দেশের রপ্তানি পালে হাওয়া

ট্রাম্পের শুল্কারোপের প্রভাব । কার্যকরের আগেই আগাম পণ্য পাঠিয়েছেন অনেকে । জুলাই মাসে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি । চীনের হারানো ক্রয়াদেশ ধরতে পারলে পোশাকখাতের চেহারা পাল্টে যাবে

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৮ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্কারোপ বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হতে চলেছে। ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে চীনের ওপর আরোপিত কঠোর শুল্কের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কারোপ শুরুতে আতংক ছড়ালেও আলাপ আলোচনার পর বর্তমানে যে অবস্থায় শুল্ক কাঠামো রয়েছে তাতে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে এবং ইতোমধ্যে তার সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, আমেরিকায় রপ্তানিকৃত বাংলাদেশি পণ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার পর থেকে কার্যকর হয়েছে। ফলে এই সময়ের আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে তোলা পণ্য নতুন শুল্ক এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ সুবিধা কাজে লাগাতে আগাম পণ্য পাঠিয়ে রপ্তানিকারকরা জোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, এই রপ্তানিতে জোয়ারের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কারোপ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিশেষ করে দেশের তৈরি পোশাকখাতের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা চোখে অন্ধকার দেখছিলেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপের ঘোষণা দিয়েই দরকষাকষি শুরু করেন। পরবর্তীতে শুল্ক কমিয়ে করা হয় ৩৫ শতাংশ। গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের তৃতীয় দফা আলোচনার পর চুক্তির ভিত্তিতে পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে আগে থেকেই তৈরি পোশাকের জন্য ১৬.৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর ছিল, ফলে মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৩৬.৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের পাশাপাশি ভিয়েতনামের পণ্যে ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ভারতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ২৫ শতাংশ। রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল কেনার কারণে গত বুধবার অতিরিক্ত আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয় ভারতের উপর। এতে করে ভারতের পণ্যে শুল্ক বেড়ে দাঁড়াল ৫০ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের পাল্টা শুল্কের হার ১৯ শতাংশ। শুল্ক নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত চীনের পণ্যে পাল্টা শুল্ক ৩০ শতাংশ।

চীনের শুল্ক বেশি হওয়ায় এবং চীনের সাথে আমেরিকার একটি স্নায়ুযুদ্ধ চলমান থাকায় বহু মার্কিন বায়ার চীন থেকে অর্ডার সরিয়ে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। গত বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাস জানুয়ারিজুনে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১১১ কোটি ডলার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের ১১৯ ও বাংলাদেশের ৮৫ কোটি ডলার তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।

বিজিএমইএ’র দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, গত জুন পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম ছয়মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি।

একাধিক গার্মেন্টস মালিক দৈনিক আজাদীকে বলেন, চীনের হাতছাড়া হওয়া আমেরিকান বায়ারদের অর্ডার বাংলাদেশে আসতেছে। ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু অর্ডার পেয়েছি। এটি দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক আবহ তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে বাংলাদেশ আমেরিকায় ৪২৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪০ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ বলেও বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে। প্রবৃদ্ধির এই হারকে অনেক বড় একটি ব্যাপার বলেও তারা মন্তব্য করেন।

অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানিকারকদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ায় প্রতিদিন অতিরিক্ত ৮০০ কন্টেনার রফতানি হচ্ছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরের ১৯টি ডিপোতে জমা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০টিইইউএস রপ্তানি কন্টেনার। এগুলোর অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রমুখী বলেও সূত্র জানায়।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ৭ আগস্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য পাঠাতে অনেকেই চেষ্টা করেছেন। তবে যারা আগাম উৎপাদন সম্পন্ন করেছিলেন, তারা ১ আগস্টের আগেই রপ্তানি নিশ্চিত করেছেন। ফলে জুলাই মাসে রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, গত মাসে (জুলাই) বাংলাদেশ থেকে ৩৯৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যার মধ্যে ৮২ কোটি ডলারের পোশাক গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর ৬০ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে।

সংশ্লিষ্ট গার্মেন্টস মালিকেরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কাঁচামাল ব্যবহারে পাল্টা শুল্ক ছাড় থাকায় বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ পোশাক খাত তুলানির্ভর এবং বাংলাদেশের আমদানিকৃত তুলার বড় অংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

বেসরকারি কন্টেনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক এড়াতে রপ্তানিকারকরা আগেভাগেই কন্টেনার পাঠিয়েছেন ডিপোতে। এর প্রভাবে জুলাই মাসে কন্টেনারের সংখ্যা বেড়েছে, আগস্টেও বাড়বে।

তিনি বলেন, গত জুন মাসে আমাদের ডিপোগুলো থেকে ৫৮ হাজার ৮৭৫ টিইইউএস কন্টেনার রপ্তানি হয়েছে, সেখানে গত জুলাই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৮১ হাজার ১৩৫ টিইইউএস। যা প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি। এটি একটি রেকর্ড সংখ্যক রপ্তানি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই রপ্তানির সব পণ্যই আমেরিকা যাচ্ছে না, তবে একটি বড় অংশ আমেরিকামুখী।

একাধিক তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক চীনের হারানো ক্রয়াদেশ ঠিকঠাকভাবে ধরা গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতের চেহারার পাশাপাশি অর্থনীতিও বহুলাংশে পাল্টে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকার্যকর হল বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশের ওপর আরোপ করা নতুন মার্কিন শুল্ক
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুও