পর্ব ২
উদ্বোধনী পর্বের পর আজকের দ্বিতীয় পর্বে আমরা পড়ব এমন দশজন নারীর কথা যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজনিজ ক্ষেত্রে অনন্য। তাদের কেউ কবি, কেউ সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী কিংবা তীরন্দাজ! চলুন তাহলে শুরু করি আজকের পর্ব যুক্তরাষ্ট্রের তিরন্দাজ ট্রেসি অটো–র সাথে।
তিরন্দাজ ট্রেসি অটো, যুক্তরাষ্ট্র
প্রাক্তন প্রেমিকের নৃশংস আক্রমণে ট্রেসি অটো’র বুক থেকে নিচের অংশ অবশ হয়ে যায় এবং একই ঘটনায় বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান, হয়ে পড়েন চলৎশক্তিহীন। এর কিছুুদিন পরই, একসময়ের নামকরা ফিটনেস মডেল ট্রেসি অটো পুনরায় সক্রিয় জীবনযাপনে ফিরে আসার সংকল্প নেন। মার্চ ২০২১ সালে, তিনি আর্চারি খেলায় মনোনিবেশ করেন, যা তিনি আগে কখনও চেষ্টা করেননি। তার ছোঁড়া প্রথম তীরটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পরই তিনি বিস্মিত হন। এরপর তিনি এ খেলায় মগ্ন হয়ে যান। এ বছর (২০২৪), প্যারিসে তার প্রথম প্যারালিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করেন। তার হাতের অক্ষমতার কারণে তিনি মুখ ব্যবহার করে তীর ছোঁড়েন। ২০১৯ সালের ওই ঘটনার প্রায় পাঁচ বছর পরে, তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে পারিবারিক সহিংসতার শিকারদের পক্ষে এখন এডভোকেসি করছেন।
একটিভিস্ট হালা আলকারিব, সুদান
হালা আলকারিব একজন বিশিষ্ট অধিকারকর্মী এবং লেখক। তিনি ‘স্ট্র্যাটেজিক ইনিশিয়েটিভ ফর উইমেন ইন দ্য হর্ন অফ আফ্রিকা’ বা সিহা–র আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দান করে নারী নির্যাতনের ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসেন। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ‘সিহা’ সংঘাত–সম্পর্কিত যৌন সহিংসতায় নজরদারি করছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ নারী ও কিশোরীদের সহায়তা দিচ্ছে।
অধিকার কর্মী ইউমি সুজুকি, জাপান
জন্মগতভাবে সেরিব্রাল পালসি নিয়ে জন্মানো ইউমি সুজুকি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বৈষম্যের শিকার। মাত্র ১২ বছর বয়সে, তাকে হিস্টেরেক্টমি করা হয়, যা জরায়ু অপসারণের এক ধরনের শল্য চিকিৎসা। ১৯৫০ থেকে ১৯৯০–এর দশক পর্যন্ত, সুজুকির মতো প্রতিবন্ধী অনেককেই জাপানে একটি ইউজেনিক্স আইনের কারণে জোরপূর্বক বন্ধ্যা করা হয়, যা ১৯৯৬ সালে এসে বাতিল করা হয়। কিন্তু এই বাতিল প্রক্রিয়াটি এমনি এমনি ঘটেনি! সুজুকি এবং আরও ৩৮ জন মামলাকারী সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন, এবং আদালতে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর, তিনি মামলায় জয়ী হন। জুলাই মাসে, জাপানের সুপ্রিম কোর্ট এই প্রথাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে এবং ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য সরকারকে আদেশ দেয়। জাপান সরকার স্বীকার করেছে যে আনুমানিক ১৬,৫০০ বন্ধ্যাকরণ প্রক্রিয়া তাদের সম্মতি ছাড়াই পরিচালিত হয়েছিল।
সিনেটর সুসান কলিন্স, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করা সুসান কলিন্স বর্তমানে তার পঞ্চম মেয়াদে আছেন এবং তিনি মার্কিন সিনেটে দীর্ঘতম সময় ধ’রে দায়িত্ব পালন করা রিপাবলিকান নারী। তিনি প্রায়ই তার দলের সীমা অতিক্রম করে কাজ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করেন। তিনি ছয়জন সিনেটরের মধ্যে একজন, যারা অ্যাডভান্সিং মেনোপজ অ্যান্ড মিড–লাইফ উইমেন’স হেলথ অ্যাক্ট প্রবর্তন করেছেন, যা আগামী পাঁচ বছরে মেনোপজ গবেষণা, চিকিৎসা এবং জনসচেতনতার জন্য সাড়ে ২৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। সুসান কলিন্স ন্যাশনাল অ্যালঝাইমার্স প্রজেক্ট অ্যাক্ট–এর রচয়িতা, যা অ্যালঝাইমার্স রোগ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য একটি জাতীয় পরিকল্পনা সমন্বিত করে।
লেখক ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা, মেক্সিকো
ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা একজন বিখ্যাত এবং বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক। ২০২৪ সালে তাঁর বই ‘লিলিয়ানাস ইনভিন্সিবল সামার’–এর জন্য স্মৃতিকথা বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার জেতেন। এই বইটি ‘ফেমিসাইড’ বা নারীনিধন বিষয়ের উপর আলোকপাত করে।
গল্পটি তার বোন লিলিয়ানাকে নিয়ে, যাকে ১৯৯০–এর দশকে মেক্সিকোতে তার সাবেক প্রেমিক হত্যা করে। ওই ব্যক্তি পালিয়ে যায় এবং তার বিচার পর্যন্ত হয়নি। রিভেরা গারজা তার বোন হারানোর যন্ত্রণা ওই স্মৃতিকথায় তুলে ধরেন এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করেন, যেটি এমন একটি দেশে যেখানে নারীনিধনের হার সবচেয়ে বেশি।
রাজনৈতিক কর্মী এবং সাবেক বন্দি
লিলিয়া চানিশেভা, রাশিয়া
২০২৪–এর আগস্টে এক আন্তর্জাতিক বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে মুক্তি পাওয়া লিলিয়া চানিশেভা কারামুক্ত হয়েই রাশিয়া ত্যাগ করেন। চানিশেভা রাশিয়ার বাশকোর্তোস্তান অঞ্চলে বিরোধী রাজনীতিক অ্যালেক্সি নাভালনির অফিস পরিচালনা করতেন, সেখানে তার কাজ ছিল দুর্নীতি তদন্ত করা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানো। নাভালনির জন্য কাজ শুরুর আগে তিনি একজন সফল অর্থনীতিবিদ হিসেবে মস্কোতে আন্তর্জাতিক সংস্থার কর পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। ২০২১ সালে চরমপন্থার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাড়ে নয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তিনি দুই বছর নয় মাস কারাগারে কাটানোর পর মুক্তি পান।
স্টেয়ার ক্রাশার ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা
সুবিন পার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া
সুবিন পার্ক; একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী, সিউলের এমন অনেক জায়গার কথা তুলে ধরেছেন যেসব জায়গায় প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রবেশযোগ্য নয়। তিনি তার আইটি প্রজেক্ট ম্যানেজারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্যার সমাধানে কাজ শুরু করেন। তিনি ‘‘স্টেয়ার ক্রাশার ক্লাব’’ নামে একটি অলাভজনক প্রকল্পের সহ–প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ কোরিয়ার হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য অসুবিধাজনক পথ এবং জায়গার তথ্য সংগ্রহ করে যেসব পথ বা জায়গায় সিঁড়ি ছাড়া ওঠা যায় না। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করা। এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষ স্টেয়ার ক্রাশার ক্লাবের ইভেন্টের মাধ্যমে অংশ নিয়েছেন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ১৪,০০০ এর বেশি জায়গা চলাচলের জন্য যাচাই করা হয়েছে।
সাংবাদিক ও কবি প্লেসটিয়া আলাকাদ, ফিলিস্তিন
গাজার চলমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়টাতেই বাইশ বছর বয়সী প্লেসটিয়া আলাকাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি তার অ্যাপার্টমেন্টে ইসরায়েলি বিমান হামলার সময়কার একটি ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওটি সেসময় ভাইরাল হয় এবং তৎপরবর্তী তার করা গাজা আপডেট, তার লেখা কবিতা এবং ডায়েরি এন্ট্রির মাধ্যমে তিনি ইনস্টাগ্রামে ৪০ লাখ ফলোয়ার পান। তার এই প্রতিবেদনগুলোর ওপর ভিত্তি করে লেখা স্মৃতিকথা “আইজ অফ গাজা” শীঘ্রই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আলাকাদ ২০২৪ সালের ‘ওয়ান ইয়াং ওয়ার্ল্ড’ এর সেরা সাংবাদিক নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটের মতো উচ্চপর্যায়ের ফোরামে ফিলিস্তিনিদের জন্য সমর্থন জানিয়েছেন। গত নভেম্বর ২০২৩–এ আলাকাদ গাজা ত্যাগ করেন।
শিক্ষা ও যোগাযোগ মাধ্যম উদ্যোক্তা
হামিদা আমান, আফগানিস্তান
তালেবান যখন আফগান নারীদের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়ক উদ্যোক্তা হামিদা আমান তখন ‘বেগম অ্যাকাডেমি’ নামক একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন যেখানে স্কুলে যেতে না পারা নারীদের জন্য বিনামূল্যে মাল্টিমিডিয়াভিত্তিক কোর্স চালু করা হয়। গত বছরে এই প্ল্যাটফর্মটি সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য দারি ও পশতু ভাষায় সাড়ে আট হাজারেরও বেশি ভিডিও তৈরি করেছে। হামিদা আমান গত মার্চে ‘বেগম অ্যাকাডেমি’র শিক্ষামূলক চ্যানেল ‘বেগম টিভি’ চালু করেন এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বেগম অ্যাকাডেমি’র কোর্স সমপ্রচার শুরু করেন। অবশ্য তারও আগে, ২০২১ সালে তালেবান গোষ্ঠী ক্ষমতা নেয়ার পরপরই ‘রেডিও বেগম’ প্রজেক্ট চালু করেছিলেন হামিদা আমান যেটি নারীদের অংশগ্রহণে তৈরি ও নারী বিষয়ক অনুষ্ঠান সম্প্রচারে কমিউনিটি রেডিও।
কৃষক ওলগা ওলেফিরেঙ্কো, ইউক্রেন
২০১৫ সালে বাবার মৃত্যুর পর ওলগা ওলেফিরেঙ্কো একটি খামার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়ে (স্বপ্নটি তার বাবারও বৈকি!) গবাদি পশু কিনে কাজও শুরু করেন কিন্তু এক পর্যায়ে আর্থিক সমস্যায় পড়ে তাকে সমস্ত পশু বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু তিনি তার বাবার আকাঙ্ক্ষাকে হেরে যেতে দিতে চাননি (তার বাবা ডনবাসে নৌবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সম্মুখসারিতে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নিহত হন)। যা–ই হোক,২০২২ সালে তিনি ইউক্রেনিয়ান ভেটেরান ফান্ড থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করে জমা দেন এবং তহবিলটি পেয়েও যান। ওলেফিরেঙ্কো আবার তার খামার চালু করেন। তিনি এর আধুনিকীকরণ, নতুন কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর জোর দেন এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করেন। তার এই উদ্যোগ ও নেতৃত্ব স্থানীয়দের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।