সেলিম সোলায়মান
স্যুট বিষয়ক খটমট
শুনিয়াছি যে সকল স্বামীপ্রবরগণ স্ত্রীদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হইয়া উঠেন, তাহারা তাহাদের স্ত্রীদিগের নয়নের অগোচরে হইলেই তাহাদের সম্ভাব্য তো অবশ্যই, এমন কি অসম্ভবরকমের কল্পিত গতিবিধি লইয়াও স্ত্রীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই না শুধু সপ্তম ইন্দ্রিয়ও সর্বক্ষণ সজাগ থাকে। কিন্তু যখনই সে সব স্বামীরা থাকেন নিকটে, নয়ন সমুখে, তখন আর স্ত্রীদিগের ঐ অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাধর ইন্দ্রিয়দ্বয় কাজ করে না।
না, এই দাবী আমি ভুলেও করিনা যে এ অধম ঐ রকম দামি স্বামীদের পংক্তিভুক্ত। বরং স্ত্রীর কাছে আসলে আমি সার্বক্ষণিক এক বিড়ম্বনারই নামান্তর। ফলে তার চোখের সামনে থাকলে, সারাক্ষণই তাকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয় কীভাবে এ অধম দাঁড়াচ্ছি, হাঁটছি, হাসছি, কাশছি বা হাঁচছি এ সব নিয়ে। এখনো সে আমার ইত্তাকার সব খুঁত শোধরাতে ব্যস্ত থাকায়, মনে মনে কী যে ভাবছিলাম, টেলিপ্যাথি মারফত সে খবর নেবার ফুরসৎ সে পেল কোথায়? মনে মনে ঘাট মেনে তাই দ্রুত মনের কথা খোলাসা করাই উত্তম ভেবে বললাম আরে না। না আমার জন্য কিছুই কিনবো না। ভাবছিলাম পূষনের হবু বর, মানে বুঝলে না ঐ মিঠু ভাই সাবিনা ভাবীর হবু জামাইর জন্য স্যুটের কাপড় পাওয়া যায় কি না, এক চক্করে একটু দেখে আসি উপরে। যদি তা পাই আর পছন্দ হয় তবে কিনে নেব সাথে সাথেই। এটা তো একদামের দোকান, এখানে দামাদামি করে সময় নষ্ট হবে না। যেরকম জাঁকজমক দেখছি এ স্টোরের তাতে কোয়ালিটি নিয়েও সন্দেহ নাই। অবশ্য এই ধরনের স্টোরে সাধারণত রেডিমেইড কাপড়ই থাকে। তারপরও বিশেষত ব্যাংককে এরকম স্টোরের ভেতরেও যেহেতু স্যুটের কাপড় বিক্রি হতে দেখেছিলাম তো, তাই ভাবছিলাম আর কী।
‘ওহ হো তাইতো ! তাইতো! ঠিক আছে যাও দেখো গিয়ে পাও কি না পছন্দমতো স্যুটপিস। ছেলেদের কাপড় চোপড়ের ব্যাপারে আমার তো কোনও ধারণাই নেই , তাই আমি আর উপরে গিয়ে কী করবো ?”
আমার বক্তব্যের জবাবে লাজুর তাৎক্ষণিক ও উৎসাহব্যঞ্জক উত্তরে বোঝা গেল মিঠু ভাই সাবিনা ভাবীর নাম, ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। হবেই বা না তা কেন? চমৎকার মানুষ এই চিকিৎসক দম্পতিটি বিগত অনেক বছর ধরে আমাদের পরিবারের নানান জনের চিকিৎসা বিষয়ে যে পরিমাণ নিঃস্বার্থ সেবা দিয়েছেন সেই ঋণ তো শোধ হবার নয় কিছুতেই!
তাহলে আমিই গেলাম উপরে। আর কথা থাকলো এই যে তোমরা এ তলার যেদিকেই যাও, যাবে একসাথে। কোনও কারণে কেউ দলছুট হয়ে গেলে, সোজা এসে বসে থাকবে ঐ পান্ডাটির পাশে যে বেঞ্চিটি আছে ঐখানে। দলের সবাইকে ফের তাদের করনিয় মনে করিয়ে দিয়ে, অতপর পা রাখলাম উপরে উঠার জন্য চলন্ত সিঁড়িতে।
দ্বিতীয় তলায় উঠার পর চারপাশে চোখ বোলাতেই বোঝা গেল, নাহ আর উপরে উঠতে হবে না। এ তলাতেই আছে পুরুষদের পোশাক। সিঁড়ি লাগোয়া এই অংশটির ডানে বাঁয়ে সাজানো আছে দেখছি নানান ব্র্যান্ডের ক্যাজুয়াল পোশাক। অতএব এদিকটায় ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট না করে চলে যাওয়া যাক ঐ পাশটায়। আশা করি ঐদিকটাতেই পাওয়া যাবে ফর্মাল পোশাক। স্যুট পিস থাকলে থাকতে পারে ওইদিকটাতেই।
অনেকটা আন্দাজে ঢিল ছোড়ার মতো, লম্বায় চওড়ায় বেশ ছোটখাট ফুটবল মাঠ সদৃশ এই স্টোরটির মাঝের সিঁড়ির বিপরীত দিকে এসে, আসলেই পেয়ে গেলাম ফর্মাল ড্রেসের অংশটা। এদিকটার বাঁয়ের অংশে গলফ খেলার সরঞ্জাম আর পোশাক থাকলেও ডান দিকে নজরে পড়লো ঝুলছে রেডিমেইড স্যুট। ফলে ওইদিকেই একটু এগিয়ে বাঁ দিকে তাকাতেই দশ বারো ফুট দূরে স্যুটেড বুটেড হয়ে ঠাঁই নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানিকুইনটার উপর চোখ আটকে গেল! কয়লা কালো মানে চারকোল ব্ল্যাক জমিনের উপর সাদা স্ট্রাইপের চমৎকার এক স্যুট পরে আছে ওটা। নিজে অনেক দিন রেডিমেইড স্যুটের উপর ভরসা রাখার পর মাসকয়েক আগে হঠাৎ যে স্যুটটি বানিয়েছিলাম ঢাকায়, তখন ঠিক এই প্যাটার্নের কাপড়ই খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাইনি।
আহা সে সময় যদি ঐ স্যুটটা না বানিয়ে একটু সবুর করতাম তাহলে এ কাপড়টা আজ কিনে নিতে পারতাম! সাধে কি আর বলে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’? জানি না, অন্য কারো এরকম হয় কি না। তবে ঘটে এটা আমার প্রায়শই। তার মানে এই নয় যে আমি ক’দিন পর পরই স্যুট বানাই। ঘটনা হচ্ছে যখনই কোনও কিছু কিনতে যাই, মনে মনে যেটা কিনব বলে ঠিক করি, দেখা যায় সেটা বিশ্বসংসারই বুঝি তৈরি হয়নি কখনও! কিম্বা হলেও ওগুলোই সবই বিক্রি হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় যা ভেবেছিলাম মনে মনে মোটামুটি তার কাছাকাছি কিছু একটা কিনে ফেলার পর কিছুদিন পরই দেখা যায় আসলটার দেখা পাই। ঘটল যা এবারেও। তবে এবার আর ‘কুছ পরওয়া নেহি’। এই কাপড়টা যদি পেয়েই যাই এখানে এখন, তবে কিনে নেব নির্দ্বিধায়। হোক না যতোই কিনছি তা পূষনের বরের জন্য।
আচ্ছা কী করে এদের জিজ্ঞেস করবো যে ঠিক ঐ স্যুটটি না, চাই আমার সেটির কাপড়টাই। এই স্টোরের নানান জায়গায় ইংরেজি লেখা আর পণ্যের গায়ে ইংরেজিতে দাম লেখা থাকলেও, এ কদিনের অভিজ্ঞতায় এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, এখানকার বিক্রয়কর্মীরা ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারবে। ইংরেজিতে এদের দৌড় খুব জোর ঐ ইয়েস নো ভেরি গুড মার্কাই হবে।
হয়ার ক্যান আই গেট দিস ফ্যাব্রিক্স? নাহ এটা মনে হয় জটিল হয়ে যাবে, বলতে হবে ডু ইউ হ্যাভ দিস ফ্যব্রিক্স? না না জিজ্ঞেস করতে হবে, ডু ইউ সেল ফ্যাব্রিক্স টু মেইক স্যুট?
মনে মনে ঐ রকম নানান ইংরেজি বাক্যের মশকো করতে করতে ম্যানিকুইনটির কাছে এসে স্যুটের কাপড়টি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই দেখি এরই মধ্যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে এক চায়নাকন্যা। ওরে দিকে বুঝতে পারছি না, এ চায়নিজ রাজ্যে আমার মতো এক বাঙ্গালের সাক্ষাৎ পেয়ে তার চেহারায় কি রাজ্যের বিভ্রান্তি নাকি নার্ভাসনেস জড়ো হয়েছে। এদিকে তাকে দেখতে পেতেই অজান্তেই মুখ ফুটে ‘প্লিজ ব্রিং দিস স্যুটপিস ফর মি’? বলতে বলতে ম্যানিকুইনের কোটের হাতার দিকের কাপড়টা দু আঙ্গুলে ধরে একটু তুলে দেখালাম– কী যে বুঝল চায়নাকন্যা বোধগম্য হল না। শুধু দেখলাম একটু থমকে চায়নিজ ব্র্যান্ডের তার চোখে আমাকে পিটপিট করে জরীপ করে, কিছু না বলেই ঘুরে চলে গেল সে সারি সারি স্যুট ঝুলিয়ে রাখা ঐ সেকশনটির পেছনের দিকে।
আচ্ছা সে কি কাপড়ই আনতে গেল নাকি? কিন্তু সেটাই বা হয় কীভাবে? নিশ্চয় এ ধরনের রেডিমেইড সেকশনে তো গজ ফুট মিটার ধরে কাপড় বিক্রি করে না। ওসব তো বিক্রি হয় ভিন্ন সেকশনে। আমিই বা তাহলে কী জন্য তারে বললাম ব্রিং দিস স্যুটপিস! আরে ধুত এ কী করলাম আমি? এতো যে মনে মনে এ বিষয়ক নানান বাক্য নিয়ে নাড়া চাড়া করলাম একটু আগে, তারপরও কিনা ফ্যাব্রিক্স না বলে বরাবর যে বলি স্যুট পিস সেটাই বলে দিলাম !
এরই মধ্যে দেখি ফিরে এসেছে সেই চায়নাকন্যা। ঝুলছে তার হাতে হ্যাঙ্গারে ঐ স্যুটের আরেকটি কপি আছে যেটি ম্যানিকুইনের গায়ে। বোঝাই যাচ্ছে যতোই আঙ্গুল দিয়ে চিমটি কেটে ঐ স্যুটের কাপড়টি দেখিয়ে থাকি না কেন, এই কইন্যার কানে ঢুকিয়াছে আমারই বলা স্যুট পিসের স্যুট শব্দটিই শুধু !
নিজের ভুল শোধরানোর চেষ্টায় দ্রুত মুখে নো নো বলার সাথে দুই হাত নেড়েও বোঝালাম যে ঐ রেডিমেইড স্যুট চাই না। সাথে অবশ্য যোগ করলাম যে আমি চাই ফ্যাব্রিক্স।
আমার বলা শেষ কথাটা তার কানে গেলেও, বুঝল কি না বুঝলাম না ফের। তবে তার হলুদ মুখে হঠাৎ করে কালো মেঘের ছায়া পড়তে দেখে বুঝলাম, এটা সে পরিষ্কার বুঝেছে যে এই মুহূর্তে বাইশ শো রেন মেন বি দামের এই স্যুটটি বিক্রি করতে না পারায়, ভালো রকমের কমিশন হাতছাড়া গেছে–এদিকে বিফল মনোরথ হয়ে কালো মুখে ঘুরে সে হাঁটা দিতেই পাশের অন্য আরেকটি ব্র্যান্ডের স্যুটের কাউন্টারের বিক্রয়কন্যার চুং চাং চিং চাং প্রশ্নের জবাবে সে চুং চাং করে যাই বলে থাকুক, তা যে আমার জন্য সুখকর কিছু নয়, তা বোঝার জন্য তো আর চায়নিজ ভাষা বিশারদ হতে হয় না। এছাড়া ঐ কাউন্টারের বিক্রয়কন্যার দেহভঙ্গিও পরিষ্কার ঘোষণা দিল যে, আমার মতো লোক তার ওখানে মোটেও আমন্ত্রিত তো নই বরং বলা চলে অবাঞ্চিতই !
তুমুল অস্বস্তির সাথে বড়ই হতাশ হলাম মোটামুটি উঁচুতলার এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিক্রয়কন্যাদের এহেন অপেশাদারি আচরণে! ভাবছি এদের সাথে তাহলে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের, নিউমার্কেটের এমন কি ফুটপাতের বিক্রেতাদের পার্থক্য থাকলো আর কোথায়?
লেখক: কলমিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।