জানি না কবিগুরু ঐ রমণীর মন বুঝতে গিয়েই কবি হয়ে উঠেছিলেন কি না! অবশ্য তেমন স্বীকারোক্তি তিনি কক্ষনো কোথাও দিয়েছেন বলে শুনিনি, যেমন দিয়েছিলেন মহামতি সক্রেটিস! তবে হ্যাঁ হেমলকের বাটি নির্দ্বিধায় হাতে তুলে নিতে ভয় পাননি যে সক্রেটিস তিনিও সম্ভবত স্ত্রীকে ভয় পেয়েই দার্শনিক হওয়ার পরও নিজেকে দার্শনিক দাবী করেননি। বরং ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ইশারায় ইঙ্গিতে বলেছেন কোনো পুরুষের দার্শনিক হয়ে ওঠার পেছনে সে ব্যক্তির স্ত্রীর অপার ভূমিকার কথা। সে জায়গায় না কবি না দার্শনিক, আমি স্ত্রীর মতিগতির কূল কিনারা পাওয়ার তো কথাই না।
অতএব আজকের মহাপ্রাচির অভিযান শেষে স্ত্রী আমার যতোই বারবার বলে থাকুক বিশ্রাম নেবার কথা, তদুপরি আসলেই যখন আছে তার পায়ের সমস্যা, সে জায়গায় হোটেলে ফিরে এ সন্ধ্যায় সে বিশ্রাম নেবেই, আগ বাড়িয়ে আমার এমন ভাবাটা বড়ই ভুল হয়েছে। দ্রুত তাই ভুল শুধরে বললাম, না না, তা হবে কেন? চল, চল এক্ষুনি চল তাহলে। তদুপরি যাচ্ছি যখন আপেল স্টোরে, সেখানে একা আমি অধম গিয়া কী করবো? অবশ্য মানব ইতিহাসের আপেল বিষয়ক এই বিশ্বাস ব্যাপারটি, এ মুহূর্তে মুখ ফুটে উচ্চারণ করার যে সাহস হয়নি, তা তো বলাই বাহুল্য।
এদিকে, পুত্ররা তো সেই দুপুর থেকেই সর্বক্ষণ মুখিয়ে ছিল অ্যাপেল স্টোরে যাওয়ার অপেক্ষায়, অতএব বাইরে বেরুবার ঘোষণা দিতেই ওরা হৈ চৈ করে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেই আমরাও নিলাম পিছু ওদের।
রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের সপ্তাহধিকালের এই হোটেলবাসকালীন সময়ে প্রথমবারের মতো দেখা মিলল এক প্রতিবেশীর। আমাদের রুম থেকে বেরিয়ে ডান দিকে এগুতে হয় লিফট ধরার জন্য। ঐদিকটার একরুম পরের রুম থেকে বেরুলো দেখছি এক চায়নিজ দম্পতি।
নাহ দম্পতি নয় শুধুই, বাচ্চাও আছে একটি এই তরুণ দম্পতির। কত হবে বয়েস বাচ্চাটির? হবে হয়তো ছয় বা সাত মাস। ঝুলছে সে তার বাবার বুকের কাছে, ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার মতো। অবশ্য ক্যাঙ্গারুদের মধ্যে মায়েরাই বাচ্চাদের বহন করে তার পেটের কাছের থলেতে। এখানটায় তার ব্যত্যয় ঘটেছে। বাচাটি খাড়া ভাবে ঝুলছে তার পিতার বুকে আর পেটের মাঝামাঝি অবস্থানে।
মা ক্যাঙ্গারুদের বাচ্চাবহনের প্রাকৃতিক এই তরিকাটি থেকেই সম্ভবত মানুষেরা বাচ্চাবহনের এই চমৎকার ব্যবস্থাটি করেছে, বিশেষ ধরনের এই ব্যাগ বা থলেটি তৈরি এবং বাজারজাত করে। ভাবতে ভাবতে চায়নিজ দম্পতির পিছু পিছু হেঁটে আমরা দুজনে লিফটের কাছে পৌঁছে দেখি, ফাঁকা ঐখানটা। মানে পুত্রদ্বয় এরই মধ্যে তাদের ফুপ্পির সাথে নিম্নমুখী যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। আগেই তো বলেছি এই হোটেলটার লিফট ব্যবস্থা বেশ চমৎকার। খুব বেশী অপেক্ষা করতে হয় না, লিফট পাওয়ার জন্য এখানে। অতএব ওরাও দ্রুতই পেয়ে গিয়েছিল লিফট।
আমাদের অগ্রবর্তী চায়নিজ এই দম্পতি এরই মধ্যে নিম্নগমনের মানসে লিফটের বোতাম চেপে দেয়ায়, অপেক্ষা করতে থাকলাম আমরাও তাদেরই সাথে। এরা হয়তো নামছে নীচে হোটেলের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্য। এদিকে পেছনে আমাদের উপস্থিতি আন্দাজ করে, চায়নিজ দম্পতি পিছু ঘুরতেই, তাদের শুভসন্ধ্যা জানলাম। উত্তরে মুখে কিছু না বললেও হাসিমুখে স্বামী স্ত্রী দুজনেই মাথা ঝুঁকিয়ে প্রত্যোত্তর জানিয়ে নিজেদের মধ্যে চুং চাং চিং চাং করতে শুরু করলো নিম্নস্বরে। এদিকে বাবার বুক আর পেটের মাঝামাঝি জায়গায় পিঠ লাগিয়ে বেবি ক্যারিয়ারের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটি তার চায়নিজ ব্র্যান্ডের মিষ্টি দুটো চোখ দিয়ে পিট পিট করে দেখতে লাগলো আমাদের।
ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে মনে হল, আমাদের দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। সম্ভবত ওর এই ছোট্ট জীবনে এই প্রথমবারের মতো ভিন্ন চেহারার আর রঙের কোনো মানুষ দেখলো সে। তাই হয়তো খুবই অবাক হয়েছে ও। আচ্ছা কী ভাবনা চলছে বাচ্চাটির ছোট্ট মাথাটিতে?
এরই মধ্যে লিফট হাজির হওয়ায় সেই ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে ওদের পিছু পিছু ঢুকলাম আমরাও লিফটে। মাঝারি আকারের এই লিফটে দুই জাতের পাঁচমানুষ নিয়ে লিফট নিম্নমুখী যাত্রা শুরু করতেই লাজু ফিস ফিস করে বলে উঠল
‘দেখো না কী কিউট লাগছে বাচ্চাটিকে। ওর চুল গুলোর মতোই ছোটবেলায় আমাদের অভ্রর চুলগুলোও তো ওরকম খাড়া খাড়া ছিল। তাই না?’
আরে তাইতো, কিউট এই বাচ্চাটির চায়নিজ ব্র্যান্ডের নাক আর চোখ বাদ দিলে, সব মিলিয়ে ওকে কিন্তু ছোট্টবেলার অভ্রর মতোই মনে হচ্ছে। বাঙালি ব্র্যান্ডের বড় বড় চোখ আর খাড়া নাক থাকার পরও এরকম বয়সে অভ্রর চেহারায় কেমন যেন চায়নিজ, না বলা চলে কোরিয়ান ব জাপানি জাপানি ভাব ছিল, যা বড় হতে হতে উধাও হয়ে গিয়েছে। আহা, কী চমৎকার না ছিল আমাদের ঐসব দিনগুলো! বাসায় যতক্ষণই থাকতাম, দুই ভাই প্রতিযোগিতা করে গা লেপটে থাকতো। এখন যতই বড় হচ্ছে মনে হচ্ছে যেন সরে যাচ্ছে ওরা দূরে।
এরই মধ্যে লিফট নীচতলায় এসে হাজির হতেই, চায়নিজ ঐ দম্পতির পিছু পিছু লিফট থেকে নেমে আশেপাশে কোথাও হেলেন বা পুত্রদের টিকিটিরও দেখা না পেয়ে, অবাক হলাম না মোটেও। স্বতঃসিদ্ধভাবে জানিই তো এ মুহূর্তে আছে কোথায় ওরা।
যা আন্দাজ করেছিলাম তা সঠিক প্রমাণ করে চায়নিজ দম্পতি লিফট থেকে নেমে বাঁয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটা দিল, আমরা এগুতে শুরু করলাম তাদের বিপরীতে; মানে হোটেল থেকে বেরুবার গেটের দিকে।
গেইট পেরিয়ে বাইরে বেরুতেই একদিকে যেমন ঝাপটে ধরলো বেইজিং হাড়হিম, তেমনি বা পাশের ফেরারি শো রুমের সামনে থেকে দৌড়ে এস দু ভাই, জ্যাকেটের দু’পাশ খামচে ধরতে ধরতে দীপ্র বলল ‘চল চল বাবা, এখন অ্যাপেল স্টোরে যাই। আর কাল সকালে কিন্তু আমরা এই শো রুমের ভেতরে ঢুকে ফেরারির সাথে ছবি তুলবো মনে থাকে যেন’
ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলো, এখন সামনের দিকে, বলতে বলতে ওদের নিয়ে এগুচ্ছি যখন, তখন অভ্র ফিস ফিস করে জানাল, আগামী কালকের সকালে ফেরারির সাথে ছবি তোলার পর, প্রথমেই যেতে হবে পেটশপে। ঢাকায় ফেলে আসা প্লুটো নামের ওর বাচ্চা কুকুরটির জন্য কী কী যেন ও কিনতে চায়, সে কথা তো সে সেই কুনমিং থেকে রওয়ানা করার সময় এয়ারপোর্টে বসেই ফয়সালা করে রেখেছিল। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, তাই হবে। চিন্তার কোন কারণ নাই।
ইতিমধ্যে রিজেন্ট হোটেলের সামনের চমৎকার বাগানটি পেরিয়ে ফুটপাত ধরে ডান দিকে হেঁটে আমরা চলে এসেছি রাস্তা পেরুবার জেব্রাক্রসিংটায়। ভাবছি এতো দ্রুত চলে এলাম কী করে? দেরী হলে অ্যাপেল স্টোর বন্ধ হয়ে যাবে মনের ভেতরের এই তাড়ায়, তবে কি হেঁটেছি আমরা খুব দ্রুত, নিজেদেরই অজান্তে? নাকি এরই মধ্যে এই এলাকাটা চেনা হয়ে যাওয়ায় চলে এলাম তাড়াতাড়ি। অচেনা পথে তো দ্রুত হাঁটা যায় না আসলে মনে হয়। হাঁটতে হয় সেই পথে রয়ে সয়ে, থমকে থমকে।
রাস্তায় এ মুহূর্তে খুব একটা গাড়ি চলছে না। ডান দিকে তাকিয়ে দেখি বেশ দূর থেকে হেডলাইট আর কুয়াশা বাতি জ্বালিয়ে একটা গাড়ি আসছে দ্রুত দেখা যাচ্ছে। তবে ঢাকায় হলে এরই মধ্যে অবশ্যই রাস্তা পার হওয়া শুরু করে দিতাম। কিন্তু বিদেশ বিঁভুইয়ে তো তা করা যায় না। তাই রাস্তা পারাপারের লাইট জ্বলে উঠার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি সবাই।
দেখছি আর ভাবছি, গোটা রাস্তার দুপাশে থাকা বড় বড় গাছগাছড়ার মাথার উপর থেকে হিমঅন্ধকার রাস্তার উপর নেমে এসে পিচের কালো রঙ্গয়ের সাথে একাকার হয়ে যেত, যদি না থাকতো এখানে কিছুদূর পরপর অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোষ্টগুলো। নিজেদের ঘোলাটে হলুদ আলো দিয়ে ধোঁয়াশায় হিম অন্ধকারের সাথে পাল্লা দিয়ে, রাস্তা আলোকিত করতে গিয়ে বেশ কসরত করতে হচ্ছে তাদের। তারপরও একদম নিকষ অন্ধকার নামেনি কোথাও ওদেরই কারণে।
এরকম হাড় হিম করা অবস্থায় বেশিক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে, ঠাণ্ডা আরো জাঁকিয়ে বসে শরীরে। সে কারণে সবাই নিজেদেরই অজান্তে ডানে বাঁয়ে নড়াচড়া করছি সারাক্ষণ। এরই মধ্যে সামনে তাকিয়ে দেখি মাঝ রাস্তার দ্বীপে একাকী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক লাইটপোস্টের চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছে সবুজ রঙের চলমান মানবাকৃতির ছবি। অতএব দ্রুত পায়ে এগুতে শুরু করলাম জেব্রাক্রসিং ধরে।
রাস্তার এ পাশে এসে শুনশান জনমানবহীন চওড়া ফুটপাত পেয়ে দু ভাইপোকে নিয়ে হেলেন জগিং করতে করতে এগুতে শুরু করেছে। নীরবে হাঁটছি দুজনে পাশাপাশি আমরা রয়ে সয়ে।
‘শোন, ছোটখাট গিফট কেনার মতো দোকান বা মার্কেট কোথায় আছে এখানে, একটু খোঁজ নিয়ে রেখো। অনেক গুলো গিফট কিনতে হবে।’ নীরবতা ভেঙে লাজু বলে উঠতেই দম দেয়া কলের পুতুলের মতো নিজেরই অজান্তে বললাম, ‘ঠিক আছে’। যদিও জানি না এদিকটায় ঐরকম কোনো দোকান বা মার্কেট আছে কী না! তারপরও সে কথা এখনি জানান দিয়ে আবারো ঝামেলায় পড়ার মানে তো নেই। প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য তাই ওর আহত পায়ের খবর নিতেই, তার উত্তর না দিয়ে ও বলে উঠলো
‘দেখো দেখো, ওইখানটায় কী জানি হচ্ছে! এতো গাড়ি। আর নতুন করে সাজিয়েছে মনে হয় এলাকাটা। সেদিন তো এরকম ঝলমলে ছিল না এই জায়গাটা।’
ওর কথার সূত্র ধরে ডান দিকে তাকাতেই আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টা দিকে যে ষাটগম্বুজওলা দালানটি আছে, যেটি নাকি সম্ভবত একটি হোটেল, সেটির চত্বরের প্রচুর গাড়ি আর নানান রঙের উজ্জ্বল আলোকসজ্জা দেখে, বললাম কোনো পার্টিটার্টি হচ্ছে নিশ্চয়। ওরা এইভাবে দৌড়ে এগিয়ে না গেলে, টুপ করে ঢুকে যেতাম না হয় সদলবলে এখানে।
‘আরে ধুর। কী যে বলো না। ফাইজলামি রাখো। আর ওদেরকে একটু বল অতো দৌড়ঝাপ না করতে।’
তথাস্তু বলে, গলা উঁচু করে ওদেরকে গতি কমাতে বলতে বলতে নিজেরাও বাড়ালাম নিজেদের গতি। তাতে দ্রুতই আবার একাট্টা হয়ে এগুতে শুরু করলাম আমাদের এখনকার মঞ্জিলে মাকুসদ অ্যাপল স্টোরের দিকে।
ঐ যে বলেছিলাম না, যেকোনো কারণেই হোক না কেন, চেনা পথে হাঁটতে গেলে সম্ভবত দ্রুত এগুনো যায়। আমার সেই হাইপোথেসিসকে প্রমাণিত করার জন্যই মনে হয়, এ পাশের একটা পাশ রাস্তা পেরিয়ে ডানে তাকাতেই বেশ দ্রুতই নাক বরাবর দেখা মিলল অ্যাপেল স্টোরের, এক কামড় খাওয়া বিশাল অ্যাপেল লোগোটির। তা দেখে কাউকে কিছু বলে উঠতে পারার আগেই দেখি এরই মধ্যে দীপ্র অভ্র দিয়েছে যাকে বলে এক্কেবারে ভোঁ দৌড়! সেই অ্যাপেল বরাবর। সাথে সাথে জগিংয়ের ভঙিতে এগুতে শুরু করলো ওদের দিকে হেলেনও।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।