এক যাত্রার পৃথক ফল
বিমানে উঠার প্রস্তুতিলগ্নে, মানে বোর্ডিং ব্রিজে থাকতেই টের পেয়েছিলাম, রিয়াদগামী ভোমা ঘরানার এই বোয়িংয়ের অধিকাংশ যাত্রীই হলেন শ্রমিক শ্রেণির। এনাদের মধ্যে অনেকেই আবার আছেন, যাচ্ছেন যারা এই প্রথম; একদম অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে তেলের উপরে ভাসমান মরুতে সোনার হরিণ ধরার আশায়! ধরেই নিয়েছিলাম তাই যে, কাপ্তেন সাহেব আকাশে বিমান উড়াতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে উড়ান বাদ দেবার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন আরবি ও ইংরেজিতে, তা এনাদের কেউই বুঝতে পারবেন না। আমি নিজেও তো আরবিতে যে কী বয়ান এসেছিল ককপিট থেকে, মাথা মুণ্ডু তার বুঝিনি কিছুই। এমনকি আরবি একসেন্টের যে ইংরেজি ঘোষণাটি এসেছিল কাপ্তেন সাহেবের মুখ থেকে, তাও বুঝতে হয়েছে আমাকে বেশ ধ্বস্তাধস্তি করেই।
‘বিমান থামল কেন?’
এ প্রশ্ন তুলে বিমানের নানান সিটের নানান কণ্ঠ থেকে হতাশা, অনিশ্চয়তা, আশংকা, উদ্বেগ ইত্যাদি ইত্যাদি নানান সুরের ও স্বরের ভুটভাট উত্তেজনা হয়ে এরই মধ্যে গুলজার করে ফেলেছে বিমানের ভেতরটা। সাথে মসলা হিসাবে যোগ হয়েছে বাংলার নানান অঞ্চলের উচ্চারণ আর বাকভঙ্গির বাকস্ফুরণ। তো এই উত্তজেনা সামলানোর জন্য, বাংলায় না হলেও বোধগম্য ইংরেজি ভাষার সাথে শরীরী ভাষা মিলিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করার একান্ত দায়িত্ব যাদের, দেখা যাচ্ছে না সেই বিমানবালাদের কাউকেও। আগেই বলেছি বিমানে ওঠার পর থেকেই গোমড়া মুখে বিমানজুড়ে ঘুরে বেড়ানো প্রায় মধ্যবয়সী এই বিমানবালাদের চলাফেরায় বেশ রুঢ় আর ড্যাম কেয়ার ভাব লক্ষ করেছিলাম! বিমানভর্তি আমাদের এই শ্রমিক ভাই সকলকে তারা যাত্রী হিসেবে মোটেই গোনায় ধরছিল বলে মনে হচ্ছিল না শুরু থেকেই। স্বভাবতই মেজাজ তাই ভীষণ খিঁচড়ে ছিল সেই থেকে। এখন বিমান একদম থেমে যাবার পরও যখন তারা যাত্রীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে আশ্বস্ত করার বদলে, বসে আছে সম্ভবত নিজ নিজ আসনে, তাতে যাকে বলে একদম মেজাজ হারাতে বসেছিলাম যখন, ঠিক তখনই পাশে বসে থাকা সহসিটযাত্রীদ্বয়ের একদম পাশের জন জিজ্ঞেস করলেন
‘ছার, বিমান উরলো না ক্যান? যাইব না আইজ বিমান?”
ব্যাপারটা তাদের বুঝিয়ে বলতেই, তাদের হাহাকার প্রশ্ন
‘তাইলে ছার এখন কী অইবো?’
বললাম, নিশ্চয় এখন বিমানের কি গড়বড় হয়েছে তা বের করে ঠিক করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার ডেকে আনা হবে। তারপর তা ঠিক হলে, বিমান উড়বে আকাশে। আর এটা তো ভালই হইছে যে, মাটিতে থাকতেই পাইলটেরা কিছু একটা গড়বড় যে আছে বিমানে, তা টের পাইছনে। আকাশে উড়ার পর যদি এই গড়বড় দেখা দিত তাইলে কি হইত কন তো?
নাহ আমার এই গুরুতর প্রশ্নটি তাদের দুজনের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেনি মোটেও। বরং দুজনের মধ্যে ঠিক আমার পাশে যিনি বসেছেন, তিনি সম্ভবত বেশ বহির্মুখী চরিত্রের হওয়ায়, জিজ্ঞেস করলেন ফের ‘ছার, তাইলে কী খাওন দিবো এখন? হেই সকালে যখন আইছিলাম এয়ারপোর্টে, একটু চা বিস্কুট খাইছিলাম তহন। তারপরের তন এখন পর্যন্ত তো খাই নাই কিছু। খুব ভুখ লাগছে?’
‘বলেন কী? সকাল কয়টায় আইছিলেন এয়ারপোর্টে? প্লেন তো ছাড়ার কথা দুপুরে। অতো আগে আইছিলেন ক্যান?’
অতপর দুই সহসিটযাত্রীর বয়ান থেকে বুঝতে পারলাম, যে আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে যাচ্ছেন দু’জন সৌদিতে প্রথমবারের মতো, সেই লোক তাদেরকে একদম সকাল ৮ টার মধ্যে ঢাকা এয়ারপোর্টে থাকতে বলেছিল। সে কথা মতো মিরেসরাইয়ের কোন এক গ্রাম থেকে, তারা আগেরদিনের মধ্যরাতে নাইট কোচ ধরে ঢাকায় এসে কাক ভোরে পৌঁছেই, বাস স্ট্যান্ড থেকে সাথে সাথে রওয়ানা করে আটটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। দুজনেই মনে করেছিলেন, এয়ারপোর্টে পৌঁছলেই তাদের সেই ম্যানপাওয়ারের লোক তাদের প্লেনে তুলে দেবে সাথে সাথেই! আর প্লেনে উঠলেই তো খাওয়ার পাওয়া যাবেই মুফতে!
কিন্তু দেখা গেল সেই লোক কিনা ১১ টার দিকে এয়ারপোর্টে এসে তাদের হাতে প্লেনের টিকিট, পাসপোর্ট আর কাগজপত্র ধরিয়ে, তড়িঘড়ি করে এয়ারপোর্টে ঢুকে যাবার জন্য ঠেলে দিয়ে চলে গেছে। এয়ারপোর্টে তারপর নানান জনকে জিজ্ঞেস করে করে তারা শেষ পর্যন্ত উঠতে পেরেছিল এই প্লেনে। সঠিক প্লেনের সঠিক দিশা করতে গিয়ে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি, ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে নানান জনের দেয়া নানান হুজ্জত হাঙ্গামা শেষ করে প্লেন পর্যন্ত আসার আগে, একটু সুযোগ পেয়ে যখন কিছু খেয়ে নেবেন ভেবেছিলেন এয়ারপোর্টে খাবারের দোকান থেকে, খাবারের আগুন দাম দেখে তারা আর সাহস করেননি। কারণ প্লেনে উঠার কিছু পরই যে দারুন সব খাবার দেওয়া হয় মুফতে, তা তো তাদের জানাই আছে!
বেচারাদের এই বিত্তান্ত শুনে প্রথমে তীব্র রাগ হয়েছিল ঐ আদম ব্যাপারী কোম্পানির লোকের উপর, বেচারাদের এইভাবে অকারণে ভোর সকালে এয়ারপোর্টে আসতে বলে দুর্ভোগে ফেলার জন্য। তারপর মেজাজ হারিয়েছিলাম এয়ারপোর্টে তাদের কে নানান দিগদারী দেওয়া ঐ সব কর্মীদের উপর। কিন্তু সেইসব টাউটেরা তো সামনে নাই। অতএব রাগ কমানোর উপায় হিসেবে, ঝেড়ে তার উদ্দ্যেশ্যে গজগজ করে নিজের ঝাল মিটাচ্ছি যখন, তখন ফের প্রশ্ন এলো
‘ছার, দিব কি খাওন এখন?’
কী দেই উত্তর তাদের বুঝতে পারছি না? অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ফ্লাইটে যাত্রী তোলার আগেই মানে যাত্রীরা এয়ারপোর্টে থাকতে থাকতে যদি ফ্লাইট কোন কারণে বিলম্বে যাত্রা করবে বলে ঘোষণা করে, সেক্ষত্রে এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের হাতে খাবারের প্যাকেট বাঁ কূপন দেয় এয়ারপোর্টেই। কিন্তু এরকম প্লেনে উঠে যাবার পর, যদি বিলম্বিত হয় যাত্রা, তবে তারা যে কী করে? তা তো জানি না। এছাড়া এও তো জানি না যে, এই প্লেনের গড়বড় ঠিক করে রওয়ানা করতে আসলে কতোটা দেরী হবে? বেশি দেরী হলে কি তারা, ঘড়ির সময় ধরে যে সময় খাবার সার্ভ করার কথা ছিল প্লেন আকাশে উড়ার পর, ঐ সময়েই দেবে খাবার? যদি তা হয়, তবে তো অচিরেই দিয়ে দেবার কথা তা।
কারণ প্লেন যদি তখন টেক অফ করতে পারত সময়মত, তাহলে তো এরই মধ্যে মধ্য আকাশে প্লেনের ভেতর খাবার বিতরণ শুরু হতো। কিন্তু জানি না তো নিশ্চিত এ ব্যাপারে ফ্লাইটের প্রটোকল কী?
ফলে এ ব্যাপারে নিজের অজ্ঞতাটি তাদের কাছে প্রকাশ করতেই মনে হল, বেচারারা বেশ নিরাশই হলো। তারপর ছাড়লেন না হাল আমার পাশের জন। বললেন
‘ছার, ম্যাডামগরে একটু জিগান না, দিব কি না খাওন, এহন?”
এই অনুরোধ আসতেই ভাবলাম, কোন বিমানবালা হয়তো দয়া করে অবশেষে তশরিফ রেখেছেন এদিকটায়। অতএব তার অবস্থান নির্ণয় করার জন্য ঘাড় ঘোরালাম। কিন্তু নাহ তাদের কারো টিকিটিরও দেখা পেলাম না। এসত্ত্বেও সহসিটযাত্রীদ্বয়কে সান্তনা দিয়ে বললাম, যে মাত্রই দেখা মিলবে তাদের কারো, অবশ্যই বলবো তাদেরকে খাবার দেওয়ার জন্য। বেশ আশ্বস্ত হলেন দুজনেই মনে হল আমার এই আশ্বাসে! তাদের এই আশ্বস্ত চেহারা দেখে মনে হল, হায়রে একই সময়ে, একই বিমানের পাশাপাশি সিটে বসে আছি তিনজন আমরা, গন্তব্যও আমাদের একই। অথচ আমাদের প্রয়োজন আর চিন্তা, কী রকম ভিন্নমুখী! যখন আমি কী না চিন্তা করছি, প্লেনের গড়বড় উড়ার আগেই ধরা পড়ায় বরং ভাল হল, বিরাট একটা সম্ভাব্য ফাঁড়া কাটল তাতে। সেই একই বিমানে একই ঘটনার মুখোমুখি হওয়া, আমার সহযাত্রীদের সেই সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে দেখছি মোটেও চিন্তা নাই। আছেন তারা কি না পেটের চিন্তায়! আচ্ছা বয়স হব কতো এই দুজনের? এ ভেবে জানালার ওপাশে তাকাচ্ছি এমন ভাব করে দুজনের চেহারা আর শারীরিক গঠন দেখে আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম।
নাহ সঠিক বয়স আন্দাজ করতে পারছি না। জানি আমরা যারা তুলনামূলকভাবে সৌভাগ্যবান ও থাকি শহরে, তাদের তুলনায় একই বয়সে গ্রামে থাকেন এমন কেউ এবং যিনি যাপিত জীবনে নানান টানা পোড়েনের সাথে যুদ্ধ করেন যারা অষ্টপ্রহর, তাদেরকে অনেক বেশি বয়সের মনে হয়। তারপরও আন্দাজ করছি একজন হয়তো আমারই বয়সী, অন্যজন কিছুটা হবেন ছোটই বয়সে।
যার মানে হচ্ছে, আমি যেমন ঘরে বউ বাচ্চা রেখে এসেছি, এনাদেরও তাই হয়েছে। এমতাবস্থায় আমি যখন নিজ ও বউ বাচ্চা পরিবারের নিরাপত্তার খাতিরে প্লেনের এই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে মনে মনে ভয়ে ছিলাম বা আছি এখনো, সে জায়গায় তাদের চিন্তা নিবদ্ধ শুধু পেটের ক্ষুধার!
এ কথা মনে হতেই মনে পড়লো, আম্রিকান বিখ্যাত মনোবিদ আব্রাহাম মাশলোর বিখ্যাত নিড হায়েরারকি থিউরির কথা। যেই থিউরি মতে, সামাজিক মানুষের প্রয়োজন নির্ধারিত হয় তার আর্থ সামাজিক অবস্থার উপর। একজন দরিদ্রলোকের জীবনযুদ্ধের বেশির ভাগটাই ব্যয় হয় তার শারীরবৃত্তিয় প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে, মানে খাদ্য যোগাড় করতে গিয়ে। যখন সেই লোকটি তার আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে, তখন শারীরবৃত্তিয় প্রয়োজন নিয়ে তাকে আর ভাবিত হতে হয় না। সে তখন জীবনযুদ্ধে নামে নিজ ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এভাবে যতোই কারো আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটে, ততোই বদলাতে থাকে তার প্রয়োজন।
বড়ই চমৎকৃত হলাম মাশলোর সেই থিউরির এরকম একটা বাস্তব প্রমাণ এই মুহূর্তে চাক্ষুষ করতে পেরে। বলাই বাহুল্য যদিও আমি ও আমার সহসিটযাত্রীরা বসে আছি একই উড়োজাহাজের সিটের একই পঙক্তিতে, আমদের আর্থ সামাজিক অবস্থা অবশ্যই ভিন্ন। ঐ দুজনের তুলনায় ঢের বেশি সৌভাগ্যবান আমি, বাসা থেকে মোটামুটি খেয়ে দেয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলাম প্লেন ছাড়ার ঘণ্টা চারেক আগে। এয়ারপোর্টে এসে ঝটপট বিমানে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ শেষ করে, বাকি সময়টা কাটিয়েছি লাউঞ্জে। যেখানে ফের আমি খেয়েছি টুকটাক করে নানান কিছু। অতএব এই প্লেনে যদি আজ দুপুরের খাবার নাও দেয়, তাতেও আমার কিছু যায় আসে না। সে জায়গায় আমার দুই সহসিটযাত্রীর এ ক্ষণের যাবতীয় ভাবনা স্বভাবতই ঘুরপাক খাচ্ছে ক্ষুধা নিবারণকে ঘিরেই।
আবার সেটাই ভাবছি কেন শুধু? এই যে একই প্লেনে একই গন্তব্যে যাচ্ছি আমরা তিনজন, আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু একদমই ভিন্ন। তারা দুইজন যখন অবশ্যই যাচ্ছেন এই অচেনা মরুতে শুধু নিজের আর পরিবার পরিজনের জন্য দু বেলা ভালো খাবার নিশ্চিত করার সাথে, রোগ ব্যাধি থেকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য; সে জায়গায় আমিতো যাচ্ছি নিজের সামাজিক মান, মানে যাকে বলে স্ট্যাটাস তার উন্নতি ঘটানোর জন্য!
আমাদের সমাজে, পেশাগতভাবে কারো যদি ভিনদেশে পোস্টিং হয়, তাতে তো তার যেমন বাড়ে সামাজিক মর্যাদা, তেমনি বাড়ে তা তার পরিবারের। আমার এই যাত্রার উদ্দেশ্য তো হল আগামী তিন বছরের জন্য আমার নিয়োগকর্তা যে আমাকে এই মরুতে পাঠাতে চাইছেন বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য তারই প্রাথমিক ধাপ। যেটি একদিকে আমাকে দিয়েছে সমাজে উচ্চতর স্ট্যাটাস, তেমনি জানি বিলক্ষণ, এ হল পেশাগতভাবে সর্বোচ্চ পদের দিকে এগিয়ে যাবার নিশ্চিত সোপানও! অর্থাৎ যাত্রা আমাদের একই হলেও, ফল আমাদের অবশ্যই পৃথক!
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।