দূরের দুরবিনে

আচরণগত আধুনিক সমাজ কত দূর?

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ৭ জুলাই, ২০২৪ at ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছেন। তারা তাদের মতো করে ভালোই আছেন। দুঃখ কষ্ট অভাব অনটন নাই এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু এখন গ্লোবাল রিসেসনের সময়। দুনিয়ার কোন দেশ আছে যেখানে অভাব হানা দেয় নি? অভাব না বলে বরং বলব সংকট। এই সংকটের মূল কারণ মহামারী করোনা আর যুদ্ধ। দেশে দেশে যারা যুদ্ধ বন্ধ না করে আমাদের সরকার বা দেশের মানুষকে বিপদে ফেলে তাদের কথা কেউ বলে না।

আমরা যারা সিডনি প্রবাসী তারা জানি একটা সময় যা ইচ্ছে কেনার সুযোগ ছিল। এবং মানুষ কিনতো। এখন কি আমরা তা পারি? পারি না। কারণ দ্রব্যমূল্য হতে দেয় না। অথচ এসব দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন বলে মূলত কিছু নাই। আছে সমালোচনা আর গঠনমূলক বিরোধিতা। গণতন্ত্রের সংজ্ঞাই তাই। আপনি যদি বহুমত ও পথে বিশ্বাসী হন তো আপনাকে সরকার মানতে হবে। সরকারের ভুল ত্রুটি এবং সমালোচনা করবেন সংসদে কথা বলবেন এটাই নিয়ম। আমাদের সমাজে সে রীতি নাই। গঠনমূলক বলে আসলে কিছু নাই। আছে তীব্র বিরোধিতা বা অন্ধ সমর্থন।

বলছিলাম মানুষ ভালো আছে। তাদের মতো করে তাদের এই ভালোথাকার মূল চালিকা শক্তিগুলোর একটি হচ্ছে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স। এই টাকা পাঠানো মানুষদের নিয়েই আজকের লেখা। সমপ্রতি জরুরি কাজে দেশে যেতে হয়েছিল। খুব অল্প সময়ের এই ঝটিকা সফরে আমার যাত্রাপথ ছিল কুয়ালামপুর হয়ে ঢাকা। কুয়ালামপুর বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই বুঝতে পারি এর পরের চারঘন্টা আকাশ উড়াল সহজ কিছু হবে না। একই এয়ারলাইনস এক দেশ এবং এক পরিষেবা কিন্তু ভিন্ন যাত্রায় ভিন্ন ফল। কারণ এবারের গন্তব্য ঢাকা। কেন এমন হয়?

শুরুতেই বলি সিকিউরিটি চেক আর তল্লাসী এখন বিমান যাত্রার বড় প্রতিবন্ধক। এতে প্রচুর সময় ব্যয় হয় এবং এ প্রক্রিয়া কষ্টকর। শরীরের জামা কাপড় আর হাঁড় গোড় ছাড়া প্রায় সব খুলে দেখাতে হয়। ভিড়াভিড়ির এই পর্যায়ে কে যে কার ব্যাগ নিচ্ছে বা কার ঘড়ি কার হাতে উঠছে বোঝা মুশকিল। এই চেকিং সব দেশে সব বিমানবন্দরে হয়। কিন্তু আপনি সিডনি থেকে মালয়েশিয়া যাবার সময় এমন নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পড়বেন না। কারণ তখন যারা যাত্রী বা লাইনে তারা নিয়ম মানেন। তারা মানে কি আমাদের দেশের মানুষজন নিয়ম মানে না? না এ কথা বলা যাবে না। মানে কিন্তু সব জায়গায় বা সব মানুষ মানে না। না মানার কারণ তাদের অজ্ঞতা। তাদের এ বিষয়ে কোন ধারণা নাই। আর একটা কথা স্বীকার করতেই হবে আমাদের জাতিগত হুড়াহুড়ি সর্বজনবিদিত। আমরা বিয়ে বাড়ি থেকে বাসে ওঠা সব জায়গায় তাড়াহুড়া করতে ভালোবাসি। এই যে বিমান যাত্রা যে বা যারা নিয়ম না মেনে মালয়েশিয়ার মানুষজনের মনে দেশ ও জাতি সম্পর্কে নেগেটিভ ধারণ দিয়ে চলেছেন তারা সবাই জানেন ঐ বিমানটি তাদের ছেড়ে উড়াল দেবে না। তাদের নির্দিষ্ট আসনটিতে আর কেউ বসতে পারবেন না। তবু মাছের বাজারের মতো হুড়াহুড়ি কেন? আমার ধারণা যারা শ্রম বিনিয়োগে দেশান্তরী হয় তাদের এ বিষয়ে ছোটখাটো ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি। আধঘন্টার ছোটখাটো প্রশিক্ষণ পেলেই এরা নিয়ম কানুন মেনে চলতে পারবেন।

এ ঝামেলা পার হবার পর আপনি উড়োজাহাজে চড়ে বসলেও টের পাবেন কেবিন ক্রূ বা সেবক সেবিকারা অন্যান্য ফ্লাইটের মতো আচরণ করছেন না। কেন করেন না? আপনি তাদের দোষারোপ করার আগে নিজেদের কথা ভাবুন। বাংলাদেশের মানুষের হাতে এখন অনেক টাকা। আজকাল প্রায়ই হিল্লী দিল্লী ঘুরে বেড়ায় মানুষ। এমন কি দেশের ভেতরেও আকাশপথে যাতায়াত বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা বলছে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে হলে অন্তত কয়েকদিন আগে এয়ার টিকেট না কাটলে আপনি টিকেট না ও পেতে পারেন। এতো যাত্রা এতো উড়াল অথচ এই মানুষগুলো বিমানে উঠলেই আরেক ধরণের অদ্ভুত হয়ে যায়। আকাশ পথে সামনে লাগানো ছোট টিভি আর খাবার ছাড়া বিনোদনের কোন পথ খোলা থাকে না। মূলত এই ভ্রমণ সবচাইতে একঘেঁয়ে আর অনিরাপদ ভ্রমণ। তাই তারা একটু পর পর খাবার সাধে। এখন আপনাকে বিয়ার দেয়া হয় বলে আপনি কি একটা শেষ না হতেই আরেকটা চাইবেন? আমরা ভুলে যাই দুশো আড়াই শো যাত্রীর জন্য গোটা কয়েক মানুষ নিয়োজিত থাকেন সেবা দানে। তাদের সময় দিতে হয়। ঐ সময়টাই আমাদের নাই।

বাংলাদেশের ভাবমূর্তির বিষয়টা আমাকে ভাবায়। ভীষণ ভাবে ভাবায়। কারণ যে জাতি সাউথ ইষ্ট এশিয়ায় তরতর করে এগিয়ে চলেছে যার গায়ে উন্নয়নের হাওয়া , যার রাস্তা ঘাট অবকাঠামো পুরো বদলে গেছে তার কেন এমন ব্যবহার হবে? আমাদের দেশের নেতা শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর পরিবার ঝাঁ চকচকে আধুনিক। পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় কন্যা পুতুল দারুণ ভাবে কথা বলে। তাদের আধুনিকতা দেখলেই বোঝা যায়। সে দেশের মানুষ হিসেবে আমরা কি আরো আধুনিক হতে পারি না? যে কথা বলছিলাম আমাদের মেধাবী শ্রমশক্তি অন্যান্য দেশে ভালো কাজ করে বলেই জায়গা পায়। যেতে পারে। যে জায়গাটায় ঘাটতি তা হচ্ছে আমাদের এসব শ্রমশক্তিকে একটু আধুনিক করে তোলা। যারা সেদিন আমাদের সাথে ঢাকা গেছিলেন তাদের আচার আচরণ বা পোশাক ইত্যাদি বলে দিয়েছে তারা স্বচ্ছল। তাদের ঘাটতির জায়গাটা ম্যানার বা ব্যবহার। একটি জাতির এ জন্য আইডল দরকার। নেতা বা সমাজপতি নামে পরিচিতদের দরকার নিজেদের সংযত করা। তাদের মানুষ ফলো করে। তাদের আচরণ ও ব্যবহার বা কায়দা কানুন যতটা চমৎকার হবে ততটাই প্রভাব ফেলবে সাধারণ মানুষের জীবনে। তা হলেই আমরা সভ্য ও সুসভ্য হয়ে উঠতে পারবো।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্র এখন আগের জায়গায় নাই। সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই ভ্রূ কুঁচকানোর দিন শেষ। তার জায়গায় ধীরে ধীরে সমীহ আর ভালোলাগা তৈরী হচ্ছে। এখন এই জায়গাটা শক্ত পোক্ত করতে হলে আমাদের শ্রম শক্তি আর সাধারণ মানুষকে প্রাণবন্ত আধুনিক করে তুলতে হবে। দেশে সংস্থা বা যোগ্য মানুষের অভাব নাই। অভাব নাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের। এখন চাইলেই এ কাজ শুরু করা যায়। বলছিলাম দেশ ও দেশের মানুষের ভালো মন্দের কথা। তাদের ভালো মন্দের অন্যতম সূতিকাগার রেমিন্টেস। তার যোগানদাতাদের দেশে বিদেশে ভালো রাখা আর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেই সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে উঠবে। এটাই আমার ধারণা।

লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ডাকাতের গুলিতে’ বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নিহত