দেশ হতে দেশান্তরে

আকাশবনিতা : বিমানবালা? না বিমানখালা?

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ

শেষ মুহূর্তে অকস্মাৎ উড়াল স্থগিত করে, ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ের কোনো এক জায়গায় স্থবির হয়ে থাকা বিমানে, কষে কোমরে সিট বেল্ট বাঁধা অবস্থায়, মনের গহীনে বেশ কিছুক্ষণ নানান ভাবনার জলে সাঁতার কাটছিলাম যখন, তখনই ক্ষুধার্ত সহসিটযাত্রীদ্বয় ফের যখন বলে উঠলেন, ‘কী ছার, দিব না খাওন এখন?”

সাথে সাথে ভাবনার জলে সাঁতার কাটায় ইস্তফা দিয়ে, তাদের খাবারের বিনীত নিবেদনটি যথাস্থানে পৌঁছে দেবার জন্য, সিটবেল্ট খুলে দাঁড়িয়ে, সারসের মতো গলা লম্বা করে এই বিমানের আকাশবনিতাদের যাদের বিমানবালা না বলে বিমানখালা বলাই যুক্তিযুক্ত, তাদের খোঁজে ডানে, বাঁয়ে, পেছনে, যখন ঘুরে বেড়াতে লাগলো চোখ বিমানময়, তখনই মনে হল লোকজনের শোরগোল, হট্টগোল বুঝি হঠাৎ করেই আরো বেশ উচ্চকিত হয়ে উঠলো!

ঘাবড়ে গেলাম কিছুটা, তাতে। মনে হল এই আমি, হঠাৎ করে যে দাঁড়িয়ে পড়লাম, সেজন্যই বুঝি জনগণ গেছে ক্ষেপে। যেমন হয় আর কী সিনেমা হলে, যাত্রা প্যান্ডেলে বা নাটশালায়; বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ কোনো চলমান দৃশ্যের সময়, সামনের দিকের দর্শক সারির কেউ যদি কোনো কারণে পেছনের দর্শকদের চোখের সামনে কিউক্রাডাং হয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, তখন যেমন পেছনের অনেকেই হৈ চৈ করে উঠে তেমন আর কী।

কিন্তু তা হবে কেন? এই বিমানের সামনের দিকে তো, কোনো মজমা বসে নাই যে দণ্ডায়মান আমি কারো চোখের সামনে কাঞ্চনজংঘা কিউক্রাডাং উঠেছি! কান পেতে তাই শুনতে চেষ্টা করলাম, ঐ শোরগোল আর হট্টগোলটি, যাতে তা থেকে বোধগম্য কিছু বাক্য আলাদা করা যায়।

সফলও হলাম এতে। বুঝলাম শুধু আমার সহসিটযাত্রিদ্বয়ই নয়, বোয়িংবংশের ভোমা সাইজের ৭৭৭ জাতের এই বিমানের পেটে করে মরুগামী হওয়া অনেক বঙ্গশ্রমিকের পেটেই এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ছুঁচোর কেত্তন! এখন তাই, বিমান কেন ছাড়ছে না দ্রুত, এই দাবীর বদলে অনেকেই খাস মাতৃভাষায় দাবী করছে খাবারের! এরই মধ্যে আবার কয়েকজনের উচ্চকিত শোরগোল থেকে কানে এলো জোরদার আরো কিছু অনুযোগ ও মন্তব্য

পাইলটে এসি বন্ধ করলো ক্যান?’

উহ গরমে তো জান খারাপ হইয়া গেল!’

ফাইজলামি পাইছে নাকি বেটা?’

মাগনা যাইতাছি নাকি আমরা?’

ঐ যে মনের গহীন জলে ডুব সাঁতারে ব্যস্ত ছিলাম এতক্ষণ, টের পাইনি তাই ব্যাপারটা। এইমাত্র উপরোক্ত ঐসব নানান মন্তব্য কর্ণকুহরে প্রবেশেই টের পেলাম যে, এরই মধ্যে নিজেই জব জব ঘেমে নেয়ে উঠেছি জামা কাপড়ের ভেতরে! দ্রুত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানে সকল ঋতুতেই যে কোনো ভ্রমণে যে হালকা জ্যাকেট টি গায়ে চাপিয়ে রাখি, সেটি খুলতে খুলতে, কর্ণ ফের উৎকর্ণ করতেই টের পেলাম, বিমানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রন যন্ত্রটি চলার যে অতব মিহি গলার গুণ গুণ যে শব্দটি আছে, শুনতে পাচ্ছি না তা!

আসলেই তো, এসি তো বন্ধ! কখন বন্ধ করলো? আরে এটা একটা কথা হল নাকি? বিমান উড়তে পারছে না বলে, এসিও বন্ধ করে দিতে হবে নাকি? বিমানের যাত্রীদের প্রতি সাউদিয়ার এ কেমন নির্দয় আচরণ! ঢাকা থেকে রিয়াদগামী এই ফ্লাইটের বেশিরভাগ যাত্রী শ্রমিকশ্রেণির হওয়ার কারণেই কি এই আচরণ সাউদিয়ার পাইলটের এবং এটির বিমানখালাদের? নাহ, এদের বিমানখালা বলাও তো ঠিক না মনে হয়। কারণ বাংলার ছেলেমেয়েদের কাছে তো নাকি, ‘মায়ের থেকে ভালা, মায়ের বোন খালা।‘

মোবাইলের পর্দায় ভাসতে থাকা সময় নির্দেশক সংখ্যাগুলো এসময় চোখে পড়তেই হৃদয়ঙ্গম হল যে, নিশ্চল বিমানের পেটে আমাদের বন্দিদশায় এরই মধ্যে কেটে গেছে এক ঘণ্টারও কিছুটা বেশি সময়!

সাথে সাথেই সৌদি রাজধানী অভিমুখে আমার এই প্রথম যাত্রাটির গোড়াতেই গলদ হওয়ায়, মনের গভীরে ঘাপটি মেরে থাকা সংস্কার কুসংস্কারের কারণে যতো না খচ খচ করছিল মন এতক্ষণ, তারচেয়ে ঢের বেশিগুণ খিচড়ে গেল মেজাজ!

কথাতো ঠিকই বলছে হৈ চৈ করতে থাকা বিমানভর্তি সহযাত্রীদের নানানজন! শ্রমিক হওয়ার কারণে কাউকেই তো এরা কম দামে টিকিট দেয়নি। বরং আমাদের দেশী আদম ব্যাপারিদের নানান দুই নম্বরি ভুজং ভাজং টাউটারির খপ্পরে পড়ে, অনেকেই হয়তো অনেক বেশি দামেই কিনেছেন টিকিট। হ্যাঁ ঐ বাড়তি পয়সা, সাউদিয়ার পকেটে না গেলেও, তারা তো শ্রমিক বলে কোন টিকিট কম দামে দেয়নি আদমব্যাপারিকেও। আর কোনো এয়ারলাইন্স তো কোনো যাত্রীর পেশা ধরে ঠিক করবে না কার সাথে কী রকম ব্যবহার করতে হবে!

বিমানে উঠে পড়ার পর সবারই পরিচয় তো একটাই। তা হল যাত্রী। তবে হ্যাঁ, ফ্লাইটের ভেতরের আসনসমূহের যেহেতু নানান রকম বংশ থাকে, সে বংশলতিকা ধরে বিমান কর্তৃপক্ষ উচ্চবংশের সিটের যাত্রীদের বাড়তি আদরযত্ন ব্যবস্থা রাখলেও, সর্বহারাশ্রেণির সিটের যাত্রীদের জন্যও বিমান কর্মীদের ব্যবহারের তো একটা মিনিমাম আন্তর্জাতিক মান আছে। এখানে তো তার ছিটে ফোঁটাও দেখতে পাচ্ছি না! এ কেমন বিচার এদের?

ঘর্মাক্ত শরীরকে এরই মধ্যে জ্যাকেটমুক্ত করার পর আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে, বিমানখালাদের কাউকে দেখতে না পাওয়ায় হতাশ আমি বিরস বদনে তাই বসে পড়লাম ফের সিটে। বসার পর সিটের পিঠ পিঠ ঠেকাতেই, গরমের মাত্রা মনে হল আর বুঝি বেড়ে গেল!

তাতেই কেন জানি ইংরেজি বাদ দিয়ে প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা বাংলা কোন মাস এখন? এতো গরম লাগছে কেন? যতোই মনে করতে চেষ্টা করলাম বাংলা মাসই, সেটি মনে না পরে মগজে মননে সার্বক্ষণিক ঘুরতে থাকা ইংরেজি মাসের তারিখটাই মনে পড়ল। আজ তো হলো ২০০৯ সালের ভাষার মাসের ২৭ তারিখ। অন্য কোনো ইংরেজি মাসের তারিখের সাথে সহজে বাংলা তারিখের যোগসূত্র বের করতে না পারলেও, আমাদের ভাষা দিবসটি ২১শে ফেব্রুয়ারি হবে নাকি ৮ই ফাল্গুন হবে? এ নিয়ে যে বিতর্ক আছে সেটি মনে পড়তেই, দ্রুতই আন্দাজ করলাম, আজ হবে ফাল্‌গুনের খুব জোর ১৪/১৫ তারিখ।

যার মানে হলো, আছি বাঘ তাড়ানো মাঘের শীত থেকে যতোটা দূরে, আজ থেকে প্রায় একই দূরত্বে আছে চৈত্রের কাঠ ফাটা গরম। অথচ কি না আধা মাস পেছনে ফেলে আসা মাঘ নয় বরং আধা মাস সামনে থাকা চৈত্রই মনে হচ্ছে তার দুপুর বেলার গনগনে উনুন এখন তাক করে রেখেছে সোজা রানওয়েতে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বোয়িং এর দিকে! গরমটা সেরকমই অসহ্য মনে হচ্ছে তাই!

সাথে সাথেই খেয়াল হল আরো যে, এতো বড় বিশাল এই বোয়িং ৭৭৭ এ ফার্স্টক্লাস তো দূরের কথা বিজনেস ক্লাসই নাই। দুই দেশের রাজধানীর পথে যাতায়াত করা এই জাহাজের তুমুল সংখ্যাগরিষ্ঠ যাত্রীই শ্রমিক শ্রেণির হওয়ায়, সাউদিয়ার এই প্লেনে যে কোন বিজনেস ক্লাসও নেই, এ কথা অবশ্য জানতে পেরেছিলাম আমার অফিসের সহকারী কাছ থেকে প্রথম। দাপ্তরিক নিয়ম অনুযায়ি আমার জন্য নির্ধারিত বিজনেস টিকিট কাটতে গিয়ে সে যখন শুনেছিল, এতে আছে শুধু সর্বহারা শ্রেণি, তখন এর টিকিট না কেটে, জিজ্ঞেস করেছিল আমাকে যে এমিরেটসের টিকিট কাটবে কি না?

তার বয়ান শুনে তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম অফিসের নিয়ম অনুযায়ি কোনো রুটে সরাসরি ফ্লাইট থাকলে সেখানে ঘুর পথে যাওয়া যেহেতু মানা আমাদের। উত্তরে উনি আবার আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমার বস ইচ্ছা করলে আমাকে সেই বিশেষ অনুমতি দিতে পারেন। ঘণ্টা ছয়েকের এই ভ্রমণে বিজনেস ক্লাসের আরামের পাওয়ার চাইতে, বসের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি চাওয়াটা আমার পক্ষে ততোধিক বেআরামের ব্যাপার মনে হওয়ায়, হইনি রাজী সেসময় সে প্রস্তাবে ।

এখন মনে হচ্ছে, নাহ সহকারীর বুদ্ধি ধরে এমিরেটস নেওয়াই তো ভাল ছিল। সাথে সাথে এও মনে হল, আচ্ছা এই প্লেনে যদি বিজনেস ক্লাস থাকতো তাহলে তো এক ঢিলে দুই পাখি মরতো। একদিকে এই ফ্লাইটেই আমি যেমন বাড়তি আদর যত্ন পেতাম, তেমনি উচ্চ বংশীয় আসনের যাত্রীদের অসুবিধা করে, পাইলট কি এভাবে প্লেনের এয়ারকুলার বন্ধ করে দেবার সাহস করতো? নিশ্চয় করতো না। তাতে বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের বরাতে হলেও এখানকার সর্বহারা শ্রেণির যাত্রীদের এই গরমে ভুগতে হতো না এখন এভাবে! এছাড়া প্লেনের এয়ারকুলিং সিস্টেম তো একটাই মনে হয়।

অবশ্য এখন আর সেসব ভেবে তো লাভ নাই। তাই আর সকলের মতোই হাঁসফাঁস করা তীব্র এই গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরই মধ্যে সামনের সিটের পেছেনের পকেটে মজুদ এয়ারলাইন্স ম্যাগাজিনটি বের করে, বাতাস করতে লাগলাম নিজেকে, থেকে থেকে।

এভাবে আরো কিছুক্ষণ চারদিক থেকে ভেসে আসা নানান জনের নানান মাপের রাগ, বিরক্তি, হতাশা ইত্যাদি ঘোষণা করা নানান ধ্বনি যখন কানে সয়ে এসেছে, ঠিক এসময় তীব্র চিৎকার করে কেঁদে উঠলো একটা বাচ্চা। তাতে সিটে বসেই পেছন দিকে যতোটা পারা যায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আন্দাজ করলাম আছে বাচ্চাটা, বিমানের মাঝামাঝি জায়গার আইলের ডানের এক সিটে। এক ঝলকে পরিষ্কার এও দেখতে পেলাম যে, বাচ্চাটির মা প্রাণপণে ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু খুব একটা সফলকাম হচ্ছেন না।

কী জানি, কাঁদছে কী জন্য বাচ্চাটা? ওরও কি খিদে লেগেছে? নাকি এই অসহ্য গরমের কারণেই তার এই তীব্র প্রতিবাদ? বয়স কতো হবে বাচ্চাটার? খুব ছোট বাচ্চা হলে, খিদে লাগুক, কিম্বা গরম লাগুক প্রতিবাদের ভাষা তো তার একটাই। তা হল কান্না। অবশ্য ছোট বাচ্চারা অপরিচিত পরিবেশে ভয় পেয়ে তো কাঁদে। আবার কখনো কখনো ওরাতো অকারণ জেদেও কাঁদে! ঐ বাচ্চার কান্নার সূত্র ধরে মনে পড়লো, ঘরে রেখে আসা নিজের শিশু পুত্রদের কথাও। চিনচিন করে উঠলো বুক এতে।

তা সত্ত্বেও বন্ধ উড়োজাহাজের ভেতরের গুমোট আবহে তীব্র গরমের অস্বস্তি ভুলে থাকার জন্য, মনে করতে চেষ্টা করলাম পুত্রদের সাথের নানান মজার সময়ের কথা। প্রথম বিমানে উঠার পর ওরা কেঁদেছিল কি না, মনে করতে চেষ্টা করছি তাও? আচ্ছা ওরা প্রথম যখন বিমানে উঠেছিল সে সময় কি আমি ছিলাম ওদের সাথে? নাকি ওদের মায়ের সাথেই হয়েছিল তাদের প্রথম বিমান যাত্রা। মনে করতে পারছি না কেন? মানে মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবার পুত্রদের নিয়েই।

ওরে বাবারে, আমার বাবার কী হইছে!”

লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমৃত্যু পথযাত্রী
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ