‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা / তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।’ এই গানটি মনে প্রাণে অস্তিত্বে মিশে আছে। আর এই হৃদয়স্পর্শী গানের স্রষ্টা বিশিষ্ট কবি, নাট্যকার ও সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ডি. এল. রায় নামে সমধিক পরিচিত। তিনি বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবির মধ্যে অন্যতম বাঙালি কবি। তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। তাঁর পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক গায়ক। বাবার কাছেই তাঁর গানের হাতেখড়ি। তাদের বাড়িতে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্রের যাতায়াত ছিল। কিশোর বয়স থেকেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন।
তিনি ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে এফ,এ এবং হুগলি কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম এ পাশ করেন। কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ড যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে। রয়্যাল এগ্রিকালচার কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি হতে কৃষি বিদ্যায় ঋজঅঝ এবং গজঅঝ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ খুৎরপং ড়ভ ষহফ প্রকাশিত হয়। এই বছরই দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি সরকারি কাজে নিযুক্ত হন। ভারতে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং দিনাজপুরে সহকারি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। তবে তিন বছর বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হলে তাঁকে নানা সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়।
১৮৮৭ সালে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের মেয়ে সুরবালা দেবীকে তিনি বিয়ে করেন। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগণায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের অধিকার বিষয়ে তাঁর সাথে বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। ১৯০৩ সালে তাঁর স্ত্রী একটি মৃত সন্তান প্রসব করে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠিত ‘খামখেয়ালি সভা’য় তিনি প্রথম থেকে যাওয়া আসা শুরু করেন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর সখ্যতা জন্মে। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পাঁচ শতাধিক গান লিখেছেন যা দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ধনধান্য পুষ্প ভরা, বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হাস্যরসে তিনি অসামান্য। তিনি ছিলেন খুবই রসিক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। একবার দেশপ্রেমিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রিজেন্ট পার্কে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করলেন এক ইংরেজ সাধারণ লোকজনকে জড়ো করে ধর্মবাণী শোনাচ্ছেন। সেটা শোনার জন্য তিনি ভিড় ঠেলে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে বক্তৃতা দিতে থাকা ইংরেজটি বললেন, ‘শয়তান তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,’ ইংরেজ সাহেব কথাটি শেষ করতে পারেনি, অমনি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে, খানিকটা উঁচু হয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সে শয়তান তুমিই বটে!’ তাঁর মুখে এমন উত্তর শুনে উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকগুলোতে পাঠান–মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দেশের ভারতীয় মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বারবার প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক মূল্যে ও নাটকীয় উৎকর্ষে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শ্রেষ্ঠকীর্তি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি। তাই সংগত কারণেই তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক নাট্যকার বলা হয়। সাহিত্যকর্ম হিসেবে তাঁর অনেক নাটক উচ্চশিক্ষার পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন এবং সে বছরই ১৭ই মে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।