গত দু দিনে লি খাঁর সাথে মিস ইনার কথোপকথনে, একটু কেমন কেমন মনে হলেও ওটা নিয়ে ভাবিনি মোটেই। এমনিতে এ ধরনের হোটেলের লোকজন তাদের অতিথিদের জন্য গাড়ি ডেকে এনে সেই ড্রাইভারের সাথে যে বাৎচিত করে, তাতে থাকে পেশাদারিত্ব। অনেক ক্ষেত্রেই সেসব কথাবার্তাকে মনে তোতা পাখিমার্কা। ওইরকম কথাবার্তা থেকে মিস ইনা আর লি খাঁ র কথাবার্তার ধরণ যে একটু ভিন্ন, তা নজরে এলেও পাত্তা দেইনি ব্যাপারটাকে। যদিও অবচেতনভাবে মনে হয়েছে পোষাকে আশাকে ভাবে ভঙ্গিতে তো মনে হয়, মিস ইনা এই হোটেলের মাঝারি মানের কোনো পদেই আছে। তার কাজ তো গাড়ি ডাকা না। আর গাড়ি আসার পর, হোক তা যতোই স্বল্প সময়ের জন্যই, যে ভাবে ও ভঙ্গিতে সে কথা বলছিল, তাতে মনে হচ্ছিল না যে, হোটেলের কোনো মাঝারি না হলেও ছোট বস কথা বলছেন কোনো ড্রাইভারের সঙ্গে! এখন তো সে কারণ একদম ফকফকা পরিষ্কার চোখের সামনে। ফলে দুই ভাইবোনের মধ্যে সামান্য সময়ের জন্যে হলেও সুখ দুঃখের আলাপ করার সুযোগ করে দেবার মানসে, মিস ইনাকেও ধন্যবাদ ও শুভরাত্রি জানিয়ে ফের রওয়ানা করলাম হোটেলের ওম ওম আরামের ভেতরে।
মোবাইলের পর্দায় এরই মধ্যে দেখেছি, বাজছে সন্ধ্যা ৭টা দশ। এখানে মার্কেট, না বলতে হয় পুত্রদের আরাধ্যস্থান এপল স্টোর কটা পর্যন্ত খোলা থাকে, তা তো জানি না ! যদি তা আটটায় বন্ধ হয়ে যায় তবে হাতে সময় বেশি নেই। মিনিট পনেরর মধ্যে পুত্রদের নিয়ে নামতে হবে, তাতে যদি ঝাপ ফেলার আগে হলেও কোনোমতে ঢোকা যায় ঐ আপেলের দোকানে। ভাবতে ভাবতে দ্রুত লিফটের দিকে এগিয়ে বোতাম টিপে দিলাম উর্ধগমনের উদ্দ্যেশে।
কুনমিং শেরাটনে লিফট নিয়ে বিভ্রাট পড়লেও, বেইজিং এর এই রিজেন্ট হোটেলের লিফট সার্ভিস এ পর্যন্ত যা দেখেছি, তাকে বলা যায় এক্কেবারে ঝক্কাস। ব্যতিক্রম হল না এবারেও। দ্রুতই লিফট বাবা সামনে এসে হাজিরা দিয়ে মহা তমিজের সাথে ধীরে ধীরে দরজা খুলে, ভেতরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাতেই ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে মনে হল, আচ্ছা এখানেও যদি এখন লিফট বিভ্রাট হয়ে আটকে থাকি কিছুক্ষণ তাহলে তো মন্দ হতো না।
প্রথমত আমার সাথে এই বিভ্রাটে তো দারাপুত্রপরিবারের আর কেউ পড়ছে না। অতএব দুশ্চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। দ্বিতীয়ত কোনো বিভ্রাটে যদি পড়িই, তাতে কুনমিং শেরাটন যেমন হেলেন অভ্রর লিফটে আটকা পড়ার কারণে আক্কেল সেলামি গুনেছিল, প্রথম আমাদের দুই রুমে দুই ফল ঝুড়ি পাঠিয়ে। তারপর এক রাতের ডিনার মুফতে খাইয়েছে। আর সবশেষে চেকআউটের সময়ে এক রুমের এক রাতের ভাড়া মওকুফ করে দিয়ে চূড়ান্ত ক্ষমা চেয়েছে, এখানেও নিশ্চয় ঐরকমই কিছু হবে!
এরই মধ্যে লিফট গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ায়, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা না হলেও নিজের কপালে নিজেই দুর্ভোগ ডেকে আনা আমার ঐ ভাবনায় যতি পড়ে গেল অকস্মাৎ। লিফট থেকে নেমে রুমের দিকে এগুতে এগুতে এসময় মনে হল, আসলে বাইরে যতোই ভং ধরে বকধার্মিক সেজে থাকি না কেন, ভেতরে ভেতরে আমি যে লোভী, তার তো প্রমাণ হয়ে গেল এইমাত্র! না হয় এরকম চিন্তা আসলো কেন মনে? মুফতে কিছু পাওয়ার লোভ, হোক তা সামান্য দুর্ভোগের বিনিময়েও, তা কেন ছাড়তে পারলাম না তাহলে আজো? হঠাতই বড়ই ক্লিন্ন মনে হয়ে মন খারাপ হয়ে গেল ফের।
মন খারাপের এই দ্বিতীয় ধাক্কা নিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখি সব শুনশান ! মনে হচ্ছে কেউ নেই রুমে। কী ব্যাপার ? সবাই কি তাহলে ঐ রুমে গেছে নাকি? ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দরজার দিকে নজর পড়তেই মনে হল, নাহ ওটা খালি নয়। আপেলের দোকানে যাওয়ার উত্তেজনায় টগবগ দুই ভাই গাঁটছড়া বেধেছে জোর, মনে হচ্ছে। আছে দুজনেই আছে ঐ রুমে ফুপ্পির সাথে। ওদের তাড়া দেবার জন্য সোফায় বসে ওইরুমে ফোন লাগাতেই বেশ কায়দা করে দীপ্র বলল ‘নি হাও !’
হাসি চেপে বললাম শোন বাবা, যদি অ্যাপেল স্টোরে যেতে চাও, তবে তাড়াতাড়ি বাথরুম সেরে নাও। জামা কাপড় বদলানোর দরকার নেই এখন। দশ মিনিটের মধ্যে বেরুবো। আটটার পরে গেলে অ্যাপেলস্টোর খোলা নাও পাওয়া যেতে পারে।
‘ওহ বাবা ! তুমি? আমি ভেবেছিলাম হোটেলের কেউ বুঝি।’
বোঝা যাচ্ছে বাবাকে ফোনে কায়দা করে, চায়না এসে শেখা ‘নি হাও’ বলে যে লজ্জা পেয়েছে তা কাটাতে চাচ্ছে দীপ্র ! দ্রুত ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, তাতে কী? ভালই তো হয়েছে। এই ভ্রমণে তুমি তো অন্তত একটা জিনিষ শিখতে পেরেছো।
‘শোন বাবা, ফোন রাখছি। আমি আর অভ্র চলে আসছি। আমরা রেডি।’ বলে খট করে ওপাশে ফোন রেখে দিল দীপ্র।
গা,হাত, পা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ আর সাথে একটু ব্যথাও করছে। যদিও আজ বেইজিং এর তিন তিনটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গিয়েছি, মূল দেখা ঘোরাঘুরি দেখেদেখি হয়েছে আসলে ঐ মহাপ্রাচিরেই। বাকি দুই জায়গায় গেলেও ঠিক মতো তো দেখা হয়নি। যা হয়েছে ঐসব জায়গায়, তা হল ছোটবেলায় যে বৌ চি খেলতাম, ঐরকম দৌড়ে গিয়ে বৌ ছুঁয়ে দিয়ে আসা। এসময় টুং টাং রুমের বেল বেজে উঠে জানান দিল পুত্রদের আসার খবর। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে দু’জনে আমার পেছন পেছন রুমের পেটের ভেতরের দিকে এগুতে এগুতে দীপ্র জানালো করলো : ‘আমরা কিন্তু একদম রেডি।’
তার পিঠাপিঠি অভ্র বলল, ‘এখনি যাবো কি ?’ আমার মুখ থেকে কোনো উত্তর বেরুবার আগেই, পড়ল দু বেচারা মায়ের পাল্লায়। ‘এই দীপ্র অভ্র তোমরা কি বাথরুম সেরে হাত মুখ ধুয়েছ? হাতেপায়ে মুখে লোশন মেখেছ কি? আস এদিকে।’
মা পুত্রের এই দ্বৈরথ না বলা ভালো ত্রৈরথের ফাঁক গলে খালি বাথরুম পেয়ে টুক করে ঢুকে গেলাম।
সারাদিনের ধকলের পর হেলেন যাবে কি না বাইরে এখন, তা জানি না। অ্যাপেলস্টোরে যাওয়ার উত্তেজনায় হউক, কিম্বা বয়সের কারনেই হউক পুত্ররা তো আছে মহা চাঙ্গা। ওদের নিয়ে দ্রুত যেতে হবে অ্যাপেল স্টোরে। আজই দীপ্র কিনবে কি না অ্যাপেলের বিটস হেডফোন, বা আদৌ আছে কি না ওর প্রার্থিত মডেল ওখানে, তা তো জানি না।
অ্যাপেল স্টোরে হাজিরা দেয়ার পর যেতে হবে ম্যাকে ডিনারের জন্য। কে এফ সি তে যাওয়া যাবে না। ওটা বেশ দূরে। আগেই যেহেতু ঘোষণা করা হয়েছে আগামীকাল রোমে এসে রোমান সাজার মতো এই হোটেলেই করবো সবাই সকালের নাস্তা, হোক তা যতোই আক্রা, অতএব এ রাতে আর ব্রেকফাস্ট কিনে আনার ঝক্কি নেই। ওদের নিয়ে ডিনার সেরে ফেরার সময় হেলেন আর লাজুর জন্য নিয়ে আসবো রাতের খাবার। ফিরে এসেই তবে এইসব জবড়জং জামা কাপড় ছেড়ে, একটা চমৎকার গোসল দিতে হবে গরম পানিতে।
প্রাকৃতিক ঘরের কজকর্ম করতে করতে এই পরিকল্পনাটি মাথায় সাজিয়ে বাথরুম থেকে বেরুতেই দেখি ভাইপোদের সাথে বাইরে যাওয়ার জন্য উসখুস করছে হেলেনও।
কী ব্যাপার? তুই ও যাবি নাকি? তাহলে চল, চল। এ কথা বলতেই বিছানার ঐপাশে বসে হাত ব্যাগ গোছানোতে ব্যস্ত লাজু বলে উঠল -‘কী ব্যাপার ! আমাকে নেবে না নাকি!”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভাবি, হায়! কম ঠেলায় পড়ে কি আর কবিগুরু লিখেছিলেন ‘রমণীর মন! সহস্র বৎসরের সখা সাধনার ধন !’
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক