দেশ হতে দেশান্তরে

প্লাস্টিকমানির বাইক্কা কার্ড

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩ মার্চ, ২০২৪ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

নেড়া গল্পে কয়বার বেলতলা গিয়েছিল জানি না, তবে এই আমি নেড়া হই আর না হই, বারবার বেলতলায় যাইতে রাজি না অবশ্যই। একবার খাইছি ধরা, আর খাইতে চাই না। একথা মনে হতেই বাক্স খুলে জুতার আগপাশতলা সব মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাস্যময়ীর হাত থেকে দ্রুত ঐ বাদামি সন্যাসী জুতার বাক্সটি নিতেই কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। একই সাথে মনে হল তার চেহারায় ভেসে উঠলো হতাশাসূচক অব্যক্ত প্রশ্ন ‘আহ হা আবার কী ভুল করলাম? আর তো পারছি না এই কাস্টমারকে নিয়ে!’

নিজের পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল হকার হিসেবে। আসলে বেচাবিক্রি পেশায় যারা থাকে তাদের পদবি ডিরেক্টর, ম্যানেজার বা অফিসার যাই হোক, তা কেউ মেনে নিতে চায় না আমাদের দেশে। সবাই তাদেরকে সোজা হকারই ভাবে। আমারও নেই আপত্তি তাতে। কথা হচ্ছে আমার সেই হকারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, এ পেশার এরকম হতাশার ব্যাপারটা ভালো করেই। দ্রুত তাই হাত নেড়ে হাসিমুখে হাস্যময়ীকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করতে করতে খাঁটি বাংলায় বললাম, না, তুমি কন্যা অবশ্যই ভুল করনি। তবে সেই যে মেসির কাছে ধরা খেয়েছিলাম, তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। তাই দেখে নিতে চাই বাক্সের ভেতরে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কি না, বুঝলা না? বলতে বলতে জুতোর বাক্স খোলায় মনোনিবেশ করলাম

ঘটনা হচ্ছে, বেশ কয়েক বছর আগে পুত্ররা আমার যখন আরো ছোট ছিল সেসময় আমেরিকা থেকে আক্রাদামে দীপ্রর জন্য জুতো কিনে দেশে ফিরে সেই জুতোর বাক্স খোলার পর খেয়েছিলাম যাকে বলে রামধরা খাওয়া, তা। একদিকে সে সময়ে পকেটের যা জোর ছিল তাতে ঐ দামে জুতো কেনার কথা ছিল না আমার। তারপরও কিনেছিলাম তুমুল পছন্দ হয়ে যাওয়ায় জুতোটা। দেশে ফিরে সেই জুতোর বাক্স খোলার পর, মাথায় বাজ পড়ার সাথে অর্বাচীন এ অধমের সেই বেকুবিকে কেন্দ্র করে যা অবস্থা হয়েছিলো? সে সবের ব্যথা অবলীলায় উপেক্ষা করতে পারলেও, পুত্রের আনন্দোজ্জ্বল মুখে সে সময়ে হঠাৎ যে হতাশার কালো মেঘ নেমে এসেছিল তা তো ভুলতে পারবো না ইহজনমেও মনে হয়।

মনে আছে নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের বিখ্যাত ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মেসিতে বেশ সময় নিয়ে সাথে করে নিয়ে যাওয়া পুত্রের পায়ের মাপের সুতো ধরে সেই পছন্দ হয়ে যাওয়া জুতোটির মাপ নিশ্চিত হবার পর, মেসির চোস্ত বিক্রয়কর্মী দ্রুত সেই জুতোর একটা ফ্রেস বাক্স এনে হাতে ধরিয়ে দেবার পর কেন জানি মনে হচ্ছিল, বাক্সটা খুলে দেখি, আছে কি না সব ঠিকঠাক।

কিন্তু সেই জুতোর বাক্স খোলার উপক্রম করতেই একই সাথে পেয়েছিলাম বেশ জোরদার যৌথ বাধা। প্রথমত স্মার্ট সেই বিক্রয়কর্মী সগর্বে জানিয়েছিল তাদের ওখান থেকে কেনা কোনও জিনিষে কোনওরকম গড়বড় হবার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। একই সাথে সে তোতাপাখির মতো গড়গড় করে বলেছিল তাদের স্টোরের রিটার্ন পলিসি। সেসময় আবার সেই বিক্রয়কর্মীর সাথে গলা মিলিয়ে তুমুলভাবে আশ্বস্ত করেছিল শপিংসঙ্গী নিউইয়র্কবাসি, যিনি বন্ধু তিনিই সম্বন্ধী ফিলিপ। অতপর ঢাকায় ফিরে জুতোর সেই বাক্স খুলে পেয়েছিলাম দীপ্রর ডান পায়েরই দুটো জুতো! সেই থেকে জুতো যখনই কিনি, দেশে বা বিদেশে সেই ঘটনা মনে পড়ে।

সেই সূত্র ধরে মনে পড়ল তা এখনো। তদুপরি কথা হচ্ছে খোদ আমেরিকার বুকে, তাও মেসির মতো স্টোর থেকে কেনা পণ্যে যদি ঐরকম ঘটনা ঘটতে পারে, তবে এ তো হল চায়নার বেইজিংয়ের নাম না জানা এক স্টোর। আর কে জানে মেসির ঐ জুতোও হয়তো এ চায়নাতেই বানানোর পর চায়নাতেই প্যাকেটবন্দি হওয়ার পর গিয়েছিল আমেরিকার নিউইয়র্কে। অতএব প্যাকেজিং বিষয়ক সে ভুল হলে তো হয়েছে তো চায়নাতেই। তারপরই না সেই ভুল প্যাকেট ভুল ধরা পড়েছিল অধমের ঢাকার ফ্ল্যাটে !

আচ্ছা, এই ব্যাপারটা তো আগে খেয়াল করিনি! মানে, মনে পড়লো যা এখন আর তা হল, আজকাল দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ক্রমশ একীভূত হয়ে পড়া এই গ্রহে এ ঘটনা তো অহরহই ঘটে। যে কোনও পণ্যই আজ পৃথিবীর এক প্রান্তে তৈরি ও প্যাকেটজাত হয়ে অন্যপ্রান্তে বিক্রি হওয়ার পর ব্যবহৃত হতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রান্তে! হুম ভোগাবাদি পুঁজিবাদের মুনাফার ক্রমবৃদ্ধির প্রয়োজনে পণ্য যদিও যাতায়াত করতে পারে এই গ্রহে যে কোন প্রান্তে, তেমন কিন্তু পারে না সেই পণ্য তৈরি করা মানুষ। মানুষের জন্য এই গ্রহের শক্তিমান মানুষেরা তৈরি করে রেখেছে আসলে নানান দেয়াল, দিকে দিকে।

সে কথা থাক। এরই মধ্যে পরীক্ষা করা হয়ে গেছে হাতে নেয়া জুতো জোড়ার বাক্সটি। দেখলাম ঠিকই আছে সবই, মানে দু পায়ের দু জুতা তো আছেই বাক্সে, ঠিক আছে মাপ আর রংও। আরো একটা ব্যাপার ইতোমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তা হল দাম। এতোক্ষণ এই জুতোর দামের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও এখন যখন এটি নেব বলেই স্থির করেছি, সে ব্যাপারটির ব্যাপারেও তো নিশ্চিন্ত হতে হয় যাতে দাম মেটাতে গিয়ে আবার ভির্মি না খাই।

আগেই দেখেছিলাম এখানে আর কিছু না হোক দাম অন্তত লেখা আছে ইংরেজিতে। অতএব সমস্যা হল না জুতোর বাঙে লাগানো স্টিকারটি পড়তে গিয়ে। নাহ, যেরকম দাম হতে পারে বলে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম সেই দামের কাছাকাছি তো অবশ্যই বরং বাংলা টাকায় শ পাঁচেক কমই দেখছি এর দাম। এতে একদিকে নিজেকে যেমন একজন কাবিল শপার মনে হচ্ছে, আবার দাম যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে কম হওয়াতে, মনে হল একটা দাও মারতে পারলাম বুঝি অবশেষে! ফলে বেশ খোশ মেজাজে হাস্যময়ীকে হাতের ইশারার সাথে মুখেও ফের বললাম খাঁটি বাংলায়, ঠিক আছে এটাই দিয়ে দাও কইন্যা! নিয়ে চল মোড়ে সেথায়, যেথায় মিটাতে হবে দাম।

আরে! এই হাস্যময়ীতো দেখছি এক্কেবারে জাত সেলসগার্ল ! যতোই থাকুক না কেন আমাদের মধ্যে ভাষাগত বাধার সুউচ্চ মহাপ্রাচীর, তাতে যে তার ‘কুছ পরোয়া নেহি’, সে তো আগেই দেখেছি। এখন দেখছি, বিক্রয়বিদ্যার সূত্র মেনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে আমার কাছে বিক্রি আরো বাড়ানোর! ক্রেতামনোবিদ্যা বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ের গুরুরা এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, একজন সম্ভাব্য নতুন ক্রেতার চেয়ে, যে ক্রেতা ইতিমধ্যেই কোনও বিক্রেতার কাছ থেকে কিছু কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, তার কাছে আরো বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারার সম্ভাবনা বেশী। ভাষাবিভ্রাট উপেক্ষা করে হাস্যময়ী ঠিক চেষ্টাই করার ব্যাপারেই দেখছি বদ্ধপরিকর।

তদুপরি সে তার এই বাঙ্গাল ক্রেতাটিকে গভীর মনোযোগে লক্ষ্য করে, তার আচরণকে দ্রুত বিশ্লেষণ করেই যে সে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টায় আছে, সেটিও প্রমাণিত করে ফেলছে এরই মধ্যে। কারণ বগলের নীচে একটু আগে আমার হাত থেকে নেয়া সন্যাসী জুতোর বাক্সটি ধরে রেখে অতি দ্রুত এখন সে সামনে এনে হাজির করেছে ঐ যে প্রথম দেখেছিলাম আমার পছন্দের অক্সফোর্ড স্যু, তারই এক জোড়া। অতপর হাতের ইশারায় বসতে বলছে আমাকে ঐ গদি আঁটা টুলে যেন তা সে পায়ে পরিয়ে দিতে পারে। নিজের ভেতরের ক্রেতাটি এতে অস্বস্তিতে কিছুটা উসখুস করে উঠলেও পেশাদারটি কিন্তু বেশ আনন্দিতই হলো। নাহ,এ মেয়ের ভবিষ্যৎ অবশ্যই ভালো !

মোদ্দা কথা হল এ মুহূর্তে নিজের ভেতরের অস্বস্তিতে পড়া ক্রেতা আর প্যাশনেট প্রশিক্ষকটির মধ্যকার দ্বৈরথে জয়ী হল প্রশিক্ষকটিই। ভাবলাম তাই বলি যে, নাহ আর জুতো নয়, নিলে নিতে পারি একটা বাদামি বেল্ট, পারলে ঐটা আনো কয়েকটা। দেখি পছন্দ হয় কি না। সাথে সাথেই মনে হল, নাহ এই পাগলরে আর সাঁকো নাড়ানোর কথা বলা যাবে না। এই সেকশন বা আশেপাশের কোনও সেকশনেই তো বেল্ট দেখিনি। ঐ কথা বলতে সে যে আবার কোথায় চলে যায় বেল্ট আনতে, আর তাতে যে কতো সময় ক্ষয় হবে জানি না তো! অনেক সময় পেরিয়ে গেছে এরই মধ্যে। নিচের তলায় পরিবারের বাকীরা কেনাকাটা কিছু করতে না পারলে নিশ্চয় এতোক্ষণে অস্থির হয়ে পড়েছে। অতএব দাম মিটিয়ে দ্রুত ওদের কাছেই যাওয়া দরকার। এছাড়া বাদামি রং মোটামুটি প্রচলিত রং। অতএব জুতোর সাথে মিলিয়ে ঐ বেল্ট যে কোনও জায়গা থেকেই কেনা যাবে। মনে মনে এ সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে আকর্ণ হাসির সাথে হাতে ইশারা দেয়ার সাথে ফের বললাম বাংলায়, না কন্যা আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুণি হাজিরা দিতে হবে নিচে, আমারে আর ঝামেলায় ফালাইয়ো না। দাম নিয়া তাড়াতাড়ি দায়মুক্ত কর।

মজার কথা হচ্ছে তাতেই কাজ হল। এবং খুব বেশ সময় লাগলো না, কারণ কাছে ধারেই ছিল দাম মেটানোর ক্যাশকাউন্টার। ওখানকার আরেক চায়নিজ কন্যার হাতে হাস্যময়ী বাক্সটি দিতেই, সে তা স্ক্যান করতেই আমার দিকে মুখ করে থাকা ক্যাশমেশিনের ছোট্ট পর্দায় সবুজ রঙ্গয়ের অক্ষরে দামটি ভেসে উঠার পর, প্রথমে ভাবলাম নগদ রেন মেন বি তে শোধ করি দাম। পরক্ষণেই মনে হল, কী দরকার নগদ খরচ করার? সুযোগ আছেই যখন কিনিই না কেন বাকিতেই। এ পর্যন্ত একমাত্র হোটেল ছাড়া অন্যকোথাও আমার আন্তর্জাতিক বাইক্কা কার্ড মানে ক্রেডিট কার্ড কাজ না করলেও, এতো বড় স্টোরে নিশ্চয় কাজ করবে তা। ফলে মত বদলে নগদের বদলে হস্তান্তর করলাম ক্যাশ কাউন্টারে প্লাস্টিকমানি বলে সুপরিচিত সেই বাইক্কা কার্ড।

লেখক: কলামিস্ট ও ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবই মেলার সমৃদ্ধ পরিবেশ
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ