দেশ হতে দেশান্তরে

হুতংয়ের ভেতরের ফুডহুতং

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১২ মে, ২০২৪ at ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ

পুত্রদের অ্যাপল স্টোর পর্ব শেষে, কোথাও না থেমে একটানা হেঁটে এইমাত্র পৌঁছেছি বেইজিংয়ের ডংচেং ডিসট্রিক্টের সেই শপিং এলাকার কাছাকাছি, যা এরই মধ্যে আমাদের সকলেরই বেশ চেনা হয়ে গেছে। নাহ, এবারের অ্যাপেল অভিযানে, অভ্রর জন্য বিটস হেডফোন কেনার আমার প্রস্তাবটি ওর মায়ের অনুমোদন পায় নি! অবশ্য তার বদলে ওর জন্য একটা চমৎকার স্কুলব্যাগ কেনা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ওর মা। কিন্তু এসব নিয়ে ওর এক্কাবারে নির্বিকার ভাব দেখে বোজা গেল আসলেই ওর কাছে নিজের জন্য কিছু কেনা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাতে হঠাৎ করেই মনে হয়েছিল আমাদের এই বাচ্চা ছেলেটি কি হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেল নাকি?

বাবা, আমরা কি আদিব ভাইয়ুর খেলনা কেনার জন্য ঐ খেলনার দোকানটাতে ঢুকবো এখন?’

এখানে এসে সেই চত্বরটিতে, মানে যেটির এক কোণায় আছে ম্যাকস্টোর সেদিকে যাবার জন্য ডানের হাঁটা পথ ধরে এগুতেই এইমাত্রই সামনে পড়েছে বিশাল সেই খেলনার স্টোরটি, যা চোখে পড়তেই এসেছে দীপ্রর এই প্রস্তাব।

হ্যাঁ ওখানে তো যাবোই, তবে এখনি না। চল আগে ঐ যে ম্যাকস্টোরের উল্টা দিকের শপিংমলটার পাশ দিকে যাওয়া রাস্তাটি আছে ওটা দিয়ে গিয়ে দেখি কী আছে ঐখানে?

ঐ চিপা গলিতে কী জন্য যাবো? কী আছে ওখানে?’

কী যে আছে ঐখানে ওটাই তো দেখতে যাবো। চল না যাই আগে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই ভাবে ; লাজুর অনীহাসূচক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলতে বলতে এগুলাম সেদিকেই, পুত্রদ্বয়কে বগলদাবা করে। নানান সাইজের পলিথিন ব্যাগে নানান কিছু নিয়ে ঐ গলি থেকে কয়েকজনকে এরই মধ্যে বেরুতে দেখে, আর কয়েকজনকে ঢুকতে দেখে এরই মধ্যে ধারণা জন্মেছে মনে যে ওখানে শপিং করার মতো কিছু না কিছু আছেই।

দাদা নানানজনকে গিফট দেয়ার জন্য ছোটখাট চায়নিজ শো পিস কিনতে চাই। ঐরকম দোকান কি আছে এখানে?”

হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। আমিও ভাবছিলাম ওটা। ‘হেলেনের কথার পিঠাপিঠি লাজুও তার ঐক্যমত্য ঘোষণা করতেই স্বস্তি পেলাম মনে বড়ই। ঠিক আছে ঠিক আছে, খুঁজে দেখবো ঐরকম কোনো দোকান আছে কি না এখানটায়। অবশ্য তা থাকারই কথা।

বলতে বলতে এরই মধ্যে চায়নিজ বান্দর বছর কে স্বাগত জানানোর মানসে নানান সজ্জায় সজ্জিত চত্বরটি কোণাকুণি ভাবে পেরিয়ে ধরেছি ওখানকার শপিংমলটির গা ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া সেই গলিপথটি। গলি ধরে মিটার বিশ কি তিরিশ এগিয়ে মানে চত্বরের ঐ শপিংমলটির পেছনে গিয়ে, গলিটির সাথে সাথে ডানে ঘুরতেই চোখ হয়ে গেল এক্কেবারে যাকে বলে ছানাবড়া একইসাথে দলের সকলের মুখনিসৃত নানান ধরনের ধ্বনি নিশ্চিত করলো যে, তাদের সবারই অবস্থাও আমার মতোই। অন্যান্য জায়গার তুলনায় বলা চলে লোকজনে এক্কাবারে গম গম করছে এলাকাটা! যেই গলিটা ধরে এসে পৌঁছেছি এইখানে, দু পাশে অসংখ্য দোকান নিয়ে সেটি এগিয়ে গেছে সামনের দিকে কতোটা দূর যে, লোকজনের ভিড়ে তা বুঝতে পারছি না। আশার কথা হল একটু আগে হেলেন ও লাজু যে ধরনের দোকান খুঁজছিল, সেসব পণ্যের দোকান ছাড়াও, আরো নানান জাতের পণ্যে দোকানগুলো ঠাঁসা। যে গলি দিয়ে ঢুকেছি এখানে তার চেয়ে ঢের চওড়া সামনের এই জায়গাটা। কিন্তু ওখানটার দুপাশে দোকানগুলো থেকে উপচে পড়া পণ্য সম্ভারের কারণে হাঁটার রাস্তা খুবই সরু। গোটা এলাকাটি দেখে মনে হল এসে পৌঁছেছি বুঝি ব্যাংককের নাইট মার্কেট বা কুয়ালালামপুরের চায়না টাউনে। ব্যাংককের নাইট মার্কেটের সাথে এর পার্থক্য হলো এটি গভীর রাতে নয়, এই বিকেলেই জমজমাট। আর কুয়ালালামপুরের চায়নিজ মার্কেট যেমন ঠাঁসা নানান ইলেকট্রিক আর ইলেক্ট্রনিঙ পণ্যে, এটি দেখছি ঠাসা নানান চায়নিজ শো পিস আর ট্র্যাডিশনাল পণ্যে। হবেই না বা কেন তা?

এ তো হল খোদ চায়নার রাজধানী বেইজিঙয়ের বুকে আধুনিক শপিং মলের আড়ালে বসা চায়নিজ মার্কেট! হায় এভাবেই তো আজকের বৈশ্বিক ভোগবাদী পুঁজির সংস্কৃতির কাছে মার খেয়ে পিছিয়ে পড়ছে দিকে দিকে স্থানীয় সংস্কৃতি ; যা থেকে দেখছি মুক্ত নয় এমনকি আজকের দুনিয়ার অন্যতম শক্তি চায়নাও। ফলে তাদের নিজেদের ট্র্যাডিশনাল পণ্যের স্থান হয়েছে ঐ চত্বরের আধুনিক শপিং মলগুলোতে না, হয়েছে কি না এই হুতং এ। মানে গলির বাজারে।

হ্যাঁ বেইজিং এর বিখ্যাত দশ হুতংয়ের বিবরণ পড়েছিলাম প্লেনে কুনমিং থেকে বেইজিং আসার পথে এয়ারলাইন্সের ম্যাগাজিনে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল আহা যদি নিতে পারতাম বেইজিঙয়ের হুতংয়ের অভিজ্ঞতা। কিন্তু বেইজঙ্গিয়ে এতোসব বিশ্বখ্যাত নানান দর্শনিয় স্থান আছে যে, সে সবেরই যখন সব দেখা সম্ভব নয় তিন চারদিনের ভ্রমণে, সে জায়গায় কোথাকার কোন পুরানো গলির বাজার দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব বাকীদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে বলে, মনের সেই আশা মনেই পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। এখনতো দেখছি নিজের অজান্তেই পূরণ হয়েই গেল অবশেষে সেই আশা! বোঝাই যাচ্ছে আশা কখনোই ছাড়তে নেই বলে কথা আছে, সেটি কতোটা সঠিক!

সরু গলিপথে অনেকটা গা গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ আর দোকান গুলো থেকে উপচে পড়া পণ্য সম্ভারের ফাঁক ফোকর দিয়ে লম্বা একটা সরল রেখা মতো লাইন করে সন্তর্পণে নিজেদের পথ করে এগুতে এগুতে, মোটামুটি কিছুটা চওড়া চত্বরের মতো জায়গা এসে দম ফেলতেই সামনে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় হেলেন ঘোষণা করলো

বাহ, বাহ এই তো পাওয়া গেছে। এখান থেকেই কেন যাবে শো পিস। আহা, কতো সুন্দর সুন্দর শো পিস।’ ঠিক তখনি অভ্র বা দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলে উঠলো

বাবা, বাবা ঐ যে দেখ? ঐ যে অক্টোপাস, স্কুইড, গ্রিল করে বিক্রি করছে আমি ওগুলো খেতে চাই!’

ইয়েস, ইয়েস’। সাথে সাথেই বেশ জোরের সাথে ছোট ভাইয়ের দাবীর সাথে দীপ্রর তুমুল সমর্থন আসতেই বুঝলাম, এ দাবী এড়ানোর উপায় নাই! এদিকে অভ্রর নির্দেশিত দিকে তাকিয়েই দেখতে পেলাম ওইদিকটা যতোটুকু চোখ যায়, ততটুকুতেই দেখা যাচ্ছে নানান ধরনের খাবারের পসরা। আর এ মুহূর্তে যে চওড়া মতো জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছি, এটিকে বলা চলে এই হুতং এর দ্বিমোহনা। মানে এই জায়গাটাতে থেকে অনেকটা নব্বই ডিগ্রির সমকোণ বানিয়ে কোণটির দুই বাহু দুই দিকে চলে গেছে।

না না, এসব রাস্তার খাবার খাওয়া যাবে না। এ মা ওয়াক! থুঃ! ঐসব কি দেখা যাচ্ছে সাপ নাকি কেঁচো?’ পুত্রদের দাবীর বিরোধিতা করে লাজু এ কথা বলতে না বলতেই

ইয়াক থুঃ, ঐ যে দেখা যাচ্ছে তেলাপোকা আর তুরকুলা ভাজা। না না বাচ্চারা তোমরা ওসব খাবে না। নাহ ঐ দিকে আর তাকানো যাবে না। বমি আসছে! কী রকম যেন গন্ধও লাগছে ‘আর্তনাদ করে উঠল হেলেন !

না, না তা হবে না। তুমি আর বাবা তো সকালে রাস্তা থেকে কিনে পোড়া আলু খেয়েছ। এখন আমাদের রাস্তার জিনিষ খেতে মানা করছ কেন তোমরা? আমরা তো স্কুইড, চিংড়ি, অক্টোপাস এসব খেতে চাচ্ছি। সিংগাপুরে তো আমরা অনেক খেয়েছি এগুলো।’

মোটকথা এই হুতংএর ভেতরে এসে এর বা দিকের ফুডহুতংটি চোখে পড়ার পর তা নিয়ে দলের মধ্যে হঠাৎ করেই যে ত্রিপক্ষীয় বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দুই ভেটোশক্তিসম্পন্ন সদস্যদের ভোট বিপক্ষে চলে যাবার পরও অবলীলায় তা উপেক্ষা করে দেখছি পুত্ররা কেন জানি ধরেছে তুমুল গো। ওদের বাক বিতণ্ডার ফাঁকে এরই মধ্যে এখান থেকে দাঁড়িয়ে যতোটা দেখা যায় ঐ ফুডহুতংটিতে, তাতে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, এ আমি হতাম যদি এখন সেই বিশ বাইশ বছর আগেকার আমি, তবে এখন চোখে যা পড়েছে তাতে, হেলেন আর লাজু যদিও মুখে ইয়াক থুঃ বলেই চোখ ফিরিয়ে নিজেদের সামলে নিতে পেরেছে, অবশ্যই তা করেও সামলাতে পারতাম না আমি। বরং এখানেই হড় হড় করে বমি করে একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ডই ঘটিয়ে ফেলতাম।

গত বিশ বাইশ বছরের নানান সময়ে থাইল্যান্ড, হংকং, তাইওয়ান আর চায়নার নানান ফুড স্ট্রিটের যতো বিচিত্র সব খাদ্যসম্ভার দেখার শুরুর দিকে লাজু হেলেনের মতোই ওয়াক থুঃ বলে বমি এড়ানোর জন্য চোখ ফিরিয়ে নিয়েও বেশ ক’বার শেষ রক্ষা হয়নি। মুখ আর চোখ ফিরিয়ে নিলে কী হবে? নাকে তো ঠিকই ঢুকে গিয়েছিল ওগুলোর বোটকা গন্ধ, তাতে তো সূত্র মতেই হয়েই গিয়েছিল প্রতিবারই আমার অর্ধভোজন। আর সে কথা মনে হতেই বমি হয়ে গিয়েছিল প্রথম প্রথম বারকয়েক। তারপর থেকে অবশ্য এসব সহ্য করার ক্ষমতা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় এখন আর তা হয় না। কিন্তু হচ্ছি অবাক এখন, কারণ এসব নিয়ে দেখছি মোটেও বিকার নাই পুত্রদের ! এ কি তবে ডিজিটাল সময়ের কারিশমা? যখন তারা অহরহই অতি সহজে দেখতে পায় ওরা নানান দেশের নানান ফুডব্লগারদের নানান কিছু?

না, না এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না।’ বলতে বলতে এরই মধ্যে ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে হেলেন, মানে যেদিকটায় আছে শো পিস সহ আরও নানান কিসিমের চায়নিজ পণ্যের পসরা। আর ননদকে অনুসরণ করে গেছে ঐদিকে লাজুও।

এদিকে দু পুত্র ধরেছে গোঁ যাবে ঐ ফুড হুতংয়েই। তবে এরই মধ্যে তারা নিজেদের দাবীও শিথিল করেছে অনেকটাই। অক্টোপাস আর স্কুইড বাদ দিয়ে, আপাতত তারা চিংড়ি পোড়া পেলেই খুশি, জানিয়েছে এরই মধ্যে। ধরেই নিয়েছি হেলেন আর লাজু থাকবে ঐ গলিতেই। আর খুব তাড়াতাড়ি যে বেরুতে পারবে তারা এখানকার পণ্য সম্ভারে সাঁতার কেটে, তাও মনে হচ্ছে না। অতএব ওদের আর না ঘাটিয়ে দ্রুত এগুলাম সপুত্রক ফুডহুতংয়ের দিকেই।

লেখক: ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা তোমার স্মৃতির জলছবিতে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ