দেশে দেশে নারী-যাপন

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১২ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেখা যায় যেসব রাষ্ট্র তাদের শাসন ব্যবস্থায় ধর্মকে যুক্ত করেছে সেসব রাষ্ট্রগুলোতেই নারীরা বেশি নিগৃহীত হয়। আইনকানুন, নিয়মের বেড়াজাল শৃঙ্খল হয়ে নারীকেই চেপে ধরে। দেশে দেশে বিভিন্ন নারী সংগঠন, নারী আন্দোলন, ব্যক্তি নারীর ক্লান্তিহীন উদ্যোগের পরও নারীর জীবন থেকে বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন অবসান ঘটেছে এমন নয়। কোন্‌ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কতটা সুশাসন জারি আছে তার উপর নির্ভর করে নারীর জীবনমান। যদিও পৃথিবীব্যাপী নারীর সমাধিকারের প্রশ্নটা অমীমাংসিত আজও।

. হুমায়ূন আজাদের নারী বিষয়ক গ্রন্থে তিনি পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর অবস্থা ও অবস্থান। “ইহুদি খ্রিস্টান মুসলমানের চোখে নারী এক অবাধ্য বক্র হাড়, যে স্বর্গে সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা, হিন্দুদের চোখে আরও নিকৃষ্ট!”

তাই এই অবাধ্য বক্র হাড় ও নিকৃষ্ট প্রাণীদের জন্য দেশে দেশে নানা আয়োজন। নানা ব্যবস্থাপনা। ইরান মধ্যপ্রাচ্য,আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নারীর মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত।

এসব বিবেচনায় আমাদের দেশের নারীর অবস্থান মোটামুটি ভালো বলতে পারি। বিভিন্ন সূচকে নারীরা এগিয়ে আছে এসব দেশের তুলনায়। নারীর কর্মসংস্থানের ফলে নারীর জীবনমান উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীরা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। নারী শিক্ষায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। যেমনই হোক দুইএক দশক ধরে তো নারীর শাসনেই চলছিল এদেশ। তবে এটাও ঠিক নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান কিন্তু আমাদের আজও হতাশ করে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনা জরুরি।

আমার আগের একটা লেখায় আফগানিস্তানের নারীদের দুরবস্থার কথা লিখেছিলাম। কীভাবে তালেবান শাসিত সরকার শিক্ষিত, উপার্জনকারী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীদের একরকম গৃহবন্দী করে অসহায় ও নিঃস্ব করে তুলেছে। খাওয়াপরাশিক্ষাচিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয়সরকারিবেসরকারি সবরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে নারীদের জন্য। জাতিসংঘ মিশন বলছে বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক অর্থ সংকটের মূলে তাদের এই দমনপীড়ন জাতীয় আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। নারীরা তাঁর নিজের নাম অন্য কোনো পুরুষকে বলাও শরিয়া আইন বিরোধী বলে মনে করে। এমনকি চিকিৎসকের কাছে পর্যন্ত নাম বলা নিষেধ! পিতা বা ভাইয়ের নামে তাদের ব্যবস্থাপত্র নিতে হয়।

আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের নারীর মানবাধিকার এদের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো বলা যায়। যদিও আফগান সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো তালেবান অধ্যুষিত। ঐসব জায়গায় সহশিক্ষা খুবই দুরূহ বিষয়। সহ শিক্ষাকে তারা গুরুতর অপরাধ বলে মনে করে। পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। ১৯১২ সালে হামলার শিকার হয় মালালা ইউসুফজাই। এমনকী ২০১৮ সালেও ১২টি স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অশিক্ষা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বাল্যবিবাহ, লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে নারী শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। ৩২ শতাংশ কন্যাশিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। মাত্র ১৩ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ পায়। বলা যায় যুগের পর যুগ সামাজিক রক্ষণশীলতা, কুপ্রথা আর অন্ধবিশ্বাসে আবদ্ধ হয়ে আছে নারী সমাজ। পাকিস্তানে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা খুব একটা উৎসাহব্যাঞ্জক নয়। বিশ্ব ব্যাংকের মতে পাকিস্তানের শহরাঞ্চলে নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। যা গত দুই দশক ধরে ১০শতাংশ মাত্র চাকরি করার সুযোগ পেয়েছে।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণ করে পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণা করে। জারি করে হুদুদ অধ্যাদেশ। এই আইনের ফলে নারীর মানবাধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। নারীদের প্রতি বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। বিতর্কিত এই আইন ব্যবহার করা হয় অবিবাহিত নারী, বিবাহিত নারী, কিশোরী, প্রৌঢ়, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সমাজের সর্বস্তরের নারীদের উপর। তাছাড়া অনার কিলিং নামে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে হত্যা করার মতো নিষ্ঠুরতম আইনও প্রচলিত আছে পাকিস্তানে। ইদানীং আমরা প্রায় দেখি,পাকিস্তানি শাসকেরা, রাজনৈতিক নেতারা, বাঙলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করতে। তাদের এই প্রশংসা আমাদের উদ্দীপিত করে বৈকি! পাকিস্তানের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ নানা দুর্দশা যখন মিডিয়ায় দেখি তখন মনে হয় আমরা সত্যিই খুব ভাগ্যবান জাতি। সঠিক সময়ে ওদের থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছে আমাদের মুক্তিকামী মানুষেরা। ওরা আমাদের চেয়ে ঢের পিছিয়ে। ওদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, নারীর অগ্রগতি, প্রগতিশীল চিন্তাভাবনায় সবকিছুতেই এগিয়ে আছি আমরা । একাত্তরে যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে এদেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল আজও তারা ধর্মকে পুঁজি করে কূপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আজও ওরা নারী শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চার বিরুদ্ধে। এতো কিছুর পরও আমরা আসমা জাহাঙ্গীরের মতো মানবাধিকার নেত্রীকে পাই পাকিস্তানে যিনি সবসময় বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন।

তিনি পাকিস্তানের আদিবাসীদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, নারীর অধিকারের জন্য লড়ছেন, প্রচলিত আইনগত ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তাছাড়া পৃথিবীর যেকোনো ধর্ম, ভাষা সংস্কৃতির নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। আজীবন শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন। ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

দেশে দেশে মানুষ এমন ধারণা থেকে মুক্ত হোক, পুরুষ সৌর লোকের সূর্য আর নারী অন্ধকার। সমস্ত কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে নারীপুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠুক পৃথিবীর সব প্রান্তে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমপ্রীতির বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআলোকোজ্জ্বল আশাপূর্ণা