হ্যাঁ আর সকলের মতো আমিও কিছুকাল আগ পর্যন্ত এই ব্র্যান্ডের নাম উচ্চারণ করতাম পিয়েরে কার্ডিন। সমপ্রতি আমার এক ফ্রেঞ্চ সহকর্মীর কাছে এর মূল ফেঞ্চ উচ্চারণ শিখেছিলাম। কিন্তু এখন বাংলায় তা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে উচ্চারণ যেভাবে করতে হয়ে, তা যেন ধরতে পারছে বাংলার অক্ষর বা ধ্বনি। আমাদের ধ্বনিগত অভ্যাসে আমার কাছে এ পিয়েখ কাঁদা ই! যাক বিষয় তা না। বিষয় হল উচ্চারণ যাই করি না কেন, এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশে বেশ সৈয়দ বংশের মর্যাদায় আসীন। লেইস মানে ফিতাবিহীন পুরো পায়ের পাতা ঢেকে দেয়া দুই বা এক স্ট্র্যাপ আর দুই বা এক বকলস সমৃদ্ধ সন্ন্যাসী জুতো মানে মংক স্যু নামের যে জুতোটি চোখে পড়ল এই ব্রান্ডের, এটিকে দেখে মনে হল মনে মনে আবছা যে ডিজাইনটি তৈরি হয়েছিল একটু আগ পর্যন্ত সেটি যেন এটিই।
কথিত আছে আল্পস পর্বতের কোনও এক নাম না জানা সন্ন্যাসী নাকি ১৫শ শতকের দিকে এই প্রথম জুতোটি বানিয়েছিলেন। অতপর ইউরোপীয় সন্ন্যাসীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় এই জুতোটি ১৯ শতকের দিকে ইংল্যান্ডের এক জুতো কোম্পানির বদৌলতে এটি ফ্যাশন সচেতন পুরুষদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সন্যাসিদের ব্যবহৃত এই জুতোর নাম মংক্স স্যু না হয়ে, স্বয়ং জুতোটিই কেন যে সন্ন্যাসী নাম পেয়ে গেল তা জানি না। বয়সের বিচারে অক্সফোর্ড স্যু এর চেয়েও ঢের প্রাচীন এই স্যুটিও ক্লাসিক ঘরানার হলেও, হালের অনেক তরুণকে এটি পরতে দেখেছি। এমনিতেও অঙফোর্ড স্যুকে ক্লাসিক ফর্মাল স্যু ধরা হলেও এটিকে বলা চলে ক্লাসিক ফ্যাশনেবেল স্যু, যা নাকি কাল অতিক্রম করে চড়ছে সারা বিশ্বের ফ্যাশন সচতেন তরুণদের পায়ে তো অবশ্যই, পরে তা প্রৌঢ়রা এমনকি ফ্যাশন সচেতন বৃদ্ধরাও। জানি না জামাকাপড় জুতোর নানান ফ্যাশনেবল ডিজাইনের মধ্যে আর কোন ডিজাইন এরকম দীর্ঘজীবন পেয়েছে কি না।
এদিকে ইতিমধ্যে এই বিক্রয়োন্মুখ হাস্যময়ীকন্যা সেলফ থেকে দু রঙ্গয়ের দুটো মংক জুতো এনে আমাকে ইশারায় বসতে বললো, ঐগুলো পায়ে পরানোর জন্য। ফের আনল সে চোখ আন্দাজ করেই জুতো দুটো, কারণ এবারেও আমি বলিনি পায়ের মাপ আর জিজ্ঞেস করেনি তা সেও।
এরই মধ্যে কন্যার অঙ্গুলি হেলনে একটা গদি আঁটা টুলে বসতে বসতে তার হাতে থেকে দুই রঙ্গয়ের দুটো জুতো নিয়ে সেগুলোর তলায় খোদাই করে লেখা নম্বর দেখে বুঝলাম আন্দাজ তার একদম কাছাকাছি। জুতোর আকৃতি ভেদে আমার পা ইউরোপিয়ান ৪০ বা ৪১ মাপের জুতোর উপযুক্ত। কন্যা নিয়ে এসেছে একটা ৪২ আরকেটা ৪৩। এই মংক স্যু দুটোর সামনের দিকটা যতোটা চাপা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে এই জুতোর চল্লিশ না একচল্লিশ নম্বরই লাগবে। অবশ্য ৪২ নম্বরও চলতে পারে। তাই ৪২ নম্বরের জুতোটা তার হাত থেকে নিয়ে, বললাম তাকে সে যেন একটা ৪১ নম্বরের জুতোও নিয়ে আসে। আহা হা রে ! কি যে যন্ত্রণায় পড়লাম ! আমার বাংলিশ উচ্চারণের ফর্টিওয়ান মনে হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। যদিও তাকিয়ে আছে সে হাসিমুখে, তারপরও তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের চোখের যতোটা চোখে পড়ছে আমার চোখে, তাতে মনে হচ্ছে দেখলাম ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিই তার বুঝি! সাথে সাথেই মনে হল লাগাই না কেন ছোঁয়াফোনটা কাজে? আজকালকার জমানায় এই ছোঁয়াফোন যে কোন কাজে লাগে না, সেটাই হতে পারে একটা বিশদ গবেষণার বিষয়। যেই ভাবা সেই কাজ। ছোঁয়াফোনে ইংরেজিতে ৪১ লিখে দেখিয়ে, বাংলায় বললাম যাও কন্যা নিয়ে আস এইটারও একটা বা এক জোড়া। ভেবেছিলাম বাঁচতে পারলাম বুঝি তাতে অনিবার্য ও আসন্ন অস্বস্তিটি থেকে। হ্যাঁ এই অস্বস্তিকর অবস্থাতে পড়ি সবসময়েই যখনই জুতো কিনতে গিয়ে মুখোমুখি হই যাকে বলে পেশাদার কোনও বিক্রয়কর্মীর। পেশাদার জুতো বিক্রয়কর্মীদের সম্ভবত ট্রেনিং এ অতি অবশ্যই ক্রেতার পায়ে অতি যত্নে জুতো পরিয়ে দেবার ব্যাপারটা শেখানো হয়। আর কার কি রকম লাগে ব্যাপারটায় জানি না। বড়ই অস্বস্তিতে পড়ি এ নিয়ে আমি। তার উপর যদি বিক্রয় কর্মী হয় কোনও কন্যা, পায়ে তার পেলব হাতের ছোঁয়া পেতে যতোই মন উৎসুক হোক না কেন অস্বস্তি তারচেয়ে ঢের ঢের বেশি। আসলে নিজেকে কখনোই কোনও অবস্থাতেই তো কোনও ধরনেরই হোমড়া চোমড়া ভাবতে পারিনি, তাই ব্যাপারটা ঠিক নিতে পারি না। ফলে জুতো কেনার সময় সবসময়ই নিজে নিজেই জুতো পরতে পারবো বলে যতোই আশ্বস্ত করি না কেন, পাঁড় পেশাদার জুতো বিক্রয়কর্মীর সাথে পেরে উঠি না। যেমন পারিনি একটু আগেও এই কন্যার সাথে। যতোই দেহভাষায় বুঝিয়ে থাকি না কেন যে, কচি খোকা নই আমি, তারপরও সে তা অবলীলায় উপেক্ষা করে ঠিকই ফেলেছিল আমায় তুমুল অস্বস্তিতে।
একটু আগে তাকে ৪১ নম্বরের জুতো আনার জন্য বলার পর ভেবেছিলাম, সে ঐ জুতো আনতে যাবে যখন সেই ফাঁকে নিজে নিজে এই ৪২ নম্বরের জুতোটা পরে দেখবো। কিন্তু হা হতোম্মি সে দেখছি তা না করে এই সেকশনের বিক্রয় কন্যাকে চুং চাং চিং চাং করে সম্ভবত সেই কথাটিই বলতেই, সে তার হাতের একটা ছোঁয়াযন্ত্রে দ্রুত আঙ্গুল বুলিয়ে সম্ভবত যখন হদিস করতে পারল যে আছে ঐ মাপের জুতো তার স্টকে, চলে গেল এখনাকার বিক্রয়কন্যা পেছনের দিকে। জানি না এই হাস্যময়ী মোঙ্গল বংশোদ্ভূত কি না? তবে এর পাল্লায় পড়ার পর থেকেই তো দেখছি, বসেছ মোগলের সাথে খানা খেতে হবে তাহার সাথে বলতে যা বোঝায়, অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমার সেরকমই। তারই জের ধরে এরই মধ্যে হাস্যময়ীর পেলব হাতের ছোঁয়ায় বা পায়ে আমার ঢুকে গেছে ৪২ নম্বরের এক পাটি জুতো। লেখক : কলামিস্ট ও ভ্রমণ সাহিত্যিক