বলা হতো খেলার রাজা ক্রিকেট আর রাজার খেলা পোলো। ক্রিকেট খেলার রাজা ছিল একসময়। এখন আর আছে বলে মনে হয় না। উপমহাদেশের বাইরে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড সাউথ আফ্রিকা বাদে আর কোথাও ক্রিকেট চলে না। মানুষ ক্রিকেট জানে না বোঝেও না। আমাদের এই সিডনি শহরে মাঠে হাজার হাজর দর্শক দেখে আপনি যদি মনে করেন ক্রিকেট এ দেশের এক নাম্বার খেলা তাহলে ভুল করবেন। এখনো তার অবস্থান তিন বা চার নাম্বারে। ক্রিকেট এদেশে সবার খেলা নয়। যারা বোঝে জানে বা পছন্দ করে তারা ছাড়া উন্মাদনার জন্য কেউ মাঠে ভিড় বাড়ায় না। কথাগুলো বললাম এই কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত এই তিনদেশে ক্রিকেট খেলা এখন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের আগুনে টগবগ করে ফোটা মানুষগুলো ভুলে যায় তাদের নাম ধাম পরিচয় বা অবস্থান। বন্ধু থেকে দুশমন দুশমন থেকে শত্রুতে পরিণত করা খেলার দরকার কতটা? এই প্রস্ন এখন জরুরি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষত যখন আমাদের দেশের অস্তিত্ব আর পরিচয় নিয়ে তৈরী হচ্ছে গভীর সংকট। খেলার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নাই এসব মন ভোলানো কথা এখন অচল। এশিয়ান কাপে আমরা যা দেখলাম তার সারকথা হচ্ছে খেলা আর খেলার জায়গায় নাই। খেলা পুরাই রাজনীতির দখলে।
ভারত পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা করমর্দন করেন নি। একে অপরকে আউট করার পর দেহভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা যুদ্ধের কথা ভোলে নি। প্লেন ভূপাতিত করার ভঙ্গি আর যাই হোক পারস্পরিক ভালোবাসা বা সৌন্দর্যের কথা বলে না। সবশেষে ট্রফিও নিতে পারে নি বিজয়ী দল। তারা যেমন তা নেয় নি যিনি দেয়ার তিনিও সেটা নিয়ে চলে গেছেন। এতো বৈরীতা কি মানুষের মনে সহজ ভাবে খেলা দেখার আনন্দ বজায় রাখতে পারে? না তা সম্ভব ?
এখন এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে খেলা আর খেলা নেই। আমরা জেতা খেলা বহুবার হেরেছি। আবার হারা খেলাও জিতেছি। এটাই খেলার সৌন্দর্য। তবে মানা না মানার বিষয়টা এখন এমন স্তরে, যেখানে বিবাদ বা কলহ ছাড়া কেউ কাউকে মানছে না। না মানার জন্য মিডিয়া আচরণ আর পরিবেশ দায়ী। সামাজিক মিডিয়া এখন এমন এক ভূমিকায়, যেখানে তার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হলেও সেটা সম্ভবপর হচ্ছে না। কী হচ্ছে এখানে? দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে এত বিবাদ বা কলহের কারণ কিন্তু আগেও ছিল। সেটা উস্কে দেওয়ার মিডিয়া বা মাধ্যম ছিল না তখন। যার যা খুশি বলতে পারা বা লিখতে পারার মুশকিল এখন প্রকাশ্য।
আগে বলি আমি নিজে ক্রিকেট–পাগল মানুষ। একসময় ক্রিকেট খেলা এবং দেখা দুটোই ছিল পছন্দের শীর্ষে। তখন এই খেলাটি ছিল ক্লাসিক। বলছি না এখন নেই, কিন্তু জৌলুস বাড়লেও তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে নানাভাবে। পাঁচদিনের ক্রিকেট ক্লান্তিকর ছিল বৈকি। সে ক্লান্তির ভেতর যে নিয়মানুবর্তিতা বা ধৈর্য সেটা উধাও এখন। যে খেলোয়াড় পাঁচদিন মাঠে থাকে বা খেলে তার জীবনে কিছু নিয়ম এমনিতেই কাজ করতে শুরু করে। সে জানে কীভাবে সবুর করতে হয়। এরপর ক্রিকেটে ওয়ানডে’র শুরু। সেটাও মন্দ না। একটা খেলায় জয়–পরাজয় থাকা জরুরি। তা না হলে মানুষ খেলা দেখতে যাবে কী কারণে? সেটা ফিরিয়ে এনেছিল ওয়ানডে। ওয়ানডেতে এখনও শিল্প বা কৌশল কাজ করে। কিন্তু বাণিজ্য বা করপোরেট সেখানেও আঘাত হানলো। তার মনে হলো মানুষকে আরও একটু পাগলাটে করে তোলা দরকার। তাদের ভেতর আরও জোশ আরও উত্তেজনা মানেই আরও টিকেট বিক্রি। আরও উপার্জন। আরও বিজ্ঞাপন আরও স্পনসর আরও জুয়া। তার হাত ধরে এলো টি–টোয়েন্টি। যখন থেকে এই খেলার শুরু তখন থেকে কেউ আর ব্যাট হাতে দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গিতে মাঠে নামে না। যেমন ধরুন এম এস ধোনি। তাকে আমার কখনও ভালো লাগেনি। শুরু থেকেই মনে হতো যুদ্ধ করতে নামছেন। আর ভঙ্গিও মারাত্মক। কী দেখলাম আমরা? যেকোনও উপায়ে একটি বলকে মাঠ টপকে বাইরে পাঠানোই যেন খেলা। সেটা ভালোভাবে শিল্পমানে পাঠানো হোক বা গায়ের জোরে মারা হোক। শচীন লারাদের সেসব ধ্রপদী শটগুলো হারিয়ে গাভাসকারের মতো বড় খেলোয়াড়ও বলতে শুরু করলেন এর নাম হেলিকপ্টার শট।
পচে যাওয়ার আর কী বাকি আছে? বলছিলাম আমাদের খেলার কথা। প্রতিবার খেলার আগে আমরা দেশপ্রেমের নামে যেভাবে জেগে উঠি তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই জেগে ওঠাটা কী সব কাজে সবকিছুতে হতে পারে না? দেশপ্রেম মানে কি ক্রিকেটে জিতে আসা? যে খেলা আমাদের হিন্দু মুসলিম বাঙালি ভারতীয় পাকিতে বিভক্ত করে তার জন্য জান দেওয়া মানুষ ভুলে যায় সমাজে কত অনাচার আর কত ধরনের অনিয়ম।
বাংলাদেশের সমাজ আর জনজীবনে এমনিতেই সমস্যার অন্ত নাই একনায়কতান্ত্রিকতার অবসানের পর যে শান্তি আর শৃঙ্খলা ফিরে আসার কথা তা আসে নি। ভালোয় ভালোয় শারদীয় উৎসব শেষ হ ওয়ায় মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু এই ক্রিকেট যে এখন বিষফোঁড়া সেটা ভুললেও চলবে না। এশিয়ান কাপে জয় পরাজয়ের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে ভারত পাকিস্তানের রাজনীতি। প্রশ্নটা খুব সহজ, বাংলাদেশের বাঙালি প্রায় আশি বছর পর ও এই দু দেশের কথা ভুলতে পারলো না কেন? কেন তাদের নামে তারুণ্যে এই উন্মাদনা?
খেলাধুলা মানসিক ও শারীরিক বিকাশের অংশ এসব যারা বলতেন তাদের জমানা শেষ। এগুলো এখন কথার কথা। মূলত খেলাই হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পারস্পরিক বৈরীতা দেখানোর প্ল্যাটফর্ম। একথা ভুললে চলবে না উপমহাদেশের ক্রিকেট এখন মৈত্রীর পরিবর্তে বিভেদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে চাইছে। যে অপস্রোতে কর্তা নামে পরিচিত বিশেষজ্ঞরা ও পথ হারাচ্ছেন।
উপায় কি ক্রিকেট বন্ধ করে দেয়া? উত্তর হবে না। বরং যে ম্যাচ বা যে খেলা যুদ্ধের আবহ তৈরী করে তাকে প্রশমিত করা তার যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করাই হবে কাজের কাজ । সেটা মিডিয়া পারে পারে সুশীল সমাজ পারে ক্রিকেট বোদ্ধা আর সমর্থকেরা। তারা যদি সস্তা জনপ্রিয়তা আর ব্যসার লোভে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব চালু রাখতে চান তাহলে ক্রিকেট খেলার ভবিষ্যত বিপন্ন হবে। একসময় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। খেলার রাজা ক্রিকেটের মান অপমান সমঝে চলার সময় এসে গেছে। মানুষকে ভালো থাকতে দিন। উপভোগ করতে দিন এর বাইরে বাকী সব ই বানোয়াট।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক।