দেনার ভারে জর্জরিত চসিক

৪১১ কোটি টাকার দেনার সিংহভাগ টাকা পাবেন ঠিকাদাররা কাল শপত নিচ্ছেন শাহাদাত, 'বললেন কিছুটা চেলেঞ্জ'

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:০০ পূর্বাহ্ণ

দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে আছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। বর্তমানে ৪১১ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দেনা রয়েছে সংস্থাটির। যার সিংহভাগই পাবেন উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদাররা। এছাড়া বিভিন্ন সংস্থা, বিদ্যুৎ বিল এবং কর্মকর্তাকর্মচারীদের আনুতোষিক ও ভবিষ্য তহবিল খাতে রয়েছে বাকি দেনা।

চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিল না পেলে কাজ শেষ করতে গড়িমসি করেন ঠিকাদাররা। এছাড়া চলমান একটি উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে সরকারি সহায়তার সঙ্গে ২০ শতাংশ ‘ম্যাচিং ফান্ড’ হিসেবে পরিশোধ করতে হয় চসিককে। ম্যাচিং ফান্ডের অর্থ পরিশোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে প্রকল্পটির বিপরীতে সরকারি সহযোগিতাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে চসিকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে দেনা।

এ অবস্থায় আগামীকাল রোববার চসিক মেয়র হিসেবে শপথ নিবেন নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন। এছাড়া মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার কথা রয়েছে তার। অর্থাৎ এমন সময়ে তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিচ্ছেন যখন দেনায় জর্জরিত চসিক। ফলে বিপুল অংকের দেনা মাথায় নিয়ে নগরপিতার আসনে বসা ডা. শাহাদাত নাগরিক সেবা নিশ্চিতে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলে মনে করেন নগরবাসী।

এ বিষয়ে ডা. শাহাদত হোসেন আজাদীকে বলেন, ফান্ডে টাকা থাকলে কাজ করা সহজ। এখন কিছুটা চ্যালেঞ্জ হবে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই কাজ করতে হবে আমাকে। ২০০১ সালে আমি রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিই। তখন প্রতিষ্ঠানটির অনেক টাকা দেনা ছিল। ২০০৮ সালে আমি বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাড়ে তিন কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রেখে আসছি সেখানে। কাজেই কর্পোরেশনেরও যেসব দেনা আছে তা শোধ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একটি স্বাবলম্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই আমার লক্ষ্য। সেজন্য আমি কাজ করে যাব। তিনি বলেন, স্বাবলম্বী করার জন্য আয়বর্ধক প্রকল্প নেব। আরো কিছু পরিকল্পনা আছে। বন্দরের সঙ্গে বসব। বন্দরকে প্রচুর লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়ার পরও কর্পোরেশনকে হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ অল্প কিছু টাকা দেয়।

চসিকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেনা থাকলেও বর্তমানে চসিকে ১০০ কোটি টাকার এফডিআর আছে। এছাড়া ৬টি প্রকল্পের বিপরীতে আছে সরকারি বরাদ্দও। ফলে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে খুব বেশি সমস্যা হবে না ডা. শাহাদাত হোসেনের।

কোন খাতে কত দেনা : কর্মকর্তাকর্মচারীদের আনুতোষিক খাতে ৬৩ কোটি ৭২ লাখ ৯ হাজার ৮৫৮টাকা, কর্মকর্তাকর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিল খাতে ৫৬ কোটি ৬০ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭২ টাকা দেনা আছে। সড়কবাতির বিদ্যুৎ বিলের দেনা ২৬ কোটি ৬১ লাখ ২১ হাজার ৭৪৪ টাকা, কর্ণফুলী নদীর তিনটি ঘাটের বিপরীতে পটিয়া, কর্ণফুলী এবং আনোয়ারা উপজেলা পরিষদ চসিকের কাছে পাবে ৪ কোটি ২ লাখ ১৮ হাজার ৯ টাকা।

অন্যান্য দেনার মধ্যে থোক বরাদ্দ খাতে ৪৭ কোটি ২৩ লাখ ৩২ হাজার ২৪৩ টাকা ও সাধারণ বরাদ্দের বিপরীতে ৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ৫৯ হাজার ৯৬৬ টাকা পাবেন ঠিকাদাররা। একইসঙ্গে ৭৬ট ধারায় সমাপ্ত উন্নয়ন কাজের বিপরীতেও ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮২ হাজার ৯৬৬ পাবেন ঠিকাদাররা। চসিকের যান্ত্রিক শাখার ১২ কোটি ৪৯ লাখ ১৭ হাজার ১৭৫ টাকা এবং বিদ্যুৎ শাখার ৮ কোটি ৪১ লাখ ২৬ হাজার ৫৬১ টাকা এবং নেজারত শাখার ১ কোটি ৬৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৫ টাকা দেনা আছে। এছাড়া কোভিড১৯ প্রকল্পে ৮৫ লাখ ১০ হাজার ৮৪০ টাকা এবং বিভিন্ন পত্রিকা বিজ্ঞাপন খাতে চসিকের কাছে পাবে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৫০২ টাকা।

সমাপ্ত প্রকল্পেও দেনা : চসিকের সাবেক মেয়রদের আমলে সমাপ্ত হওয়া ৯টি প্রকল্পের বিপরীতেও দেনা রয়েছে। যার পরিমাণ ৮৯ কোটি ৭৯ লাখ ৯০ হাজার ২০৭ টাকা। প্রকল্পগুলোর ঠিকাদাররা এ অর্থ পাবে চসিকের কাছে। এর মধ্যে সিডিএমপি(বহাদ্দারহাট ও মহেশখাল) প্রকল্পে ২৭ লাখ ৫২ হাজার ৮২৬ টাকা, অ্যাসফল্ট প্লান্ট দ্বারা রাস্তা উন্নয়ন প্রককল্পে ১৪ কোটি ৭১ লাখ ৮৯ হাজার ১৩১ টাকা, ইমপ্রুভমেন্ট অব গার্বেজ ডিসপোজাল সিস্টেম প্রকল্পে ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৬০০ টাকা, মেরিনার্স বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ১ কোটি ৭ লাখ ৩৬ হাজার ১৬৯ টাকা, নগরের বিভিন্ন এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে (আইসিসি ক্রিকেট প্রকল্প) ৩ কোটি ৯০ লাখ ৯ হাজার ৫ টাকা, বাণিজ্যিক রাজধানী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ৭৭ লাখ ২১ হাজার ২৯৭ টাকা, নগরের বিভিন্ন রাস্তা ও ফুটপাত উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ প্রকল্পে ৪ কোটি ৫২ লাখ ৬২ হাজার ৫০ টাকা, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাসমূহের এবং নালা প্রতিরোধ দেওয়াল, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ বা পুনঃ নির্মাণ প্রকল্পে ৪৩ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৫৭১ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং ব্রিজসমূহের উন্নয়নসহ আধুনিক যান যন্ত্রপাতি ও সড়ক আলোকায়ন প্রকল্পে দেনা আছে ২০ কোটি ৯২ লাখ ২২ হাজার ৬১৬ টাকা।

সাবেক মেয়রদের যাত্রাকালে কত দেনা ছিল : ২০১০ সালের ২০ জুলাই মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলন মোহাম্মদ মনজুর আলম। ওইদিন চসিকের দেনা ছিল ১৯৯ কোটি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ২৬৬ টাকা। একইদিন কর্পোরেশনের তহবিলে ছিল মাত্র ১২ কোটি টাকা। এছাড়া রেজাউল করিম চৌধুরী মেয়র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন চসিকের দেনা ছিল ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা।

এছাড়া সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওইদিন চসিকের দেনার পরিমাণ ছিল ২৩৫ কোটি ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪৬৫ টাকা। অবশ্য তিনি মেয়র হিসেবে শপথ নেন ২০১৫ সালের ৬ মে। ওই দিন পূর্বের মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের রেখে যাওয়া দেনার পরিমাণ ছিল ২৯৫ কোটি ২৬ লাখ ৯৩ হাজার ১৭৪ টাকা। আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের আগে আ জ ম নাছির ব্যক্তিগত উদ্যোগে যোগাযোগ করেন মন্ত্রণালয়ে। তখন চসিককে ৫০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেয় সরকার। ওই টাকাসহ ৬০ কোটি ৮৭ লক্ষ হাজার ৯৭ হাজার ৭০৯ টাকা দেনা পরিশোধ করে চসিক। ফলে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের দিন দেনার পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। আ জ ম নাছির তার সর্বশেষ কর্মদিবসে চসিকের ২০২০২০২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন। এতে দেনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় ৭৯০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।.

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিষেধাজ্ঞার পরও পলিথিনের ব্যবহার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রত্যাহারে সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমাবেশ