–ঠিক আছে তাহলে তাকে ধন্যবাদ দিতে চাই।
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।