দোকান থেকে বেরিয়ে কাউকেই আর অন্য কোন দোকানে যাবার বায়না ধরার সুযোগ না দেবার মানসে বলা চলে সবাইকে অনেকটা তাড়া দিয়ে অতি দ্রুতই শপিং মল চত্বর থেকে বেরিয়ে আসলাম উঠে মূল সড়কপাড়ের ফুটপাতে। ইতিমধ্যেই লাজু আর হেলেনের ভাবভঙ্গি আর কথাবার্তায় বোঝা গেছে, এই শেষ বেলায় একখানা দুইখানা নয় গুণ গুনে আটখানা শাল কিনতে পেরে আনন্দে তারা আটখানা। শুধু তাই নয় তাদের ধারণা এগুলো আসলে অতীব উমদা প্রকৃতির কাশ্মীরী আর পশমিনা মানে একদম আসলের কাছাকাছি! তদুপরি ডিজাইনও এগুলোর নাকি বিরল প্রকৃতির!
একবার ভাবলাম বলি, যে দামে কেনা হয়েছে চায়নার এই তথাকথিত কাশ্মীর আর পশমিনা এসবের মান মোটেই যে ভালো নয়, তার প্রমাণ নিশ্চয় তারা হাতে হাতে পাবে কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু তা বলার আগেই ঐ ‘নো লেত’ দোকানে দামাদামি করতে গিয়ে আমার গোহারার ব্যাপারে অনিবার্য খোঁচাটি এলো যথারীতি স্ত্রীর শ্রীমুখ থেকে। তাই আর ঐ পথ মারালাম না। কী দরকার অযথা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার। দুজনেই যেহেতু মনে হচ্ছে সারাদিন আর যাই কেনাকাঁটা করে থাকুক না কেন, শেষ বেলার এই কেনাকাটা নিয়ে বড়ই আত্মতৃপ্তিতে আছে।
যদিও জানি না নিশ্চিত কী কী কিনেছে ওরা, তবে তাদের হাতের প্যাকেট দেখে নিশ্চিত বলা যায় যে জুতা আর ব্যাগ কিনেছে দুজনেই আরো। এর বাদে টুকটাক আর কী কী যে কিনেছে ওরা, সেসব নিয়ে কোনও ধারণা নেই। তবে এই মুহূর্তে তাদের এই শাল কেনা নিয়ে তুমুল আত্মতৃপ্তিতে বুঝতে পারছি যে, উপমহাদেশীয় মেয়েদের পোশাক টোশাক না হলেও, থান কাপড় জাতীয় কিছু কেনার ইচ্ছা হয়তো তাদের ছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা তাদের যে কোনও কারণেই হোক পূরণ না হওয়াতে মনে কিছুটা খেদ ছিল, যা নাকি মিটিয়েছে এই শাল! মোটামুটি অযাচিতভাবেই শেষ মুহূর্তে এগুলো হাতের নাগালে পাওয়ার অতি আনন্দে আট টা শালই কি তারা নিজেদের জন্যই নিয়েছে, তাদের নানান রঙ্গয়ের ড্রেসের সাথে ম্যাচ করে পরার জন্য? নাকি এ থেকে নিজেদের জন্য এক দুটো রেখে বাকিগুলো যাবে উপহারে? দু’জনে কি তবে চারটা চারটা করেই কিনল নাকি?
আচ্ছা চায়নিজ নারীরাও কি আমাদের দেশের নারীদের মতোই এই শালগুলো ব্যবহার করে? নাকি এ এরা বানিয়েছে শুধু উপমহাদেশের ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে? হুম তা তো তারা করতেই পারে। কিন্তু তাহলে তো বেইজিং শহরের এই ডাউন টাউন এলাকার শপিং মলে এসব এতো পরিমাণে পাওয়া যাওয়ার কথা না, দেখলাম যতো ঐ দোকানে। এদিকটায় এ ক’দিনে উপমহাদেশীয় ক্রেতাতো দূরের কথা বিদেশিই বা দেখেছি ক’টা? অতএব ধরেই নেয়া যায়, এই শাল চায়নিজ নারীরাও ব্যবহার করে হরহামেশাই। জিন্স টপস স্কার্টে অভ্যস্ত পশ্চিমা রমণীদেরও তো দেখেছি শরীরের উর্ধ্বাঙ্গে শাল জড়াতে।
এসময় আরকেটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, তা হল আজকালকার বৈশ্বিক বিশ্বে পুরুষদের ফর্মাল পোশাক প্রায় একই রকম হয়ে উঠলেও, নারীদের পোশাকে এখনো রয়ে গেছে যার যার তার তার সংস্কৃতির ছাপ। ব্যতিক্রম শুধু তাদের অন্তর্বাস। ওইগুলো এক্কেবারে একই রকম হয়ে উঠেছে সকলের ক্ষেত্রেই। ফলে আছে ওগুলোর এখন নানান বৈশ্বিক ব্র্যান্ড। সেই সাথে এখন মনে হচ্ছে নারীদের বহিরঙ্গের এই শাল নামক বস্ত্রটিও হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক, সাথে পশমিনা ও কাশ্মীর এই নামগুলো বিপণনবিদরা যাকে বলে ব্র্যান্ড তা না হয়ে উঠলেও, জেনেরিক নাম হিসেবে পেয়ে গেছে বৈশ্বিক খ্যাতি!
‘বাবা, বাবা এই যে দেখো ঐ হোটেলটা আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। চল না ছবি তুলি।’ অভ্রর এই কথায় সম্বিৎ ফিরতেই টের পাই, আমরা দুজন বাকীদের পিছনে ফেলে অনেকটাই সামনে চলে এসেছি। এখন আমাদের অবস্থান সেই বিখ্যাত লেজেন্ডেল হোটেলের সামনে, যেটিকে সেই প্রথম দিন আমাদের হোটেলের জানালা দিয়ে দেখে নাম দিয়েছিলাম ষাট গম্বুজ দালান। কারণ এর ছাদের উপরে অনেকগুলো খুব বড় না হলেও ছোট গম্বুজ আকৃতির ডোম আছে।
বেইজিং অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে উদ্বোধন করা এই হোটেলটি এই এলাকার একটা ল্যান্ডমার্কই স্থাপনাই। প্রতি রাতেই মনে হচ্ছে এতে লেগে আছে কোনও না কোনও পার্টি। এমনিতেও গোটা বেইজিঙয়ের নানান দালানগুলো চায়নিজ নতুন বছর উপলক্ষে আলোকসজ্জায় সজ্জিত থাকলেও, নানান পার্টি উপলক্ষে বিশেষত হোটেলগুলোতে যোগ নতুন নতুন আলোকসজ্জা। আজও মনে হচ্ছে লেজেন্ডেল হোটেলে কোনও হোমরা চোমররা পার্টি হচ্ছে যেখানে জড়ো হয়েছে বা এখনো হচ্ছে বেইজিংয়ের নানান সাইজের আরো সব কেষ্টু বিষ্টুরা। ফলে এর সাজ সজ্জায় দেখা যাচ্ছে আজ বাড়তি জেল্লাই চেকনাই যা করেছে রোশনাই এর আশপাশও।
অতএব অভ্র আবেদনে সাড়া দিয়ে বেশ কটা ছবি তুলে ফেলেছি এরই মধ্যে হোটেলের গেইটের কাছে। এখন ওর ভাবেসাবে মনে হচ্ছে একটু পিছিয়ে থাকা ভাইয়া এসে পৌঁছুলে আরেক প্রস্থ ছবি তুলবে দু’জনে হোটেলের চত্বরে ঢুকে।
‘ঐ যে দেখো বাবা, ঐ যে রোলস রয়েস ঢুকছে একটা।’ তুমুল উত্তেজিত অভ্রর এই কথায় আর ওর তর্জনী নির্দেশিত দিকে চোখ যেতেই বুঝলাম একটু দেরী করে ফেলেছি। দুলকিচালে গেইট পেরিয়ে ইতিমধ্যে সেই গাড়ি হোটেল চত্বরে ঢুকে পড়ায় তার বিশাল নিতম্ব মানে পেছনের অংশই চোখে পড়লো, তাতে ওটা যে কী গাড়ি তা তো আমার বোধগম্য হবার কথা নয়। অবশ্য সামনের অংশ দেখলেও যে বুঝতাম, ওটার জাত পাতের খবর তাওতো নয়। এ ব্যাপারে ছেলেদের কাছে এ অধম যেহেতু দুগ্ধপোষ্য শিশুই, সেহেতু ওদের রায়ই আমি কবুল করে নিতে শুরু করেছি নির্দ্বিধায় যেদিন এসে পা রেখেছি চায়নায় এইবার, সেইদিন থেকেই। আসলে এখানে আসার পরই দুইভ্রাতার এই বিশেষ প্রতিভাটি আবিষ্কার করেছিলাম তো।
এর আগে কুনমিং এর রাস্তায় পার্ক করে রাখা জাজ্বল্যমান একটা রোলস রয়েস প্রথমবারের মতো দেখতে পেলেও, এই কিছুক্ষণ আগেকার অভ্রর উত্তেজনার কারণ হল, এই প্রথম দেখেছে একটা জীবন্ত মনে চলন্ত রয়েস। জানি না ওদের দুজনের মধ্যে চলমান গাড়ি দেখা বিষয়ক প্রতিযোগিতাটি সর্বশেষ পয়েন্ট তালিকা। তবে বজাই যাচ্ছে এ মুহূর্তে অভ্র ভাইয়ার চেয়ে বেশ একটা ভালো অবস্থায় চলে গেছে। এদিকে এরই মধ্যে ছবি তোলাতুলিতে খ্যান্ত দিয়ে দৌড়ে ও চলে গেছে পেছনে ভাইয়ার কাছে হৈ চৈ করতে করতে।
খুব বেশি পেছনে ছিল না ওরা। অতএব দ্রুতই দুইভাই দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে শুরু করতেই, বললাম কি যাবে নাকি দীপ্র হোটেলের চত্বরে ঐ রোলস রয়েসটা খুঁজে দেখতে পার্কিং লটে?
‘না, না, বাবা। ওটা ঠিক হবে না।’ বেশ জোরের দেয়া দীপ্রর এই জবাবে বোঝা গেল কৈশোরে এসে ছেলেদের হঠাৎ করেই যে তীব্র পারসোনালিটি বোধ জেগে উঠে, তাতে তার লেগেছে চোট। হ্যাংলার মতো কেন সে অন্যের বাড়ির উৎসবে ঢুকে দেখতে যাবে তাদের গাড়ি?
‘ঐ যে ঐ যে, বেন্টলি ঢুকছে একটা এখন।’ দুইভাই এসময়ে প্রায় সমস্বরে হৈ চৈ করে উঠতেই আরো নিশ্চিত হওয়া গেল যে চায়নিজ আলিবাবা খোদ জ্যাক মা না হলেও তার চেলা চামুণ্ডা জাতের চায়নিজ রুই কাতলাদের বসেছে মচ্ছব এইখানে।
এরই মধ্যে হেলেন আর লাজু এসে আমাদের সাথে যোগ দিতেই, এই নতুন সাজসজ্জায় সজ্জিত ষাট গম্বুজ দালান পেছনে রেখে নানান দিক থেকে ঝটপট সবার কয়েকটা ছবি তুলতে তুলতে মোবাইলের পর্দায় দেখলাম যখন বাজছে ৯টা ১০, গুনলাম প্রমাদ গুনলাম। এলো বিষম তাড়া কর্নেলের ডেরায় যাবার। ভাবছি ওদেরকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে কর্নেলের মুর্গিভাজা আনার জন্য রওয়ানা করলে, ততোক্ষণ কী থাকবে খোলা কে এফ সি?
দ্রুতই তাই ছবি তোলার পাঠ চুকিয়ে, সবাইকে জোর তাড়া দিয়ে এগুলাম সামনের দিকে। যদিও আমাদের হোটেলটা ঠিক রাস্তার ওপাশেই, কিন্তু বাঙালি স্টাইলে তো এখানে রাস্তা পারাপার করা যাবে না। সামনে গিয়ে জেব্রাক্রসিং ধরে রাস্তা পার হতে লাগবে, না হলেও যাবে কমপক্ষে মূল্যবান ৮ /১০ মিনিট।
নাহ, এইবার দেখছি দয়াপরবশ হয়ে বাঁচিয়ে দিল মিনিট দুয়েক বেইজিংয়ের ট্রাফিক সিস্টেম। জেব্রা ক্রসিংয়ের গোঁড়ায় এসে দাঁড়াতেই পাওয়া গেল রাস্তা পার হওয়ার হুকুম। সবাইকে নিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে, এপাড়ে এসেই জিজ্ঞেস করলাম, আমার কি ওদেরকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই হবে? ব্যাগ যদিও বেশ কটাই হয়েছে, ওজনতো ওগুলোর খুব একটা বেশি নয়। হোটেলে ওদের পৌঁছে দিতে গিয়ে যদি নষ্ট হয় আর কয়েক মিনিট, আর তাতে যদি গিয়ে দেখি বন্ধ হয়ে গেছে কে এফ সি, তা হলে তো হবে আরেক হাঙ্গামা!
‘অসুবিধা নাই। যা তুই। এসেই তো পড়েছি, তোর ব্যাগগুলো আমার আর দীপ্রর হাতে দে ভাগ করে, আমরা চলে যেতে পারবো।’
হেলেনের এ কথার সাথেই পেলাম যখন লাজুর অনুমতি, আর তখনও যেহেতু ট্রাফিক লাইটে আছে লোক পারাপারের সাইন, দিলাম ভোঁ দৌড় ঐ পাড়ের দিকে। রাস্তার এ পাড়ের অংশ পেরিয়ে আইল্যান্ডে উঠতেই দেখি রাস্তা পারাপারের সাইনটি জ্বলতে নিভতে শুরু করেছে, যার মানে চালাতে হবে পা আর জোরে, অতএব বাড়ালাম দৌড়ের গতি। এভাবে দৌড়ে হাচরে পাঁচরে নিরাপদে এ পাশের ফুটপাতে এসে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাফাতে ভাবলাম, আচ্ছা এতো টেনশন করার আছে কী এতে? যদি না পাই খোলা কে এফ সি, অসুবিধা কী? একদম তো আর জলে পড়ছি না, হোটেলের রুম সার্ভিস তো আছেই মজুদ। আপাতত একটু রেস্ট নেই না। শপিং ডে হলেও কম তো ঘুরিনি আজও!
কতক্ষণ হবে? হবে হয়তো মিনিট দুই বা তিন, চুপচাপ ঠায় দাঁড়িয়ে একটু দম নেবার পর, মনে হল এবার যাবে ফের এগুনো সামনে জোড় কদমে। অতএব ধরলাম হাঁটা একমনে ফুটপাত বরাবর। আন্দাজ করছি, হাঁটছি যে গতিতে খুব জোর মিনিট পনেরর মধ্যেই পৌঁছে যাবো কে এফ সি তে। তবে লক্ষ রাখতে হবে স্থির, মন কিছুতেই নেয়া যাবে না এদিক ওদিক। রাত দশটা পর্যন্ত যদি থাকে ওটার খোলা থাকার মেয়াদ তবে চিন্তা নাই। সাথে সাথেই মনে হল মেয়াদ যদি হয় সাড়ে নটা, তবে অবশ্যই বৃথা এই এখনকার সাধনা!
আশা আর নিরাশার এরকম দোল চালের মধ্যেই ভাবলাম, না পরাজয়ে ডরে না বীর। হটবো না পিছু কিছুতেই। ফলে এগুতে শুরু করলাম মনের জানালা দরজা সব বন্ধ করে, শুরুতে জোর কদমে, অতপর জগিংয়ের ভঙিতে।
ধন্বন্তরির মতো কাজ হল সামনে এগুবার এই কায়দা। ১৫ মিনিটের জায়গায় মনে হল বুঝি মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে পৌঁছুলাম কর্নেলের দ্বারে। দরজার কাচের শার্সি ভেদ করে ভেতর থেকে আসা উজ্জ্বল আলো বলছে, অবশ্যই কর্নেল আছেন এখনো জেগে। অতএব হুড়মুড় করে দরজা ধাক্কা দিয়ে স্টোরের ভেতর পা দিয়ে নাক বরাবর থাকা গোটা কাউন্টারটি খা খা ফাঁকা দেখতে পেয়ে, সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম ওখানে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।