প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামপ্রতিক সফরকে ঘিরে ওয়াশিংটন ও লন্ডনে যা ঘটেছে তা সকলেরই কম বেশী জানা। এর নিন্দা জানানোর ভাষা নাই। রাজনীতি ও দলের নামে দেশ ও দেশের মানুষের ভাবমূর্তির এই অপমান প্রতিবাদ বলে মেনে নেয়া কঠিন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি উপমহাদেশের কোন দেশ বা পাশের কোন প্রতিবেশী দেশের মানুষেরা তা করে না। এই ঘটনাগুলো সবার মনে যখন নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করছে তখন একটি শিশু আমাকে দিয়ে গেলো দেশপ্রেমের নতুন শিক্ষা। যে খুব সমপ্রতি সিডনি ঘুরে গেল।
ঋক একজন বাংলাদেশী শিশু। সে এসেছিল বেড়াতে। তার মায়ের সাথে। জন্ম তার সিডনি হলে ও তার মা বাবা দেশের টানে ফিরে গিয়েছিল একসময়। শিশু ঋক সে সূত্রে বাংলাদেশ ও অষ্ট্রেলিয়া দু দেশের ই নাগরিক। সে এসবের কিছু বোঝে না। এমন না যে তার বোঝার বয়স হচ্ছে না। তবে ঐ যে শিশু মন সে মনটি এখনো কাঁচা। ও যা বিশ্বাস করে তাই বলে। আমি তাকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে দেখলাম। এ দেশের ভালো ভালো দিকগুলো তুলে ধরে খাইয়ে দাইয়ে যত ই জিজ্ঞেস করি তার এক কথা, ও দেশে ফিরে যাবে। এখানে ওর ভালোলাগে না। কেন ভালো লাগে না এর জবাব দিতে পারে না। তাই পাল্টা প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে কি কি ভালো লাগে? শিশু তার নির্মল উত্তরে জানায়, ওখানে তার দাদু দাদী বন্ধুবান্ধব আর খেলাধুলা আছে। একসময় হঠাৎ করে তার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষগুলো ভালো।
আমরা যারা বহুবছর আগে দেশের অবস্থা আর মানুষদের খারাপ ভেবে চলে এসেছি এ যেন তাদের গালে চপেটাঘাত। আমরা সুবিধাবাদী এবং স্বার্থপর। সবুর করতে শিখি নি। কিন্তু এটাও সত্য তখনকার বাংলাদেশের চেহারা ছিল ভিন্ন। পরতে পরতে অভাব আর অশান্তি। সে অশান্তির মূল কারণ ছিল রাজনীতি। আজকের এই শিশু জানে না সেদিনকার বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছিল প্রায়। মানুষ কাজ পেতো না। কাজ ছিল না। ভিখারী আর দরিদ্র মানুষের ভীড়ে পরিপূর্ণ সে বাংলাদেশ এই শিশু দেখে নি। দেখে নি দিনের পর দিন হরতাল আর জ্বালাও পোড়াও। আমরা তখন কাজে যেতাম পায়ে হেঁটে। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানোর পর ও নিশ্চিত ছিল না কাজ করা যাবে কি না। এক দল বাধা দিতে মরিয়া আর একদল চাইতো তাদের অনুগত হয়ে দাসের মতো থাকা।
এই শিশুটি দেখেছে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে এখন জ্বালাও পোড়াও প্রায় উধাও। হরতাল ভাঙ্গচুরের দিন শেষ। আজকের বাংলাদেশে অভাব নাই বলা যাবে না। কিন্তু সে সময়কালের মতো দারিদ্র্য নাই । মানুষ মোটামুটি খেয়ে পড়ে ভালো আছে। বিশ্ব বাস্তবতার কারণে সারা দুনিয়া ভুগছে। এর প্রভাব দেশে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। দ্রব্যমূল্যের কারণে নাভিঃশ্বাস উঠলেও পরিবেশ এখনো নিয়ন্ত্রণাধীন । শিশু ঋক বাংলাদেশের রাজনীতি বোঝে না। আওয়ামী লীগ বিএনপি জানে না । ওর চোখে ওর ভাবনায় যে বাংলাদেশ সেখানে সামপ্রদায়িকতা নাই। নাই কোন বিদ্বেষ বা হানাহানি। আমি মুগ্ধ হয়েছি তার মতো একটি শিশুর দেশপ্রেমে। বড়দের ভেতর এর ছিটেফোঁটা থাকলেও আজ ওয়াশিংটনের ঘটনা ঘটতো না।
আমেরিকা সফরে থাকা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানানোর নামে বড়রাই নষ্ট করলো দেশের ভাবমূর্তি। আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের জন্য এমন দুর্ভাগ্য আগে কখনো আসে নি। বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তার মানে এই না যে চাইলেই কারো ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি এই দুই শিবিরে বিভক্ত দেশ আজ বিদেশে ও তার বিষ নিঃশ্বাস ফেলছে। এখন তো এই ঘটনা আমাদের সবাইকে হতবাক করার পাশাপাশি অনিরাপদ ভাবতেও বাধ্য করছে। এক দেশের এক জাতির এক সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে এমন হিংস্র হতে পারলে বাকী থাকলো কি?
বাংলাদেশের রাজনীতি বহু আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যা আছে তার নাম হিংসা। এই হিংসার কারণেই আমাদের ভাবমূর্তি বারংবার বিপদের মুখে পড়ে। কে দায়ী বা কা‘রা দায়ী সেটা বড় বিষয় কি না জানি না যেটা বুঝি তা হলো কোন ভাবেই এ হিংসা ছড়াতে দেয়া যাবে না। তারচেয়ে অনেক বেশী দরকার সংহতি। ছোট শিশু ঋকদের যে বাংলাদেশ তার স্বপ্ন নষ্ট করার অধিকার নাই কারো। একবার ভাবুন, প্রবাসে বড় হয়ে ওঠা শিশু কিশোর কিশোরীদের মনে এর প্রভাব কি ভাবে পড়বে? রাতদিন ধরে মায়েরা বাচ্চাদের দেশ ও তার শেকড় বোঝাতে ব্যস্ত। যারা এই হানাহানিতে মত্ত তারা ভুলে গেলেন নিজের ছেলে মেয়েদের তারা কত কষ্ট করে বাংলা স্কুলে নিয়ে যান। কত সময় ব্যয় করে তাদের বাংলা শেখান। ডলার খরচ করে মাঝে মাঝে দেশে নিয়ে যান সন্তান সন্ততিদের। এত আয়োজন আর এত শ্রম সবকিছু ব্যর্থ করে দিলো নিজেরাই। তারপর ও আশা করবো দেশের স্বার্থে দেশের ভালো বিবেচনায় মনে শান্তি নেমে আসুক। আসুক আচরণে।
শিশুটির বুকে যে বাংলাদেশ মায়ার যে টান তাকে সম্মান করা তাকে তুলে রাখার দায় আমাদের। আমাদের বাংলাদেশ আজ বিশ্বস্বীকৃত উন্নয়নশীল একটি দেশ । যে দেশের সমাজে হাজার সমস্যা থাকার পর ও মানুষ দেশের টানে এক ও অভিন্ন । আমার সবসময় মনে হয় এত পরিশ্রমী মেধাবী জাতি খুব কম আছে দুনিয়ায় । চাইলেই বহু বড় কাজ করার সাধ্য আছে বাংলাদেশীদের। ইতিহাস তাই বলে। এমন কি আজকের দিনেও আপনি যদি পাশের বঙ্গের সাথে তুলনা করেন দেখবেন বাংলাদেশের মানুষ কতটা পরিশ্রমী আর সাহসী। এই সাহসকে রাজনীতি বিপথে না নিলে ঐক্য থাকলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতো এক পরম বিস্ময়।
দার্শনিক ও রাষ্টচিন্তকেরা মনে করেন শিশুরাই সত্য বলে। তাদের মনে না থাকে কোন পঙ্কিলতা না কোন ঝামেলা। তারা সেকারণেই দেবশিশু। একটি শিশুর চোখে আমি যে বাংলাদেশ দেখলাম তা অপূর্ব। সিডনির জাকজমক জৌলুশ আবর্জনাহীন পরিবেশ নিয়মে বাঁধা সহজ জীবন। পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, ট্রাফিক মুক্ত যানজট মুক্ত এই নগরীও বাচ্চাটির মন কেড়ে নিতে পারে নি। কারণ তার রক্তে শিরায় ধমনীতে ঢুকে আছে স্বদেশের আসল রূপ। একেই আমরা বলি কোমলমতি। এরাই বাংলাদেশের আসল ভবিষ্যত। আমাদের বয়সের সাথে সাথে রাজনীতি ও নানা দ্বন্দ্ব ঢুকে মন ও চিন্তাকে বিষিয়ে দিয়েছে বলেই আমরা দেশের খাঁটি চেহারা বা আসল রূপ দেখতে পাই না।
ছোট্ট ঋক বাংলাদেশের সেই প্রতীক যার ভেতরে আছে বাইরের দেশ ও দেশের আসল সংযোগ। এই দেশপ্রেম প্রবাসীদের জাগিয়ে তুললে অনেক সমস্যা ম্লান হয়ে পড়বে। সবার ওপরে যে দেশ সেটাই শিখলাম নতুন করে।
লেখক : কবি–ছড়াশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট