বিরাট এই হল ঘরটার নানান জায়গায় বসানো ভাস্কর্য আর এর ছিমছাম সৌন্দর্যে যাকে বলে চোখ জুড়িয়ে, মন ভরে যেতেই, মনে মনে আবারো স্বীকার করতেই হল ছোটপুত্রের মননের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য বোধের ব্যাপারটিও, প্রকাশিত করেছে একটু আগে ও যা, ‘ওয়াও হাউ বিউটিফুল’ এই বাক্যটি আনমনে উচ্চারণ করে।
এদিকে ততোক্ষণে সকলের গা গরম হয়ে উঠার সাথে প্রথমদিককার মুগ্ধতার ধাক্কা কেটে যেতেই, ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সবাই ফের নানান ভাস্কর্যের আশেপাশে দাঁড়িয়ে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তোলাতুলি নিয়ে। ওদের এই ছবি তোলাতুলির হুজ্জতে নিজে যোগ না দিয়ে, দু চোখে গভীরভাবে গোটা হল ঘরটা জরীপ করে বুঝতে চাইলাম ঠিক কোন জায়গায় আছে এর টিকিট ঘর? কিন্তু না কোন টিকিট ঘরের টিকিটিরও দেখা পেলাম না বৃহদাকার এই হল ঘরটির কোনদিকেই। যদিও এই হলে ঘরের ডান আর বাঁয় দিকের শেষ মাথার মাঝামাঝি আংশের দিকে দুটো করিডোর দেখা যাচ্ছে, কিন্তু জানি না তো সেই করিডোর দিয়ে গেলে দেখা মেলে কি না টিকিট ঘরের। থাকেও যদি ঐ করিডোর দুটোর কোন একটার ভেতর তা তবে আছে সেটা কোন দিকটায়? করিডোরের ঢোকার মুখের দেয়ালে পিতলের পাত বসিয়ে চায়নিজে কিছু যে লেখা আছে তাও দেখতে পাচ্ছি। সেই চায়নিজ লেখার নিচে সম্ভবত আছে ইংরেজি বয়ানও। কিন্তু কি যে লেখা আছে তা তো পড়তে পারছি না এখান থেকে। তবে করিডোর গুলোর হাবেভাবে, না বলা উচিৎ ডিজাইনে মনে হচ্ছে ওগুলো হচ্ছে আসলে মূল যাদুঘরে ঢোকার প্রবেশদ্বার। অতএব ওখানে টিকিট ঘর থাকার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
তবে কি এই জাদুঘর দেখা যাবে মুফতেই না কি? বাহ তা হলে তো খুবই ভাল, বেঁচে গেল পকেটের কড়কড়া কিছু রেন মেন বি! ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে অতিপাকা চায়নিজদের এতো দেখছি এক দারুণ বদান্যতা। অবশ্য যাদুঘরের ব্যাপারে একই রকম বদান্যতা দেখেছি বেনিয়া ব্রিটিশদের ক্ষেত্রেও। লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ম দেখতেও গুনতে হয় না কোন পাউন্ড বা স্টার্লিং, যা নাকি খুবই ভাল লেগেছিল। অবশ্য এটাও ঠিক যে বৃটিশ মিউজিয়ামে টিকিট কেটে যদি ঢুকে দেখতে হতো কোহিনূর সহ আমাদের ভারতবর্ষ থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া আমাদেরই জিনিশপত্র তবে তাতে যে শুধু দুঃখই হতো, তা না। হতো তুমুল ক্রোধও। সেদিক থেকে বেনিয়া ব্রিটিশরা বুদ্ধি ভালই করেছে, চোরাই জিনিষ দিয়ে মিউজিয়াম বানিয়ে সেটা দিয়েও আবার ব্যবসা করার নতুন ফন্দি আঁটেনি ওরা। এ বাহবা টুকু ওদের দিতেই হয়।
কিন্তু কথা হচ্ছে, চায়নার সব কিছুই তো হয় বিশাল বিশাল। সে হিসাবেও এবং এই হলে ঘরে ঢুকেও আঁচ করতে পারছি যে, এই যাদুঘরও অবশ্যই একটা হুলস্থুল মার্কা ব্যাপারই হবে। কত হাজার, না হাজার বলা ঠিক হবে না, বলতে হবে লাখ লাখ এমনকি হতে পারে মিলিয়ন প্রাচীন সংগ্রহ আছে এখানে তা তো জানি না। এতসব জিনিষ ঠিকঠাক মতো দেখতে গেলে তো দু তিন সপ্তাহ এমন কি মাসও লেগে যেতে পারে। মানে বলছিলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, প্রতিটি না হলেও অন্তত যে সমস্ত পুরাকীর্তি বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করবে ওসব যদি খুঁটিয়ে দেখে, আর তার সাথে যদি থাকে সাঁটানো ওটির সম্পর্কে নানা তথ্য এবং সেগুলো যদি থাকে ইংরেজিতে লেখা, তবে সেসব পড়ে বুঝে দেখার কথা বলছি আর কি । যদিও জানি ওভাবে দেখতে গেলে তাতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে পরিবারের বাকীদের, তারপর সব কিছু না হলেও কিছু জিনিষ তো ওরকম ভাবেই দেখতে চাই। অথচ সময় কি আছে হাতে অতো?
এ ভাবনা মাথায় আসতেই পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখি তার পর্দা ঘোষণা করছে, সময় এখন দুপুর ১২ তা বেজে ৭। সাথে সাথেই এই মিউজিয়ম দেখার জন্য নিজ মনেই বরাদ্দ করলাম দুই ঘণ্টা। এ করতেই মনের ভেতরের সেই দ্বিতীয় জন বলে উঠলো আরে দূর, দুই ঘণ্টায় মিউজিয়মের কি ঘণ্টাটা দেখবে আর? খুব জোর একটা চক্কর দিতে পার। আর সেই চক্কর দেয়াটাকেই যদি বল মিউজিয়ম দেখা তবে আমার আর কথা নেই।
এ কথার উত্তরে সাথে সাথে প্রথমজন বলে উঠল, আরে শোন সারা পৃথিবীর সব সাধারন মানুষই এভাবেই যাদুঘর দেখে। আর যে কোন মিউজিয়মে গেলেই তো তুমি এ কথাটার অবতারণা কর সবসময়। আরে মিয়া তুমি কোন জায়গার কোন মহামতি আরকিওলজিস্ট নাকি নৃবিজ্ঞানী নাকি গবেষক যে তোমাকে ওরকম ভাবে ওটা দেখতে হবে। গবেষণাপত্র লিখবে নাকি তুমি?
নাহ, নিজের ভেতরের ঐ দুই চীরবৈরি অহি নকুলের কথায় কান দিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। মিউজিয়ম দেখার জন্য বরাদ্দ করা দুই ঘণ্টার মধ্যে খরচ হয়ে গেছে এরই মধ্যে মিনিট দুয়েক। তিলার্ধ সময় আর নষ্ট করা যাবে না । ফলে ছবি তোলাতুলিতে ব্যস্ত পরিবারের বাকীদের ডেকে একাট্টা করে আগ পিছু আর কিছু না ভেবে ধরলাম হাঁটা ডান দিকের করিডোরের দিকেই।
করিডোরের মুখেএসেই দেয়ালে চায়নিজ লেখার নীচে লিখে রাখা ইংরেজি বয়ান পড়ে বুঝলাম প্রবেশ করতে যাচ্ছি অচিরেই প্রাচীন চীনে। সাথে সাথেই মনে হলো, দেখা শুরু করবো কিভাবে? মানে প্রথমেই যে ঘরটি পাব সেটি দেখে পড়ে ক্রমশ যাবো গভীরে, নাকি আগে এই যাদুঘরের গভীরে গিয়ে সব শেষের ঘরটিতে গিয়ে ঐটি দেখে ক্রমশ এগুতে থাকবো সামনের দিকে। এমত দ্বন্দ নিয়ে মনের ভেতরের দুজন আবার যাতে নতুন করে তর্কবিতর্ক শুরুর করার সুযোগ না পায়, সেই কথা চিন্তা করে স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম যে নাহ আগে যাবো যাদুঘরের গভীরেই।
“বাবা বাবা এই যে একটা সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। আমরা কি উপরে যাবো আগে না কি নীচ তলা থেকেই দেখে উপরে উঠবো?” একটু আগে নিয়ে ফেলা সিদ্ধান্তটি এবার মুখোমুখি হল নতুন দ্বন্দের, দীপ্রর করা এই প্রশ্নে।
তৎক্ষণাৎ ফের আগ পাছ কিছু চিন্তা না করেই বললাম চলো উঠা যাক উপরে। তবে কতো উপরে যে উঠবো তা তো জানি না। আর এই মিউজিয়মের সর্বমোট ক’টা তলা আছে উপরে বা নীচে মানে ভূগর্ভে সেটাই তো জানি না। নাহ ব্যাপারটা ঠিক হয়নি। গতরাতে ঘুমানোর আগে একটু গুগলিং করে এই যাদুঘরের ব্যাপারে আবছা হলেও একটু খোঁজ খবর নিয়ে আসা উচিৎ ছিল । সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে এ কথা ভাবতেই মনের সেই দ্বিতীয় জন টিটকারি মার্কা হাসিতে বলে উঠলো, আরে দূর, তুমি তো জানতেই না এই কিছুক্ষন আগেও যে, তিয়েন আন মেন স্কয়ারে আছে এই যাদুঘর। তা হলে কি আর প্লান করতে গত রাতে? আর গুগলিংই বা করতে কেমনে? এ ক’দিনেও কি তোমার এ শিক্ষা হয়নি যে, চায়না আম্রিকান গুগল সাহেবকে সর্বত্র বিচরণ করতে দেয় না তাদের এই ভূখণ্ডে।
‘উহ! নাহ এখনি আর উপরে উঠতে পারবো না।’ একটানা সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতালায় ওঠার পর পায়ের ব্যথা সঙ্গী করে ভ্রমণ করতে আসা লাজু এ ঘোষণা দিতেই, তার সাথে গলা মেলাল হেলেনও
অতএব দ্বিরুক্তি না করে, বললাম চলো তাহলে এখান থেকে শুরু হউক আমাদের মিউজিয়ম দেখা। মুখ থেকে এ ঘোষণা বেরুতে না বেরুতেই দু পুত্র দিল দৌড় ডান দিকের প্রথম ঘরটির খোলা দরজার দিকে।
ওদের অনুসরণ করে পা বাড়াতেই দেখি, পুত্রদ্বয় ঐ খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে না ঢুকে, দরজার সামনেই ব্রেক কষে থেমে তাকালো এইদিকে-“কি ব্যাপার ?” গলা সামান্য উঁচু করে জিজ্ঞেস করতেই জবাব এলো
“এটা তো অফিস। মিউজিয়ম না” গলায় কিছুটা হতাশা দীপ্রর -তা হলে সামনে এগোও বলতে বলতে সেই দরজার সামনে এসে ওদের পিছু দাঁড়িয়ে ভেতরে চোখ ফেলতেই দেখি, খুব বড় নয় ছোটখাট এ কক্ষটি আসলে এই যাদুঘরের কোন একটা অফিসই হবে, যার ভেতরে এ মুহূর্তে জনা দুই চায়নিজ একমনে কাজ করছে নিজ নিজ ডেস্কের কম্পিউটাররে পর্দায় চোখ রেখে। বাকী আর তিনটা ওয়ার্কস্টেশন ফাঁকা।
সদলবলে সেই করিডোর ধরে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই পেলাম দ্বিতীয় ঘরটি। এরও দরজা খোলা, তবে দরজার একটু ভেতরেই স্ট্যান্ডের উপরে লাগানো টানা লালফিতা দেখে বোঝা গেল ঢোকা যাবে না এ ঘরে। বাইরে থেকেই চোখ বুলিয়ে ধারনা করলাম এটা কোন মিটিং বা সেমিনার রুমটুম হবে, যেহেতু এর ভেতরে ক্লাসরুম স্টাইলে পাতা আছে বেশ অনেকগুলো চেয়ার।
নাহ আর সামনে এগুনো যাবে না এই করিডোর ধরে , কারণ সামনের রুম গুলোর দরজা যে বন্ধ তা এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের থেকে মিটার দশেক দূরে করিডোরের প্রস্থ বরাবর এ মাথা ও মাথা টানা আছে দুই পিতলের স্ট্যান্ডের উপর সেই রকম লাল ফিতা যেমন দেখেছিলাম একটু আগে গ্রেট হলে।
ঘুরে ফের সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিতে দিতে ভাবছি, এখন কি যাবো উপরে না কি নীচে। এই এক তলা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কপাল তো গেল ফাক্কা। এখন যদি আরো একতলা উপরে উঠে দেখি ওখানেও আছে শুধু যাদুঘরের অফিস আদালত আর মিটিং সেমিনার রুম, আর সে অংশ হল দর্শনার্থীদের অগম্য, তাহলে উপরে উঠাটাই শুধু সার হবে না, নষ্ট হবে যাদুঘর দেখা বা ঘোরার জন্য মনে মনে বরাদ্দ করা দু ঘণ্টা থেকে আর কিছু মুল্যবান মিনিট। সেটা করবো? না কি নীচে যাব নীচতলায়? আসার সময়তো দেখেই এসেছি যে নীচের ঘরগুলোতে চায়নিজ নানান রাজ বংশের সময়কাল ধরে ঐ রুমগুলো সাজানো হয়েছে। যার মানে হল নিশ্চয় ওখানে ঐ রাজবংশের সময়কালের নানান পুরাকীর্তি আছে।
“আচ্ছা, না জেনে শুনে এভাবে ঘোরার কি মানে আছে?” মনে ভেতরের আশংকার ছাইচাপা আগুনকে উস্কে দিয়ে বলে উঠল লাজু এসময়-সে কথার কোন জবাব না দিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে সবার দিকে ফিরে উপরে যাব না কি নীচে যাবো এ ব্যাপারে একটা গণভোটের ঘোষণা দিয়ে বললাম, ঠিক আছে এবার তোমরাই বলো উপরে যাব, নাকি নীচে। আমি তো এখানে আগে আসিনি, তাই জানব কিভাবে কোন তলায় কি আছে? গাইড যদি পেতাম সেই স্টোন ফরেস্টের রঙ্গিলা খালার মতো কাউকে, তা হলে না হয় নিয়ে নিতাম তাকে। কিন্তু সে রকম কাউকেও তো দেখিনি এখানে।
“আরে এসেছিই যখন দোতালায় তিন তলাটাও না হয় একটু দেখে যাই। কিছু না থাকলে ওখানে সাথে সাথেই না হয় নীচে নেমে যাব” মত দিল হেলেন-“লিফট নাই এই এখানে “ ননদের কথার পিঠে বলে উঠল ভাবি-“না বাবা আমি লিফটে উঠবো না এখানে” কুনমিং এর হোটেলের লিফটবিভ্রাটের স্মৃতি যে এখনও ভোলেনি অভ্র, আর হোটেলে বাধ্য হয়ে লিফটে উঠলেও এখানে হাতের কাছে সিঁড়ি থাকার পরও লিফটে ওঠে আটকা পড়ার ঝুকি যে ও নিতে চায় না বুঝলাম তার কথায়।
নিশ্চয় আছে লিফট এখানে। না থেকে যায়ই না। এত্তোবড় একটা বিল্ডিং বানিয়েছে লিফট ছাড়া এ তো হতেই পারে না। কিন্তু কোথায় যে আছে তা তো জানি না। বলতে বলতে লিফটের খোঁজে এই সিঁড়ির বা দিকের করিডোরের দিকে সবাইকে নিয়ে এগুবো কি না ভাবতেই-সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে হেলেন বলল, “আরে চল এই এক তলা উপরে উঠেই দেখি না।“ সাথে সাথে অনুগামী হল দুই ভ্রাতুষ্পুত্র। চোখের সামনে এভাবে গণভোটের ফলাফল পরিষ্কার হয়ে যেতেই, আর দ্বিরুক্তি না করে লাজুও রাখলো পা সিঁড়িতে। গন্তব্য তৃতীয় তলা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক











