মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হওয়ায় উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এবং মাটির কারণে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পাট এ অঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশে জন্মে। এখনো দেশের ০৮ থেকে ১০ মিলিয়ন কৃষক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পাট উৎপাদনের সাথে জড়িত। প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট উৎপন্ন হয়। বছরে উৎপাদিত এ পাটের শতকরা ৫১ ভাগ পাট পাট কলে ব্যবহার করা হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয়, মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয়।
পাট একটি বর্ষাকালীন ফসল ও সারাদেশে এর উৎপাদন হয়। এটি বাংলার (বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের) শতবর্ষের ঐতিহ্য। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন (চৈত্র বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণ পর্যন্ত)। পাট চাষে কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ২ টন। পাটের আঁশ নরম, উজ্জ্বল চকচকে সোনালী এবং ১–৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তবে একক আঁশ কোষ ২–৬ মিলি মিটার লম্বা এবং ১৭–২০ মাইক্রন পুরু হয়। পাটের আঁশ প্রধানত সেলুলোজ এবং লিগনিন দ্বারা গঠিত। পাট গাছ জৈব প্রক্রিয়ায় পানিতে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়ানো হয় বায়ুর ৭০–৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায়। চৈত্র–বৈশাখ মাসের প্রাক বর্ষায় পাট বীজ বোনা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের অপেক্ষাকৃত খরায় নিড়ানী, গাছ বাছাই ও অন্যান্য অন্তবর্তী কালীন পরিচর্যা সম্পন্ন করা হয়। আষাঢ়–শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় যখন নালা, ডোবা, খাল বিল, পানিতে ভরে ওঠে তখন পাট কাটা হয় এবং নিকটবর্তী জলাশয়ে পাট গাছ জাগ দেয়া হয়। পাট পঁচানোর এ পদ্ধতিকে ‘রিবন রেটিং’ বলে। বাংলাদেশের পরিবেশের এ সব কিছুই পাট চাষের সাথে নিবীড়ভাবে সম্পর্কিত। সাময়িক খরা অথবা জলাবদ্ধতায় পাট তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। পাট ক্ষেতে কোনো রকম সেচ অথবা পানি নিষ্কাশন প্রয়োজন হয় না।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পাট পণ্যের চাহিদা প্রায় ৭.৫০ লাখ মেট্রিক টন এবং এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৪.৬০ লাখ মেট্রিক টন। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও বেশি। এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও বিশ্বে পাঠ উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয় প্রায় ৯ লাখ টন। ভারত উৎপাদন করে ১৮ লাখ টন। এখন পাট থেকে উন্নতমানের ভিসকস সুতা উৎপাদন হয়। যার মূল্য সুতি কাপড় থেকেও বেশি। পাটের উপজাত পাটখড়ি দেশের জ্বালানির প্রধান উৎস। গত কয়েক বছর ধরে পাটখড়ির চারকোল বিদেশে রফতানি করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এতো অর্থকরী একটি ফসল হওয়ার পরেও পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করার সময় বিজেএমসির মোট জমির পরিমাণ ছিলো ১,৫১৭ একর। বর্তমানে বিজেএমসির সম্পদ রক্ষা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিজেএমসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিজেএমসিতে প্রশাসনিক ও জমিজমা সংক্রান্ত মোট ৮৯২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত ১৩৬টি। গত এক বছরে বিজেএমসি জমিজমা সংক্রান্ত আরো পাঁচটি মামলা করেছে।তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে ১০টি মামলা। কর্মকর্তারা বলেন, বেদখল জমি উদ্ধারে এসব মামলা করা হয়েছে।
অন্যদিকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়েরই আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাট করপোরেশন (বিজেসি) ১৯৯৩ সালে বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু তিন দশক হতে চললেও বিলুপ্তির কাজ এখনো শেষ হয়নি। বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণার সময় সংস্থাটির সম্পত্তি বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও গোটানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৪৪ কর্মকর্তা–কর্মচারীকে নিয়ে ‘বিলুপ্ত সেল’ গঠন করা হয়। এরপর তিন দশক হতে চললেও এখনো সংস্থাটির বিলুপ্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। এখনো বিজেসিতে ৮ জন স্থায়ী কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে ৪৮ কর্মচারী কর্মরত। তাঁদের পেছনে সরকারকে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। একসময় বিজেসির কাজ ছিল সারা দেশের কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা পাট সংগ্রহ করে তা বিদেশে রপ্তানি করা। তখন চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা থেকে জাহাজে করে পাট চীন, পাকিস্তান, সুদান সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেত। কিন্তু বিজেসি বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে কাঁচাপাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। বিলুপ্তির ফলে পাট খাত থেকে বিদেশি আয় কমে যায় এবং কৃষক দাম না পেয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘তখন বিশ্বব্যাংকের একটা চাপ ছিল বিজেসি বন্ধ করার। কিন্তু সরকার বন্ধ না করলে তেমন কিছু হতো না। তারা বলেন, কোনো সরকারই পাটের প্রতি সুবিচার করেনি, ফলে পাটখাত দাঁড়াতে পারেনি। এ খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে।’
এখন বিজেসি ২৯৫ একর জমির ১৯০ একরই বেদখল। অর্থাৎ করপোরেশনটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ১০৫ একর জমি। সংশ্লিষ্টরা জানান, সারা দেশের সাতটি অঞ্চলে জমি রয়েছে বিজেসির। এরমধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫৩ একরের মধ্যে ২৫ একর, রংপুরে ১৭৫ একরের মধ্যে ১২৯ একর, খুলনার ৩১ একরের মধ্যে ১৯ একর, নারায়ণগঞ্জে ২০ একরের মধ্যে ১৫ একর, নরসিংদীর দশমিক ৪৩ একরের পুরোটাই এবং হবিগঞ্জের ১ একরের মধ্যে পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। অবশ্য চট্টগ্রামের ১৩ একরের পুরোটাই বিজেসির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জানা যায়, একসময় বিজেসির মোট জমির পরিমাণ ছিল ৬৮৫ একর। ১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং করপোরেশন, স্পেশাল প্রপার্টি জুট সেল, জুট ট্রেডিং করপোরেশন, এপিসি র্যালি বাংলাদেশ লিমিটেড ও বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট করপোরেশনকে একীভূত করে সরকার বিজেসি গঠন করে। এর মাত্র ৮ বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে বিজেসিকে বিলুপ্ত করে সরকার। পরে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৯০ একর জমি বিক্রি করে দেয়। এরপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় সম্পত্তি বিক্রি না করে সব সম্পত্তি বার্ষিক ভিত্তিতে ভাড়ার আওতায় আনার নির্দেশনা দেন। তবে এখন পর্যন্ত দখলে থাকা ১০৫ একর সম্পত্তির মধ্যে ৭০ একর ভাড়ার আওতায় আনতে পেরেছে করপোরেশনটি। বাকীগুলো খালি পড়ে আছে।
পাঠ খাতের এই করুণ দশার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীতে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের বড় ধরনের সম্ভাবনা পাট দিয়ে তৈরি হয়েছিল। সরকারের উচিত ছিল, পাটজাত পণ্য আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ করা। নতুন প্রযুক্তি আনা, পাট কেনা, আমলাদের দুর্নীতি বন্ধসহ যেসব সমস্যা ছিল, তা সমাধান করা। কিন্তু সেটা না করে সরকার পাটকলগুলো বন্ধ করে দিল। পাটকল বন্ধের পেছনে কিছু গোষ্ঠী রয়েছে। তারা নতুন শিল্পকারখানার নামে বিশাল এই জমি দখলে নিতে চায়।
তবে সরকার চাইলে এখনো পাটখাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সেজন্য দরকার সঠিক ও দৃঢ সিদ্ধান্ত। শুধু দেশে ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে চাল, গম, চিনি, ডাল ইত্যাদির মোড়ক হিসাবে পিপির বস্তার পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব পাটের বস্তার ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেই আবার পাটের সুদিন ফিরে আসবে। অন্যদিকে গবেষণা করে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। দেশের সব এলাকার কৃষককে পাঠ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পাটের পণ্যের বৈচিত্র্য আনতে হবে। পাটকলগুলোকে আধুনিকায়নের আওতায় এনে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে, যাতে উৎপাদিত পণ্যের কস্টিং প্রতিযোগিতামূলক হয়। কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে পাটের নতুন নতুন বাজার খুঁজে তা কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাটের কাঁচামাল থেকে শুরু করে ফিনিসড প্রোডাক্ট পর্যন্ত সব কিছুই দেশে তৈরি করা যায়। ফলে পাট রপ্তানির পুরো টাকাই আমাদের রিজার্ভে যোগ হবে। তাই দেশকে স্বাবলম্বী করার পথে পাটখাতই হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় অবলম্বন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট