শিক্ষা পরীক্ষা ফলাফল : জীবনে বড় হয়ে ওঠা
নোবেল পুরস্কারজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’ মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্বল্প বেতনে কেরানির কাজ নেন। কিন্তু তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন, একদিন তিনি একজন বড় লেখক হবেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে তার ৯ বছর সময় লেগেছিল। তার বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। লেখক হিসেবেই পরবর্তী জীবনে উপার্জন করেছেন লাখ লাখ টাকা। তার চেয়েও বড় কথা, বিশ্বব্যাপী শাশ্বত কালের খ্যাতি তার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাও তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। ম্যান্ডেলার বাবা যখন মারা যান, তখন তিনি ছিলেন নয় বছরের শিশু। এরপর মা ম্যান্ডেলাকে নিয়ে কুনু গ্রামে চলে আসেন। ক্ষুদ্র একটি কুটিরে বসবাস করতেন। কোনোরকমে শাকসবজি খেয়ে জীবনধারণ করতেন। তখন কে ভেবেছিল, এই ছোট্ট ছেলেটিই একদিন বিশ্বব্যাপী কিংবদন্তি হয়ে উঠবে।
এইচ এস সি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে। এবারের প্রধান বিষয় কারো ফেল না করা। এমনটা কখনো ভাবা যায় না দেশে। অথচ দুনিয়ার উন্নত আধুনিক দেশ ও সমাজে ফেল বলে কোন বিষয় নাই। নাম্বার কম বেশী আছে, আছে ভালো ভাবে পাশ করা। মেধার ভিত্তিতে ডাক্তার, ইনজিনিয়ার, আমলা হওয়া কিন্তু নাই ফেল করা। অকৃতকার্য কেন হবে একটি কিশোর বা কিশোরী? ফলাফলের নাম্বার আসলে কি জীবনে খুব প্রভাব রাখে? এক পর্যায়ে তার কোন হদিস রাখে না কেউ। তার চাইতে বড় হয়ে ওঠে মেধা আর শ্রমের কারণে বড় হয়ে ওঠা।
আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করি। এবারে কঠিন করোনা কালে বাংলাদেশ যেভাবে স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিরাপদ রেখেছে তাদের জীবন বাঁচাতে বন্ধ রেখেছে তা সবমহলে প্রশংসিত। সে কারণে এবারের ফলাফল এমন অভিনব। আর এই অভিনবত্ব মানতে পারছেন না সমালোচকের দল। এরা কারা জানেন? এদের নাম সবজান্তা। এর এইচএসসি ফলাফল থেকে করোনার টিকা সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। অথচ ইতিহাস কি বলে?
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরেই শুনলাম অটো প্রমোশন পেয়েছি সবাই। ক্লাশ এইট পড়া হয় নি। যারা আরো এক এক ধাপ ওপরে তারাও পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করেছিলেন। তাতে কি স্বাধীন দেশের পিলার খসে পড়েছিল? না মন্ত্রী আমলা সচিব থেকে মেধাও শিক্ষায় ধস নেমেছিল? এখনকার তুলনায় যারা আপনারা সে সময়কালকে স্বর্ণযুগ মনে করেন তাদের বলি তাহলে আজ কেন সুর বদলে বাজে কথা বলছেন?
এবারের মহামারী করোনা তো একদেশের যুদ্ধ না। দুনিয়ার ছোট বড় সব দেশ লড়াই করছে। এই সিডনিতেও ইয়ার টুয়েলভের ওরা পরীক্ষা দিয়েছিল বটে কিন্তু পড়াশোনা করতে পারে নি। অনলাইনে যা কিছু তাই ছিলো ভরসা।ওদের মানদণ্ড ও নির্ধারণ হয়েছে সে ভাবে।
দেশে স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিলো না। বাচ্চাদের জীবন বাঁচাতে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চমৎকারভাবে কথা বলেন। তিনি বারবার এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাঁদের কথা বলেছেন। সাথে ছিলেন চাটগাঁইয়া নওজোয়ান নোফেল।তাঁরা তাঁদের কাজ করেছেন।
সমালোচকরা এটা ভাবেন না ফলাফল না দিয়ে অটো পাসের মশকরা হতো আরো বিপজ্জনক। বরং এমনটা হওয়ায় ছাত্র ছাত্রীদের মনে একটা আবেগ কাজ করবেই। যারা ভালো করেছে তারা তা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করবে। আর যারা মোটামুটি উতরে গেছে তারা হবে সাবধানী। আমার ধারণা এমন একটা কাজ করার জন্য মন্ত্রী দীপু মনিকে অভিনন্দন জানানো উচিত। আমাদের সমাজে আজকাল বোদ্ধার ঢল।
এই বোদ্ধারা সবকিছু বোঝে। তারা পৃথিবীর সেরা বিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হয় তার খবর রাখে না। আবার এটাতো জানে না মূলত আন্তর্জাতিক লেভেলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। এখন সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন মানদন্ডে আমরা নাই। আমাদের জায়গা পাকিস্তান থেকেও খারাপ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তখন তারা কিছু বলে না। আজ এইসব বাচ্চাদের ওপর খবরদারী আর মাস্টারী ফলাবার মানুষগুলো করোনার সময় ঘরের বাইরে ছিলো? তারা ভিতরে সাবধানে থাকবে আর বাচ্চারা ঝুঁকিতে পড়বে। কী দারুণ হিসাব। এসব বাচ্চারা কষ্ট করে অনলাইনে পড়ে বা ঘরে বন্দী থেকে যা করেছে তার পুরস্কার হিসেবে এই ফল আমার মতে চমৎকার উপহার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় যে ধাপটিকে সেটি হচ্ছে এইচ এস সি পরীক্ষা। কেননা স্কুল এর ক্লাসগুলোর রেজাল্ট তার পরের ক্লাসের জন্যেই কেবল দরকার হয়। সেখানে এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট কিংবা পড়াশোনা সবকিছুই একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিতে সাহায্য করে। কিন্তু অনেক সময় নানা কারণে এই ধাপটিতে এসে আমাদের অনেকের পর্যাপ্ত মেধা কিংবা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে যেতে হয়। এরই উদাহরণ হচ্ছে – এইচ এস সি পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত জিপিএ না পাওয়া কিংবা কোনো এক বা দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া। তার মানে ফেল করার জন্য তার জীবনটাই মাটি হয়ে যায়। আমি মনে করি এই ফেল বিষয়টাই না থাকা উচিত। আপনি বাইরে এসে দেখেন কোন মিস্ত্রী বা ইলেকক্ট্রেশিয়ানের কদর কতো। তার দাম যে কোন ডাক্তারের চেয়ে কম কিছু না।
এটার মানে এই না ফলাফল বা মেধাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এর মানে শ্রমের মূল্য দেয়া। আর মেধা ও শ্রম ই মানুষকে জীবনে বড় করে। এবারের যারা ফেল না করা ছাত্র ছাত্রী তাদের জন্য বিষয়টা বা জীবনযুদ্ধে যাওয়াটা বরং সহজ হয়ে গেলো। আমি মনে করি এর বাইরে করার কিছু ছিলো না সমালোচকরা ও কোন পরামর্শ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না।
আগের দুটো পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এইচ এস সির এই রেজাল্ট সময়ের চাহিদা। সবচেয়ে বড় কথা ওদের কোমল মনে খারাপ কোন প্রভাব পড়তে দেয়া হয়নি বা একটি বছর মাইনাস হতে দেয়া হয় নি।
বাচ্চাগুলোর হাসিমুখ ও আনন্দকে ম্লান করবেন না হে নিন্দুক। সবচেয়ে বড় কথা এ বছর কেউ কাঁদে নি। কেউ ফেল করার দুঃখে আত্মহত্যা করে নি। চিরিয়ার্স হে নবীন। আমরা আছি তোমাদের সাথে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট