আমাদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এখন চলছে নানামুখী সংকট। আগে আর্থিক খাতে সীমাবদ্ধতা বা দুর্বলতা থাকলেও বৈদেশিক খাত ছিল শক্তিশালী। কিন্তু এখন বৈদেশিক খাতও বেশ কয়েক মাস ধরে দুর্বল ছিল বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। সামপ্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়েছে। এমনকি রপ্তানি আয়ও কমে গেছে আকস্মিকভাবে। তবে দৈনিক আজাদীর ২০ আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ১৭ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১১৩ কোটি ৪২ লাখ ডলার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে প্রবাসী আয় কমে গিয়েছিল ব্যাপকভাবে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর এ আয়ের ধারা বাড়তে থাকে। চলতি মাসের ১৭ দিনে ১১৩ কোটি ৪২ লাখ মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয়ের এ তথ্য প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, আগস্টের ১৭ দিনে দেশে প্রবাসী আয় আসে ১১৩ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। মাসের প্রথম তিনদিনে দৈনিক ৩ কোটি ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৩৩৩ মার্কিন ডলার এসেছে। ৪ থেকে ১০ আগস্ট দৈনিক এসেছে ৫ কোটি ৫৩ লাখ ২ হাজার ৮৫৭ ডলার; তৃতীয় সপ্তাহে ১১ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এসেছে ৯ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ২৮৬ ডলার। এ কয়দিনে ১৭ দিনে প্রবাসীদের পাঠানো আয় জুলাই মাসের চেয়ে বেশি। এমনকি ২০২৩ সালের আগস্ট মাস থেকেও বেশি।
খবরটা আসলে আমাদের দেশের জন্য শুভ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা আশারূপ অর্থ পাঠায় নি দেশে। তাছাড়া জনশক্তি রফতানি বাড়লেও রেমিট্যান্স তেমন বাড়েনি। তার প্রধান কারণ হুন্ডি। ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সে যত টাকা দর দিচ্ছে। সেখানে হুন্ডি কারবারিরা তারচেয়ে বেশি দিচ্ছে। আবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রবাসীর কর্মস্থলে গিয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করে। আবার ভিন্নমতও আছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়লেই যে রেমিট্যান্স বাড়বে সেটাও নয়। বিদেশে কী পরিমাণ দক্ষ কর্মী পাঠানো হচ্ছে সেটাই বড় বিষয়। কেননা অদক্ষ কর্মী পাঠালে তাদের ব্যয়ের টাকা তুলতেই কয়েক বছর লেগে যায়। আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে এ ধারণাকেও উপেক্ষা করা যাবে না। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে রিজার্ভ সংকট এড়ানোর জন্য রেমিট্যান্স বাড়াতে যা যা করণীয় সেগুলো করতে হবে। কেননা রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে ডলার সংকট কমবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের কর্মক্ষম ২৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় অভিবাসনের মাধ্যমে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান না হলে বাংলাদেশে দরিদ্র লোকের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়ে যেতো। অভিবাসী শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা এখনো পর্যন্ত অভিবাসী কর্মীদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারিনি। অভিবাসী শ্রমিকদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। অভিযোগ রয়েছে বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো থেকে তারা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। অথচ আমাদের অভিবাসী কর্মীরা তাদের শ্রমে ঘামে অর্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করে আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রেরণকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করা উচিৎ। তাঁরা বলেন, বর্তমানে প্রদত্ত রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা যা দেওয়া হচ্ছে, তা বাড়ানো জরুরি। যারা স্বল্প আয়ের অভিবাসী কর্মী তাদের জন্য রেমিটেন্সের উপর প্রণোদনা ১০ শতাংশ করা যেতে পারে।
আবার কেউ কেউ বলছেন, নানা প্রণোদনা দেওয়ার পরও রেমিট্যান্স প্রবাহ তেমন বাড়ে নি। এক্ষেত্রে হুন্ডির পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংকেও দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার কারণে হুন্ডির বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে অভিবাসীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার পরও সুফল মিলছে না। তবে রেমিট্যান্স সংগ্রহে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে বৈধ চ্যানেলে ডলার আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানোর বিকল্প নেই। হুন্ডি যে অবৈধ, এটি প্রবাসীদের বোঝাতে হবে। পাশাপাশি হুন্ডিবাজদের তৎপরতা বন্ধ করতে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোর সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমরা মনে করি, প্রবাসী আয় কমার পেছনে প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচারের প্রবণতা। যারা অর্থ পাচার করে, তাদের জন্য ডলারের দর কত, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেকোনো দরেই তারা রাজি থাকে। কিন্তু এর ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। অর্থ পাচার বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয় কমার পেছনে। অর্থাৎ যারা অর্থ পাচার করছে, তারাই প্রবাসী আয়ের ডলার নিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা দেশে বসে প্রবাসী আয়ের টাকা ঠিকই পাচ্ছেন। মোটামুটি ভালো দরেই তাঁরা এটা পাচ্ছেন। কিন্তু প্রবাসী আয়ের এই ডলার বাংলাদেশ সরকার পাচ্ছে না। আর এর প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপরে।
তাঁরা বলেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে হলে বিদেশে বেশি বেশি লোক পাঠাতে হবে।