দূরের দুরবিনে

অগ্নিযুগের শেষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

এখন আর যাই থাক বা না থাক দ্রোহ বা বিপ্লব বলে কিছু নাই। শুধু বাংলাদেশে নয় দুনিয়া থেকেই এই প্রক্রিয়া বা মানুষের ত্যাগের ইতিহাস বিলুপ্ত প্রায়। আমাদের যৌবন পর্যন্ত আমরা জানতাম যাঁরা দেশ ও মানুষকে ভালোবেসে আত্নদান করেন তাঁরা অমর। আমি চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নিয়েছি। আমাদের এই গৌরবদীপ্ত শহরকে দুনিয়া তথা উপমহাদেশ চেনে বিপ্লবী সূর্য সেনের নামে। বৃটিশ ভারতে অকুতোভয় সূর্য সেন পরিচিত ছিলেন মাষ্টার দা নামে। মাষ্টার দা ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদার কল্পনা যোশীকে চেনে না এমন মানুষ বিরল। এই দলের বিপ্লব বা স্বাধীনতা স্পৃহা শেষতক সার্থক না হলেও তাঁদের প্রাণের বিনিময়েই একসময় ভারতবর্ষ ইংরেজ মুক্ত হবার পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এই বিপ্লবী দলের কনিষ্ঠতম সদস্য ছিলেন ইনি। জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। ১৯২৯ সালে সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। লাভ করেন রায় বাহাদুর বৃত্তি। স্কুল জীবনেই বিপ্লবী যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত হন। এসময় তিনি সংস্পর্শে আসেন মাস্টারদা সূর্য সেনের এবং সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে মাস্টারদার বিপ্লবী বাহিনি ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনির মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে অনেক বীর বিপ্লবী শহীদ হন। বিনোদ বিহারীর কণ্ঠনালীতে গুলি লাগে। গোপনে তাঁকে চিকিৎসা নিতে হয়। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। এরপর পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ভারতের রাজপুতনা দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পাস করেন। ইংরেজ সরকার কর্তৃক গৃহবন্দী অবস্থায় ১৯৩৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ ও বি.এল পাস করেন। সে বছর গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় যুক্ত হন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে শুরু করেন সক্রিয় রাজনীতি চর্চা। ১৯৪১ সালে আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পান ৪৫এর শেষ দিকে। বন্দী থাকাকালীন বিনোদ বিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ৪৬এ মুক্তি পেয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এই তিন পর্বে যত অন্যায়, অপশাসন ও মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটেছে সবটাতেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদে সোচ্চার, লড়াকু সৈনিক।

ছেলেবেলা থেকেই তাঁকে চিনতাম। কিন্তু তাঁর জীবন বা কর্মের গুরুত্ব বোঝার মতো মেধা ছিল না তখন। আমার সৌভাগ্য আমি তাঁদের বাড়ীতে গিয়ে তাঁর অনুজের কাছে ইংরেজির পাঠ নিতাম। পান বাহার এলাচ ও মশলার সুগন্ধি মৌ মৌ বাড়ীটি এখন আর নাই। তিনি তাঁর অনুজ কেউ নাই। কিন্তু স্মৃতিময় সে গলি ভরে আছে তাঁদের পদচারণার মুখরিত অতীতে। তখন না বুঝলেও পরে জেনেছিলাম তারুণ্যে স্বদেশপ্রেম আর পরাধীন দেশ মাতাকে মুক্ত করার জন্য তিনি জীবন উৎসর্গে রাজী এক বিপ্লবী ছিলেন। যাঁর বেঁচে থাকারই কথা ছিলো না। অল্প বয়সে কালাপানিতে দেশান্তরি এই মানুষটিকে সবসময় সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবী ছাড়া কিছু ই পরতে দেখি নি। শারীরিক কাঠামোয় মিল ছিলো আমার সাথে। ছিপছিপে মানুষ কিন্তু বুক ভরা সাহস ও চেতনা। পরে বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর সাহস আর দেশপ্রেম জন্ম নিয়েছিল যৌবনের শুরুতে। বলতে গেলে যৌবন শুরুর আগেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার দেখি নি। শারীরিক কাঠামোয় মিল ছিলো আমার সাথে। ছিপছিপে মানুষ কিন্তু বুক ভরা সাহসও চেতনা। পরে বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর সাহস আর দেশপ্রেম জন্ম নিয়েছিল যৌবনের শুরুতে। বলতে গেলে যৌবন শুরুর আগেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন, নি:শেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই। কেমন সাহসী ছিলেন একটু খুলে বলি।

চট্টল গৌরব আওয়ামী লীগের নেতা প্রাক্তন মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী একসময় বিতর্কে জড়িয়ে গেছিলেন তাঁর সাথে। এই জটিলতার কারণ অনেক। আমি বলব রাজনীতি এমনই। সে কাউকে ছাড় দেয় না। পাওয়ার গেইমে কত কিছু যে ঘটে তা জানা না থাকলে বোঝা মুশকিল। দু বার মেয়র হবার পর প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁকে কাবু করতে না পেরে ভিখারী বলে গালি দিয়েছিলেন। তাঁর অপরাধ ছিলো চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী একটি বালিকা বিদ্যালয়ে দোকানপাট বসানোর বিরোধিতা। কিন্তু তিনি তো দমার পাত্র ছিলেন না। তাঁর রক্তে ছিল বিপ্লবীর রক্তস্রোত। যিনি বৃটিশ শাসনে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি কেন ভয় পাবেন? তাঁকে অবজ্ঞা করে বা উপহাস করে ভিখারী আখ্যা দেয়ার পরিণতি ভালো হয় নি। যদিও আওয়ামী লীগ ঢাকা থেকে আসাদুজ্জামান নূর ভাইকে পাঠিয়ে সমঝোতা ও সম্মানের পথ তৈরী করে দিয়েছিলেন প্রিয় নেত্রী। কিন্তু তারপরও মেয়রের শেষ রক্ষা হয়নি সে যাত্রায় লাখো ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন চৌধুরী সাহেব। এমনই নেপথ্যের শক্তিধার মানুষটিকে বিয়ের পর থেকে দাদু বলে ডাকতাম। তিনি দীপাদের বাড়ীর পাশের মানুষ এবং তাদের স্বজন। গিয়েছিলাম তাঁর সাথে দেখা করতে। তখন তাঁর বয়স একশ। ঘরে ঢুকে প্রণাম করে জানতে চেয়েছিলাম, চিনতে পেরেছেন কি না। তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন। জবাব দিলেন, তোমার কাকুর কাছে ঠিকানা চেয়েছিলাম সিডনিতে চিঠি লিখবো বলে। দেয়নি। দীপা প্রণাম করার পর বললাম, দাদু ওকে চিনতে পেরেছেন? এবারও সরাসরি কোন উত্তর দিলেন না। ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার বাবা কলকাতা যাবার আগে দেখা করার কথা। কিন্তু করে নি। এমনই প্রখর স্মৃতিশক্তি। কি টনটনে স্মৃতিধর। আমার মা তখন নার্সিং হোমে। গুরুতর অসুস্থ মায়ের কথা শুনে শূন্যে তাকিয়ে বলেছিলেন, যাবার মানুষ কে যেতে দেয়াই ভালো। এর একসপ্তাহ পরে মা পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন।

এখন দেশে টাকার ছড়াছড়ি। মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। দেদারসে খরচও করে মানুষ। কিন্তু জৌলুশ আর ভোগের কাছে তলিয়ে গেছে আদর্শ। ডুবুডুবু নৈতিকতা। কোনক্রমে বেঁচে আছে সংস্কৃতি। ধুঁকছে মানুষের বিশ্বাস। খালি আর্থিক উন্নতি যে সবকিছু নয় তা এখন প্রকাশ্য । অথচ কথা ছিল দেশের আর্থিক উন্নয়নের সাথেই এগুবে দেশের সমাজ। যে সব কারণে হয় নি তার একটি বিপ্লবী ত্যাগী মানুষদের কথা মনে না রাখা।তাঁদের সাথে নতুন প্রজন্মের দূরত্ব। যেসব কারণে সামপ্রদায়িকতা হিংসা নৈরাজ্য ও অশ্লীলতা এখন সর্বগ্রাসী। মুক্তির উপায় আমাদের অজানা নয়। যে বিপ্লবীর কথা বলছি তিনি ও এমন একজন যাঁকে স্মরণ করে পার পাওয়া সম্ভব। অথচ আজীবন যিনি ত্যাগ আর সংগ্রামে ছিলেন তাঁর স্মৃতি কতটা আগলে রেখেছি আমরা? চট্টগ্রামের প্রশাসন কি আসলেই কিছু করেছেন এ নিয়ে?

কে কার জন্য কী করলো তার মুখের দিকে তাকিয়ে চলে না ইতিহাস। নিজস্ব গতিতে চলা সময়ে চট্টগ্রামের শেষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী চিরকাল তাঁর জায়গায় থাকবেন। তাঁর অবদান লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। আমার সৌভাগ্য আমিও জন্মেছি তাঁর জন্মদিনে। এই ডাবল আনন্দের অফুরন্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধ জানাই বি বি সি নামে খ্যাত দাদু কে।

লেখক : কবিছড়াশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধপাঠ্য পুস্তকে ভুল দ্রুত সংশোধনের দাবি বিএনপির