আমেরিকা যাওয়া, বা আমেরিকার মাটিতে পা দিয়ে আমেরিকা দেখার সাধ অনেকের কাছে স্বপ্নের মতো। আমার ক্ষেত্রে আমেরিকা–ভ্রমণ যাকে বলে ব্যাপারটা তেমন নয়, কেনো না ভ্রমণ করা হয় দেশকে পর্যবেক্ষণের জন্য, তখন তাঁকে পর্যটক বলে। পর্যটক হিসাবেও নয়, প্রয়োজনে ঘুরতে গিয়ে যা দেখা হয়, এবং দেখতে দেখতে মুগ্ধ হলে বা ক্ষুব্ধ হলে, তখন মনের ভিতর আলাদা শিহরণ জাগায়, মনে রাখতে ইচ্ছে করে, ক্ষণস্থায়ী মনে চিরদিন কিছুই মনে থাকতে চায় না, স্মৃতিকে ধরে রাখার প্রয়াস চলতে থাকে, কিন্তু অতীত দৃশ্যাবলীর চিত্রপট স্মৃতির সাথে সংগ্রাম করে কতোদিনইবা মনে থাকে! মনে রাখার জন্য, কাগজ–কলমের আশ্রয় নিতে হয়, আবার কাগজ–কলম বা কম্পিউটার যেখানেই আশ্রয় নেওয়া হোক না কেন, দেখা যত সহজ, পর্যবেক্ষণ তত সহজ নয়। ভালো লাগা মন্দ লাগা যত সহজে ঘটে, লিখে প্রকাশ করা তত সহজ নয়। প্রকৃত লেখকেরা পারেন, সবার সে যোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়, আমি অসম্ভবের দলে। তবে সৌভাগ্য হল স্বপ্নের আমেরিকার বায়ান্নটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে, জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা সর্ব বৃহৎ অঙ্গরাজ্য, সাজানো গোছানো, পরিপাটি এবং সুশৃঙ্খল প্রাকতিক সৌন্দর্য বেষ্টিত ক্যার্লিফোনিয়া অঙ্গরাজ্য সমপ্রতি ঘুরে আসার সুযোগ পেলাম।
ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার মূল কারণ হলো আমার বড় ছেলে (প্রিয়ম চক্রবর্তী)কে দেখতে যাওয়া, সে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকো শহরের ম্যান্টেকায় থাকে, ইলেক্ট্রনিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘টেসলায়‘ সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত। ২০১৪ সাল থেকে আমার ছেলে আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ানা’ অঙ্গরাজ্যের’ ’পার্ঢ্যু ইউনিভার্সিটি’ থেকে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড রোবোটিক্স বিষয়ে এম এস করার পর ইন্ডিয়ানা, কেন্টাকি, ওহাইয়ো, সিনসিনাটি প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে কর্মরত থাকার পর এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় পরিবার নিয়ে আছে। ব্যস্ততার জন্য দেশে আসা হয় খুব কম সময়ের জন্য। অনেক দিন ধরে ছেলে–বৌমাকে দেখতে যাবো যাবো করেও নানা রকম ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। অথচ দীর্ঘদিন আগেই স্বপ্নের হরিণ, আমেরিকার ভিসা পাওয়া হয়েছিল। সময় সুযোগের অভাবে আমাদের যাওয়া হয়ে উঠেনি। দীর্ঘদিন পর এবার তাকে দেখতেই মুলত আমাদের আমেরিকা যাওয়া।
গত এপ্রিলের পাঁচ তারিখ ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ‘এয়ার ইন্ডিয়ার’ এয়ার বাসে করে আড়াই ঘণ্টার জার্নি শেষে ঢাকা থেকে দিল্লী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নামার প্রায় চার ঘণ্টা পর ছিল আমাদের সানফ্রানসিস্কো যাওয়ার ফ্লাইটের সময়। ইত্যবসরে আমরা ইমিগ্রেশন শেষ করে নির্ধারিত অপেক্ষমাণ ফ্লাইট লাউঞ্জ খুঁজে নিয়েই ‘দিল্লী ইন্দিরাগান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান’ বন্দরের বিশালত্ব ও সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। চারদিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য কর্ম ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা, দলে দলে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের ইমিগ্রেশন নিয়ে ব্যস্ত বিমান বন্দর দিন না রাত যাচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই। অবশেষে আমাদের ফ্লাইটের সময়ও ঘনিয়ে আসলো, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে বোর্ডিং পাস নিলাম, আমাদের নির্ধারিত এয়ার ইন্ডিয়া কাউন্টার থেকে। নির্ধারিত গেইট খুঁজে নিয়ে ‘সানফ্রানসিসকো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ গামী লাউঞ্জে কিছুক্ষণ বসার পরই আমরা হাজার যাত্রীবাহী এয়ার বাসে নিজ নিজ আসনে বসলাম। এবার এত্তো বড় বিমান দেখে রীতিমত ভয় পাচ্ছিলাম, ভয় লাগার প্রথম কারণ, একনাগাড়ে পনের ঘণ্টা জার্নি, এই পনের ঘণ্টা স্থির হয়ে বসে থাকাওতো একটা বিশাল ব্যাপার, আর দ্বিতীয় কারণ এতো দীর্ঘক্ষণ জার্নি আমার জন্য প্রথম এবং শিশুসুলভ কিছু চিন্তাও মনে উঁকি দিচ্ছে, ঠিকঠাক পৌঁছবো তো! যাক এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কর্মীদের সুব্যবস্থাপনায় মোটামুটি পুরোসময় কেলেঙ্কারী ছাড়া পার করতে পেরেছি। ভয় লাগার আরো কারণ হলো সাধারণত ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পথ হলো সিঙ্গাপুর হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া। ছেলে–বৌমা বা আত্মীয়স্বজনরা এভাবেই আসা–যাওয়া করে। আমরা যেভাবে গেলাম এটি নতুন এবং সাশ্রয়ী। আমার মিতব্যয়ী বর এভাবে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এদিকে যাওয়া মানে দিল্লী হয়ে পুরো প্রশান্ত মহাসাগর আড়াআড়িভাবে চৌদ্দ হাজার কিলোমিটার পার হয়ে প্রশান্তমহাসাগর ঘেঁষে অবস্থিত সানফ্রান্সিসকো বিমান বন্দরে নামা। অবশেষে নির্ধারিত সময়ের আধঘণ্টা আগেই আমরা প্রশান্ত মহাসাগর ও পর্বতমালার অপরূপ প্রাকৃতিক বেষ্টনি ঘেরা আমেরিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্পনগরী সানফ্রানসিসকো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘সানফ্রান্সিসকো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে’ নামলাম।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ক্যালিফোর্নিয়ার সময় সকাল ছয়টা ত্রিশ মিনিটে হাজার যাত্রী নিয়ে আসা বিমান থেকে নেমেই ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে সুদীর্ঘ করিডোর দিয়ে পায়ে হেঁটে, আপনি যদি চান, না হেঁটেও আসতে পারবেন, আমরা ইচ্ছে করেই হেঁটে আসছিলাম আর উপভোগ করছিলাম বিমানবন্দরের বিশালতা প্রাচুর্যতা, এবং সব ধরনের মানুষের উদারতা। স্টিকারের লেখাগুলি পড়তে পড়তে হাঁটছিলাম। বেশি লেখা ছিল ক্যলিফোর্নিয়া স্বাগতম, সানফ্রানসিসকো স্বাগতম। ঝকঝকে তকতকে করিডোর কোনো হুড়াহুড়ি নেই, কোনো ধরনের শব্দ নেই, তখনি আমার প্রিয় দেশের কথা মনে পড়ে গেল, এখানে মানুষে মানুষে দেখা হলে কী আবেগী আলাপ। এখানে সুনসান নীরবতা অথচ দ্রুত লয়ে চলছে যার যার কাজ। কাজের বেলায় বাঙালি বড়ই আলসে, প্রায় আধঘণ্টা পর ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনের শেষে এসে দাঁড়ালাম। ভাবছি কতোক্ষণ না লাগে ইমিগ্রেশন শেষ করতে তবে অনেক বুথ অনেক লাইন।
এই বিমান বন্দরে মিনিটে মিনিটে বিমান আসা যাওয়া করে, তাই হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়ানো, মনে মনে ভাবছি আহা কত সভ্য এরা, এতো মানুষের ভিড়ে কোনো শব্দ নেই, কারো কোনো বিরক্তি নেই, শুধু আমার বিরক্তি লাগছে। একে তো দীর্ঘ জার্নিতে ক্লান্ত শরীর তার উপর কখন পৌঁছাবো ইমিগ্রেশনের বুথের কাছে। ওমা! দেখি আমার সামনেই লম্বা দেহধারী এক নারী সিকিউরিটি পুলিশ কর্মকর্তা বেল্ট খুলে আমাকেই নতুন খোলা বুথ দেখিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলেন, ভাগ্য এখানটায় সহায় হলো, নইলে আধঘণ্টার বেশি লাগতো, বুথের কাছে পৌঁছাতে, আমি মহা আনন্দে ইমিগ্রেশন শেষ করলাম, সাথে আমার হাসবেন্ডও। যাক দ্রুত হয়ে গেল ভেবে স্বস্তি পেলাম। নির্ধারিত বেল্ট থেকে লাগেজ সংগ্রহ করেই ছেলে–বৌমাকে খুঁজছিলাম, না পেলাম না, অগত্যা বিশাল বিমান বন্দর পার হয়ে রাস্তার সাথে লাগানো ওয়েটিং লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ছেলে–বৌমা ঠিকঠাক সময়ে চলে এসেছে, তারা আগেই গাড়ি পার্কিং এর জায়গা অন লাইনে বুকিং দিয়ে রেখেছে, প্রতি ঘণ্টায় ১০ ডলার, এর বিনিময়ে, এটাই নিয়ম, নিয়মের বাইরে কিছুই করা যাবেনা। গাড়ি পার্কিং করেছে চার তলায়, সেখান থেকে বের হওয়া লবিং এ আসতে সময় লাগছে, তা ছাড়া আমাদের খুঁজে পেতেও একটু বিড়ম্বনায় পড়েছে, আমাদের কাছে নেটও নেই, ঢাকায় থাকা ছেলে–বৌমাকেও খবর দেওয়া হয়নি। অবশেষে আমার স্বামী বুদ্ধি করে একজন আমেরিকান নাগরিককে আমাদের অসুবিধার কথা বলায়, তিনি স্ব উদ্যোগে উদারতার সাথে উনার ফোন থেকে ছেলের মোবাইলে ফোন করে আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিলেন, ভদ্রলোককে মুখে ধন্যবাদ দিলাম আর মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। এর পরেই ছেলে আমাদেরকে খুঁজে নিলেন। ছেলে, বৌমার সাথে পার্ক অবধি প্রায়২০ মিনিট কোথাও লিফট, কোথাও সিঁড়ি, আবার কোথাও পায়ে হেঁটে পার্কে রাখা গাড়ির কাছে পৌঁছলাম, তাও বৌমা গাড়ি রাখার সময় পার্কিং করা গাড়ির ফটো তুলে রেখেছিল বলে সহজে খুঁজে নিতে পেরেছে, নাহয় আরও দেরী হতো। বিশাল পার্ক ঘুরেঘুরে আমরা রাস্তায় চলে আসলাম।
ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রানসিস্কো শিল্পনগরীর বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে রাস্তার দুপাশে রেখেই আমাদের গাড়িকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমার ছেলে, পাশের সীটে বৌমা, পিছনের সীটে আমরা। গাড়িতে চড়তে চড়তে আমরা বিমুগদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে দেখছি, সানফ্রান্সিসকো শহরকে। আর আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, ছেলে ও বৌমা, যেমন এই ক্যালিফোর্নিয়ার আরেক নাম ‘গোল্ডেন স্টেট’। এখানে সোনা, রুপা, লোহা ও তামা অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এর রাজধানীর নাম সেক্রোমেন্টো। সানফ্রানসিস্কো শহর ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্পনগরী হিসাবে পরিচিত। এই শহরকে প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিবিদদের শহরও বলা হয়ে থাকে। প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে এই সানফ্রান্সিসকো বন্দরের আবহাওয়াগত অবস্থা ভালো হওয়ার দরুন এখানে শিল্পের প্রসার ঘঠেছে খুব সহজে। পিতা–পুত্রের আলাপের সাথে সাথে গাড়ি শহর ছেড়ে হাই ওয়েতে চলে এসেছে, এখানে সুশৃঙ্খলিতভাবে বিন্যস্ত রাস্তার সারি দেখে বিমুগদ্ধ চোখে ৮০/৯০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত গাড়ি থেকে যা অনুধাবন করছি, এককথায় তা অপূর্ব। শত শত গাড়ি পাঁচলাইন দিয়ে শুধু ছুটছে, ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম আসার রাস্তা কোথায়, ছেলে উত্তরে বললো আসার রাস্তা পাহাড়ের অন্য প্রান্তে, কিছু দূর গেলে আসা–যাওয়ার রাস্তা একসাথে থাকবে, বলতে না বলতেই আমাদের গাড়ি একটি ১২ মাইল দীর্ঘ পাঁচ লাইন আসার ও পাঁচ লাইন যাওয়ার মোট দশ লাইনের ব্রীজে উঠে গেল। হাজার গাড়ির চলমান দৃশ্য ব্রীজের উপর। ব্রীজে উঠতেই আমার, আমাদের পদ্মা সেতুর কথা মনে পড়ে গেল, তবে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ কিলোমিটার, প্রস্থেও অনেক কম। ১২/১৩ মাইল দীর্ঘ এই রকম প্রায় ১২ টার মতো ব্রীজ সানফ্রানসিসকো শহরকে ধরে রেখে যুক্ত করেছে, কারণ প্রশান্ত মহাসাগরের পানি শহরের মধ্যে স্থানে স্থানে ঢুকে পড়েছে। সরকার এই সব স্থানে ব্রীজ করে শহরকে এক করে রেখেছে।
১২ মাইলের জলরাশি পার হওয়ার পর রাস্তার দুদিকে বিশাল বিশাল পাহাড়, পাহাড়তো নয় যেন সারিবদ্ধভাবে পর্বতমালা শুইয়ে বিশ্রাম অবস্থায় রয়েছে। বিশ্রামে আছে বলছি কারণ, পাহাড়ের গায়ে কোনো রকম গাছ নেই, সবুজ শ্যাওলার গভীর চাদরে ঢাকা, মাঝে মাঝে দু–একটা পাহাড়ে গাছ–গাছালি দেখা যাচ্ছে। পরে বৌমার কাছ থেকে জেনেছি মসৃণ পাহাড়গুলো বা পর্বতমালার সারিগুলো পাথরের। ভাবা যায়! কী সমৃদ্ধ দেশ, মনে মনে ভাবছি, ইশ্বরও তো দেখি তেলা মাথায় তেল দিয়েছে। এত সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে বলেই আমেরিকা বিশ্বের সম্পদশালী দেশ! মাটির পাহাড়ে অবশ্য গাছ রয়েছে।
আমি রাস্তার দুপাশ দেখে দেখে চোখ জুড়াচ্ছি, এখানে একটা জিনিষ খেয়াল করলাম গাড়িতে ড্রাইভিং সিট ডান দিকে, ব্রিটিশদের বিপরীতে নাকি সবকিছু্। তার মানে আমাদের বাংলাদেশে ব্রিটিশ নিয়মের গাড়ি রয়েছে, আর একটা অবাক করা বিষয় হলো, কোনো গাড়ি থেকে হর্নের শব্দ নেই, অবশ্য হর্ন করার প্রয়োজনও পড়ছে না, হর্ন বাজানো নাকি আগের গাড়িকে অপমান কর, ভাবা যায়! কত সভ্য এবং দক্ষ এদেশের গাড়ি চালনাকারীগণ। রাস্তায় কোনো ধরনের আওয়াজ নেই, কোনো মানুষ নেই, কোনো ট্রাফিক নেই, রাস্তার মধ্যে সর্বডানে লাল রং দিয়ে আলাদা একটা লাইন আছে এটা পে করা লাইন। যদি কারো দ্রুত যেতে হ্য়, তাহলে ব্যবহার করে। ভুলে যদি কেউ ঐ লাইন দিয়ে যায়, তবে সর্বনিম্ন ২৫০ ডলারের ফাইন স্লিপ তার বাসায় পৌঁছে যায়, এবং একাউন্ট থেকে টাকা কেটে রাখে। সেন্সরে নাকি গাড়ি লাগলেই পুলিশের কাছে খবর পৌঁছে যায়, কী কড়া প্রশাসন! সেজন্য কেউ ভুল করারও সাহস পায় না। এসব আলাপের ভিতর ছেলের দক্ষ হাতের ড্রাইভিং দিয়ে ২০০ মাইলের রাস্তা দু ঘণ্টা ১০ মিনিটে বাসায় এসে পৌঁছে গেলাম।
রাস্তার দুপাশে নানা রকম ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি, কিন্তু বাসার চারপাশ সবুজ সাজানো গাছ আর সজ্জিত পরিপাটি ফুলের বাগান দেখি আরো সুন্দর। ছেলে বৌমাকে বাগান তারা করেছে নাকি প্রশ্ন করলাম, ওরা জবাবে বললো কর্পোরেশন এসব খেয়াল রাখে, তারা শুধু ট্যাক্স দেয়, পরিবেশকে সাজিয়ে, গুছিয়ে রাখা এবং পরিচর্যা করা তাদের দায়িত্ব, আর কারো কোনো দায়িত্বে অবহেলার সুযোগ নেই। বলতে বলতে ছেলে গাড়িকে শেইড দেওয়া নির্ধারিত জায়গায় পার্ক করলো, এখানেও নিয়ম, যেমন প্রতিটি বাড়ির জন্য একটি শেইড দেওয়া পার্ক নির্ধারিত থাকে, কিন্তু এখানে মানুষের সংখ্যার চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি, তাই বাড়ির অন্য সদস্যদের গাড়ি থাকবে খোলা স্থানে। বাড়ির সামনে সারিবদ্ধ ভাবে পার্কিংয়ের স্থান রয়েছে। শেইড দেওয়া স্থানে নির্ধারিত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি রাখলেই গুণতে হবে ফাইন, স্টিকারে লেখা আছে (নো পার্কিং, ইফ পার্কিং পে ২৫০ ডলার)। সেজন্য বৌমার গাড়ি থাকে খোলা জায়গায়। এসব জানতে জানতে বাসায় ঢুকলাম। ভাবছি, আমাদের দেশটা কতো সহজ, সরল, এতো নিয়ম–কানুনের ফাঁদে আমরা নেই। এখানে সব কিছু এমনভাবে সজ্জিত সব কিছুতে ডলার খসানোর ভদ্র ফাঁদ। তাই গরীব জনগণের জন্য আমেরিকা স্বপ্ন নয় যেন দুঃস্বপ্ন।
সেক্ষেত্রে আমরা অনেক ভালো আছি এই বাংলাদেশে, পকেট বুঝে আমরা চলি, বা চলার সুযোগ আছে। এটাই আমাদের স্বাধীনতা। এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বৌমার হাতের সুস্বাদু বাঙালি রান্নায় মন–প্রাণ জুড়িয়ে গেল। মনে মনে ভাবছি এ পর্যন্ত সব ভালোই ভালোই গেল, পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ–নূর ডিগ্রি কলেজ।