দূরের দুরবিনে

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ৩ মার্চ, ২০২৪ at ৭:০৬ পূর্বাহ্ণ

ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এই কথাটি আমাদের সময় খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তখনকার দিনে সংবাদপত্র ছিল মানুষের বিশেষত বাঙালির এক অনিবার্য আহার। ভোর বেলা টুং টাং ঘন্টি বাজিয়ে সাইকেলে করে আসা সংবাদপত্র এবং তা বাড়ির দরজায় ছুঁড়ে দেয়া হকারটি দুধ ওয়ালা কংবা অন্য এমন কারো চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। অভিভাবকেরা দাঁত মাজতে মাজতে দু একবার উঁকি দিয়ে দেখতেন পত্রিকাটি এলো কি না। সংবাদপত্রের সে সময়কালে প্রয়াত জহুর হোসেন চৌধুরীর ‘দরবার ই জহুর’ ছিলো আমাদের সবার পছন্দের অনিবার্য কলাম। দৈনিক সংবাদ যে সেদিন কম করে হলেও হাজার কপি বেশি বিক্রি হতো সে কথা সবাই মানেন। দুঁদে সাংবাদিক অভিজ্ঞ প্রবীণ জহুর হোসেন চৌধুরী সে আমলে ছোট হয়ে আসতে থাকা পৃথিবীর সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। তাঁর তখন ই মনে হয়েছিল দুনিয়া ধীরে ধীরে মুঠোবন্দী হয়ে পড়বে। অমৃতের সন্তান মানুষেরা জানে কি ভাবে তা করতে হয়। এরপর আমাদের সদ্য স্বাধীনদেশের বিমান তার ডানা মেলার নাম দিয়েছিল ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী

এই যে ছোট হয়ে যাওয়া মূলত এর নামে নৈকট্য। আজকাল মানুষ কে কোধায় বসবাস করে বা থাকে তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সে মানুষজন কি ধারণ করেন কেন ধারণ করেন? যাদের মনে মফস্বলি চিন্তা যারা অন্ধ এবং সংকীর্ণ তারা এটা বুঝতে পারে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই তারাই আবার রাজনৈতিক কারণে দেশের ভালো মন্দ যাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বা দিতে চান তাদের সবাই দেশের বাইরে থাকেন। আমি কোন রাজনীতির নাম গন্ধের উল্লেখ করবো না। কিন্তু বিলেত আমেরিকা বা অন্যদেশের দিকে তাকালেই আপনি এর সত্যতা টের পাবেন । এই বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করা মানুষরা কেন বাস্তবতা অস্বীকার করেন মাঝে মাঝে? কারণ তাদের চোখ অন্ধ অথবা কেউ তাদের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখে।

কিন্তু অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? আমরা এখন এই বাস্তবতার ভেতরে দেখছি দেশে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না কতটা আছে বা নাই সে নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন আমেরিকান মানুষজন। আমাদের সমাজ ও জীবনে পাশ্চাত্যের প্রভাব কতটা সে আপনি তারুণ্যের দিকে তাকালেই বুঝে যাবেন। সে দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আপনি মফস্বলী চিন্তায় সমাজের কোন উপকার করতে পারবেন? বাঙালির ইতিহাস জানলেও দেখবেন বরেণ্য মানুষের অনেকেই জীবনের একটা বড় সময় বিদেশে কাটিয়ে এসেছিলেন। লাল সালুর মতো উপন্যাস কটা আছে আমাদের? যিনি তা লিখলেন তাঁর জীবনতো বিদেশেই কেটে গেছিল। মৃত্যুর পরও অমর এই লেখকের নামে বাংলা একাডেমির পুরস্কারের নাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার। শুধু তিনি কেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও আমাদের জাতি মানতে বাধ্য হয়েছিল যখন ১৯১৩ সালে তিনি প্রথম বাঙালিকে নোবেল এনে দিতে পেরেছিলেন। আন্তর্জাতিকতার সাথে যুক্ত থাকাটা অপরাধ নয়। বরং কিছু না জেনে কুয়োর ব্যাঙ হওয়াটা অপরাধ। বাঙালিকে সত্যজিত রায় তাঁর আগন্তুক ছবিতে যে বার্তা দিয়ে গেছেন সেটি আবারো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। উৎপল দত্ত বাচ্চাটির কাছে রেখেছিলেন কুপমন্ডক মানে কি? নিজেই বলে দিয়েছিলেন, কূপ মানে কুয়া আর মন্ডক মানে ব্যাঙ। সাথে এটা বলতে ও ভোলেন নি, “জীবনে আর যাই হও কূপমন্ডক হয়ো না।

বাংলাদেশের সামনে এখন নতুন পৃথিবীর গভীর হাতছানি। আপনি রাজধানীর বাইরে থাকেন বলে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন তাতে কি সময় ছেড়ে কথা বলবে? সময় এখন যুক্ত হবার। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটির ওপর বাংলাদেশিরা বসবাস করেন। তারা কষ্ট করে পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায়। আপনি যাকে বলেন রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স আসা বন্ধ হলে বা কমে গেলে কি হতে পারে কোন ধারণা আছে? আপনি কি ভাবেন যে যাদের দেশে স্বামী স্ত্রী বা কন্যা পুত্র থাকে শুধু তারাই টাকা পাঠায়? এমন হাজার হাজার বাংলাদেশিকে আমরা জানি যারা অসহায় গরীব এবং সহাববান মানুষের জন্য ও টাকা পাঠায়। কারণ তাদের স্বপ্ন আছে। এই দেশ তাদের জন্মভূমি। এই মাটিতে তারা হাঁটা শিখেছিল। এই ভাষাতে তারা প্রেম করে লেখে কথা বলে। এই অধিকার জন্মগত । কাজেই আমাদের এটা মনে রাখতেই হবে আজকের পৃথিবী দেয়া নেয়ার এক অপূর্ব সম্মিলনের পৃথিবী। যার ভেতরের মানুষ বাইরের মানুষ সব মিলেমিশে একাকার।

এই কথাগুলো বলার কারণ কোন ভাবেই আমার ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি না। এমন কি আমাদের চরম কষ্ট বা পরম প্রাপ্তির কালেও আমরা একসাথে কাউকে মানতে পারি না। বহুমত ও পথ স্বাস্থ্যকর এটা মানি। কিন্তু বহু বিরোধিতা একটি জাতিকে দীর্ন করে দুর্বল করে। যে আঘাত এবার আমরা ব ই মেলার মতো সংস্কৃতির পাদপীঠেও দেখছি। দেশ বিদেশের বই আসবে বিক্রি হবে এটাই আমাদের মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল। দেশের লেখকেরা প্রাধান্য পাবেন এই ছিল প্রত্যাশা। সেটা কতটা হচ্ছে বা হয়েছে সে আলোচনায় যাবো না। কিন্তু এই যে আমাদের সীমাবদ্ধতা এবং উদার হবার বেলায় সংকীর্ণতা তার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে এমন কিছু বিষয় যা এখন আতংকের। আপনি আমি সবাই জানি সাবরিনা কেন জেলে গিয়েছিলেন। আইনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা বোধ থাকলেই বোঝা সম্ভব সে অপরাধ কতটা গর্হিত। করোনার মতো ভয়াবহ মহামারীকালে যারা কোভিড টেস্ট নিয়ে ব্যবসা করতে পারে বা ভুয়া সার্টিফিকেট দিতে পেরেছিল তাদের আমরা হটকেক বিক্রি হতে দেখছি। মহামারী সময়ে জালিয়াতির কথা ভুলে গিয়ে হঠাৎ জেগে ওঠা এই সিমপ্যাথি বা সহানুভূতি আসলে কিসের ঈঙ্গিত বহন করে? বলার ইচ্ছে না থাকলেও বলতে হয় অসম বিবাহ নতুন কিছু না। সে ইতিহাস বাঙালির প্রাচীন।

জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ডা. সাবরিনা শারমিন হোসেন এবং তার স্বামী আরিফুল চৌধুরী মিলে করোনা টেস্টের ভুয়া সনদ বিক্রি করেছেন। প্রতিটি টেস্টের জন্য জনপ্রতি নিয়েছেন সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। আর বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি তারা নিতেন ১০০ ডলার। অর্থাৎ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি জেল থেকে বেরিয়ে একটি বই লিখলেন আর সেটি ১১ দিনের মধ্যে স্টক আউট হয়ে গেলো, এটি সমাজে এবং পাঠকসমাজে কী বার্তা দেয়?

এবারের বইমেলার আরও দুটি আলোচিত চরিত্র মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ এবং একই কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশা। এই দম্পতির দুটি বই নিয়েও এবারের বইমেলায় তোলপাড় হয়েছে। বই দুটির নাম ‘তিশা অ্যান্ড মুশতাক’ এবং ‘তিশার ভালোবাসা’। (আমিন আল রাশিদী)

এই সব ভয়াহতা আমাদের সমাজকে যেন গ্রাস করতে না পারে। যারা দেশের ভেতরে বসবাস করেন তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ও এটা ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিৎ। সবাই মিলে মনে প্রাণে দেশ ও ঐতিহ্য ধারণের পরিবর্তে ঠুনকো বিবাদ আর অনৈক্যে সকলেরই দুঃখ বাড়ে। আমাদের সবার যোগেই জয় হবে দেশ জাতির। এটাই ইতিহাস বলে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধগাউসিয়া কমিটি পাহাড়তলী থানা শাখার সভা