ঈদের আগের দিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার দেশের সব নাগরিককেই টিকার আওতায় আনবে। বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। খুব শিগগিরই দেশে টিকা আসতে শুরু করবে।
উল্লেখ্য, মহামারীর প্রথম ঢেউ সামাল দেওয়ার মধ্যেই গত বছরের নভেম্বরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অঙফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে চুক্তি করে বাংলাদেশ। দুই চালানে সেরাম ইনস্টিটিউট ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাঠানোর পর ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়ে। তাতে ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া টিকাদান কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার শঙ্কা জাগায় এপ্রিলে সরকার অন্য উৎস থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে।
সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, সবচেয়ে কার্যকর এবং পরীক্ষিত অঙফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়েই আমরা গণটিকাকরণ কার্যক্রম শুরু করেছি। আপনারা জেনেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিকা রপ্তানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। রাশিয়া এবং চীনের টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। উপহার হিসেবে চীনের কাছ থেকে টিকা ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি।
বলা বাহুল্য, বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের লক্ষ্যে এপ্রিলের শেষে এবং মে মাসের শুরুতে রাশিয়ার স্পুৎনিক-ভি এবং চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় সরকার। চীনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া সিনোফার্মের তৈরি পাঁচ লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা বুধবার ঢাকায় পৌঁছায়। টিকা পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও অনুরোধ জানানোর কথা ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি এটাও জানান, টিকার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফরম কোভ্যাঙের কাছ থেকেও টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে জনগণ আশান্বিত হয়ে উঠেছে। তারা ভাবতে শুরু করেছে, ভ্যাকসিন যেভাবেই হোক সরকার ব্যবস্থা করে দেবেন। বিশেষজ্ঞরাও বলেন, দেশের সবাইকে যে কোনো মূল্যে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতেই হবে। ভ্যাকসিন নিলেই সংক্রমণ প্রতিরোধে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গেলাম, তা নয়। ভ্যাকসিন নিলে একটা প্রতিরোধ শক্তি শরীরে গড়ে উঠবে এবং সংক্রমণের কবলে পড়লেও তা বিপজ্জনক পর্যায়ে না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ অনুসরণও অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমাদের যে পরিস্থিতি, তা উদ্বিগ্ন না করে পারে না। কোনোভাবেই মানুষকে বোঝানো যাচ্ছে না- প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। গতবার লকডাউনে স্বাস্থ্যবিধি যাতে মানুষ মেনে চলে, এজন্য সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল এবং এর সুফলও মিলেছিল। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক ‘সামাজিক ভ্যাকসিন’ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই মাস্ক ব্যবহারে এখনও অনেককেই যেভাবে নির্লিপ্ত দেখা যায়, তাও বিস্ময়কর। সংবাদমাধ্যমেই দেখা যায়, অনেকেই চলাফেরা করছেন মাস্ক ছাড়া, আবার অনেকেই মাস্ক ব্যবহার এমনভাবে করছেন, যা ব্যবহার করা না করার শামিল। মানুষ এখন এ ব্যাপারে জানে সবই, কিন্তু অনেকেই মানে না! আমাদের সংক্রমণ হার এখন সামান্য কম দেখা গেলেও একই সঙ্গে প্রশ্ন দাঁড়ায়, পরীক্ষার হারও কি কমেনি? আমাদের জনপরিসরে যে উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে যে কোনো সময় সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। ভ্যাকসিন নিয়ে যে শঙ্কা-বিভ্রান্তি জনমনে তৈরি হয়েছে, তা দূর করার দায়িত্ব সরকারের। সে-হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ছিলো খুবই গুরুত্ববহ। তাঁর বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পেরেছে জনগণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দেশের জনগণের জন্য কতখানি উদ্বিগ্ন, তা বোঝা যায় তাঁর ভাষণে। তিনি বলেছেন, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই ভাইরাস একদিকে যেমন অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিসাধন করছে মানুষের জীবন-জীবিকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই ভাইরাস। ‘কষ্ট হবে জেনেও’ সরকার মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে।
ভারতের করোনা লক্ষণ যে আমাদের দেশে এসেছে, তা আমাদের জন্য আরেক শঙ্কার কারণ। ইতালি ও আফ্রিকার ধরন আমাদের এখানে ছড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বশীলদের অবহেলাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযোগে প্রকাশ, বিদেশ প্রত্যাগতদের ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের শিথিলতা এবং এক ধরনের উপেক্ষা আমাদের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। তাই এবারও দায়িত্বশীলদের আরো সতর্ক ও কঠোর হতে হবে।