দেশি-বিদেশি জাহাজের দ্বন্দ্ব প্রকট

ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৭:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশি জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রণীত ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট নিয়ে দেশীয় এবং বিদেশি জাহাজের স্নায়ুযুদ্ধ প্রকট হয়ে উঠছে। উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক থেকে এই আইন সংক্রান্তে নেয়া এক সিদ্ধান্ত দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহন ব্যাহত করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ পণ্য দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহনের লক্ষ্যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। তবে অবকাঠামোগত সক্ষমতা না থাকায় তা মাঠে মারা পড়ছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের স্বার্থেই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে ভাবার সময় এসেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের সরকারিবেসরকারি মালিকানাধীন দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০১৯ নামের একটি আইন রয়েছে। দেশীয় জাহাজ শিল্পকে সুরক্ষা দিতেই মূলত আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের প্রেক্ষিতে বিদেশি জাহাজগুলোকে দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিওএমএমডি) থেকে অনুমোদন বা ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পিও, এমএমডি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের (বগসোয়া) কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র বা ওয়েভার সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ উপস্থিত বা আসার সিডিউল থাকলে ওই পণ্য আর বিদেশি কোন জাহাজ লোড করতে পারে না। বেশ আগে প্রণীত আইনটি পর্যাপ্ত জাহাজের অভাবে কখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই আইনের প্রয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। একই সাথে ছাড়পত্র ইস্যু নিয়েও দেখা দেয় সমস্যা। সময়মতো ছাড়পত্র না পাওয়ায় বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলোর পক্ষে পণ্য বোঝাই করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে দেশীয় স্বল্প সংখ্যক জাহাজের পক্ষে দেশের এত বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিপিং সেক্টরে দেশীয় এবং বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের মধ্যে একটি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। ইতোমধ্যে আদালতের নির্দেশে বগসোয়ার ক্ষমতা স্থগিত করা হয়েছে। তবে দেশের পণ্য পরিবহনে বিদেশি জাহাজগুলোকে আগেভাগে ওয়েভার সনদ সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

অপর্যাপ্ত দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের মাধ্যমে দেশের বিপুল সংখ্যক আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহনের সুযোগ না থাকায় পুরো সেক্টরে সংকট তৈরি হয়। বিদ্যমান সংকট নিরসনে সম্প্রতি নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংস্থার মহাপরিচালক কমডোর মাকসুদ আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বগসোয়া, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশি বন্দর/জেটিতে (মালামাল উঠানোর স্থানে) বাংলাদেশি জাহাজের অবস্থানকালে উক্ত বন্দরের বিধি বিধান অনুযায়ী কাট অফ টাইমের ২৪ ঘণ্টা পূর্ব থেকে বাংলাদেশি জাহাজ ওয়েভার এর এনওসি প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারবে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি জাহাজ ২৮ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর বন্দর/জেটিতে অবস্থান করলে এবং সিঙ্গাপুর বন্দরে উক্ত জাহাজে পণ্য বোঝাইয়ের জন্য বন্দরের বিধি বিধান অনুযায়ী কাট অফ টাইম ২৬ সেপ্টেম্বর হলে বাংলাদেশি জাহাজ ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে বিদেশি জাহাজকে ওয়েভারের এনওসি প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারবে।

সিদ্ধান্তে আরো উল্লেখ করা হয়, রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশীয় বন্দর/জেটিতে (মালামাল উঠানোর স্থানে) বাংলাদেশি জাহাজের আগমনের সময় থেকে ৪৮ ঘণ্টা ওয়েভারের এনওসি প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারবে। যেমন বাংলাদেশি জাহাজ ২৮ সেপ্টেম্বর ১২টার সময় চট্টগ্রাম বন্দর/জেটিতে আগমন করলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর ১১:৫৯টা পর্যন্ত বিদেশি জাহাজকে ওয়েভারের এনওসি প্রদান থেকে বিরত থাকতে পারবে। নতুন এই সিদ্ধান্তের পর আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে দেশিবিদেশি জাহাজের স্নায়ুযুদ্ধ প্রকট হচ্ছে।

বিদেশি জাহাজগুলোর স্থানীয় এজেন্টদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাহাজে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র নেয়ার জন্য যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাই মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশেষ করে মাত্র ৮টি কন্টেনার ভ্যাসেল দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী ৯০টি কন্টেনার ভ্যাসেলের পণ্য পরিবহন অসম্ভব। এই অবস্থায় ওয়েভার সনদের ব্যাপারটিতে শিথিল করা না হলে দেশের পণ্য পরিবহন সংকটে পড়বে।

মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, দেশীয় জাহাজের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আইনে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অবকাঠামোগত যে সব সুযোগ সুবিধা দরকার আমাদের তার ঘাটতি রয়েছে। দেশীয় পণ্য পরিবহনে যাতে সংকট না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্ত্রীর মামলা, ধরা পড়েননি জসিম
পরবর্তী নিবন্ধঘোষণার চেয়ে ৫২ টন কম পণ্য রপ্তানির চেষ্টা