‘গ্লোবাল সাউথ’ আজ একটি শক্তিশালী ধারণা। যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো নতুন সংহতি গড়ে তুলছে। এটিকে দক্ষিণ–দক্ষিণ সহযোগিতা (South-South Cooperation) বলা হয়। এক সময় যেখানে বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত উত্তর গোলার্ধের উন্নত দেশগুলোর হাতে, আজ সেখানে গ্লোবাল সাউথ বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরছে। চীন বিশ্বব্যাপী এখন এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যা ব্রিকস সমপ্রসারণের মতো উদ্যোগ থেকে শুরু করে এসসিও’র আঞ্চলিক নিরাপত্তা ফোরামের মধ্যে আবর্তিত। সবই মূলত আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলার অংশ।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো পুতিনকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু গ্লোবাল সাউথের জোটগুলো রাশিয়াকে কূটনৈতিক মঞ্চে আবারও ফিরিয়ে আনছে। এসসিও সম্মেলনে পুতিন, শি এবং মোদির একসঙ্গে থাকা রাশিয়ার জন্য একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য। রুশ দূতাবাস ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা শিগগির চীন–ভারত–রাশিয়া ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের আয়োজন করতে চায়। এটি বাস্তবায়িত হলে বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
হঠাৎ করে নতুন মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম তখন ভারতের সাথে আমেরিকার মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। বিশেষ করে একাত্তরে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল নিক্সন প্রশাসন। তাঁকে উপযুক্ত প্রটোকল দেয়া হয় নি। তাঁকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। দেখা দিলেও সে কথোপকথন ছিল তির্যক আর উপহাসের।
আমেরিকার ধারণা ছিল ভারত কোনভাবেই যুদ্ধে যাবে না। আর গেলেও পাকিস্তানের সাথে এঁটে উঠতে পারবে না। ভারতও আমেরিকার সম্পর্কের কাঁটা ছিল পাকিস্তান। অন্যদিকে পাকিস্তানের তখন রমরমা। চীন তার ইয়ার আমেরিকা তাদের দোস্ত। পায় কে আর?
কিন্তু ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত বাংলাদেশের বিজয় অনেক হিসাব নিকাশ পাল্টে দেয়। কিসিঞ্জারের মতো যুদ্ধাপরাধী ইহুদি নিক্সন সরকারের কফিনে শেষ পেরেক মারলে তাদের ভরাডুবি হয়। এরপর অনেক পানি গড়িয়েছে। সে পানির স্রোতে ভারতেও পরিবর্তন হয়েছে।
কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। সহজে গদীতে আসতে পারবে বলেও মনে হয় না। গান্ধী বুদ্ধ অশোকের দেশে বিজেপি এসেছে ক্ষমতায়। সে কারণে বহুদেশের সাথে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে আবার কোন কোন দেশের সাথে হয়েছে গভীর। ভারতকে আমেরিকার দরকার পড়েছে বিশাল বাজারের জন্য। অর্থনীতিতে বিশাল হবার পর ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত আমেরিকামুখি হয়েছে সে দেশে। এর ওপর আছে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের উত্থান। একসময় মনে হয়েছিল ভারত আমেরিকা জোট হবে। মোদীও ট্রাম্প চলবেন সমান তালে। না সেটা হয় নি। আনপ্রেডিক্টেবল আমেরিকার কৌতুক প্রবণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পাগলা রাজা বলে অনেকে। এই পাগলা রাজা হঠাৎ টেরিফ বা শুল্ক নিয়ে এমন সব কান্ড করছেন যা রীতিমতো ভয়ংকর। ভয় হচ্ছে আমেরিকার না কাঠামো নড়ে ওঠে।
যে কথা বলছিলাম এইসব কারণে পুতিন শিন পিয়াংও মোদী হাত মিলিয়েছেন। ভোজবাজী র মতো ভারত চীন ঐক্য বা সখ্য গড়ে উঠছে৷ খবরে দেখলাম চীনা প্রেসিডেন্ট না কি মোদীকে গাড়িও উপহার দিয়েছেন। সে দিক বা না দিক সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো শাহবাজ শরিফের অবস্থান। বেচারা একা দাঁড়িয়ে হজম করেছেন এসব। একটা ভিডিওতে তাঁকে পুতিনের কাছে সম্পর্ক ভিক্ষা করতেও শোনা গেছে। পাকিস্তানের এই নাজুক অবস্থান আমাদের কি কিছু শিক্ষা দেবে?
উপমহাদেশে এমন কি পৃথিবীতে এই মেরুকরণ বহু পরিবর্তন এনে দেবে। বাংলাদেশ এখন কি ভাবে চলছে তা সবারই জানা। যে পজিটিভ পরিবর্তন করার জন্য যুবসমাজের অনেকে জান দিয়েছিল তাদের অনুসারীরা এখন হতাশ। অনেকে এমন গ্যাঁড়াকলে পড়েছে যে তাদের কোন ভবিষ্যৎ নাই। তাদের তো নাই ই উল্টো দেশও পড়েছে ঘোর সংকটে।
এই টালমাটাল অবস্থায় পাকিস্তান প্রীতির রমরমা। পিন্ডি ঢাকা ভাইভাই টাইপের এই বাস্তবতা উত্তেজনা হিসাবে চমৎকার হলেও দেশের জন্য মন্দ। এবার যেটা যোগ হলো সেটাও ভাবার মতো। এতিমের মতো অসহায় পাকিস্তান ঋণের বোঝায় কাহিল। আন্তর্জাতিক মহলে তার জায়গা শূন্যের কোঠায়। এমন দেশটির সাথে গলাগলি করে কী হবে আমাদের?
আমেরিকার কথায় আসি। ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া বা উত্তর কোরিয়া কেউই তার তোয়াক্কা করে না। সমপ্রতি দখলদার ইসরায়েল আমেরিকার মদদের পরও ইরানের চুল ছিঁড়তে পারে নি। দীর্ঘ সময় আমেরিকার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই স্থির আছে ইরান। ওরা জানিয়ে দিয়েছে বহিঃশত্রু ততক্ষণ অচল যতক্ষণ জনগণ ঠিক আছে। ইরান থেকেও শিক্ষা নিতে পারি আমরা।
আমেরিকা মুখে যাই বলুক বাস্তবে তার একছত্র আধিপত্য এখন মুখের কথা। তার চাইতে ঢের শক্তিশালী চীন ও রাশিয়া। ট্রাম্প মূলত রেগেছে ভারত রাশিয়া বাণিজ্যের কারণে। তাদের ধারণা এই টাকা না পেলে পুতিন না কি ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পারতো না।
এজন্যই বলা হয় আমেরিকা জনগণ ও গণতন্ত্রে চমৎকার দেশ হলেও তার শাসকেরা হয় জনবিরোধী নয়তো পাগলা রাজা। এককালের মোড়ল কখনো নিজের পরাজয় মানতে পারে না। দেশে দেশে যুদ্ধ লাগানো অস্ত্র ব্যবসার জন্য যুদ্ধ লম্বা করা আমেরিকার স্বভাব। কেন জানি মনে হচ্ছে এবার তার অবসান হতে চলেছে।
অন্যদের কথা থাক। বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছিল। তার গায়ে লেগেছিল উন্নয়নের হাওয়া। আশেপাশের দেশগুলো চোখ বড় বড় করে দেখতো তার অগ্রযাত্রা। শুনতে পাই এই দৌড় থামানোতে না কি আমেরিকার হাত ছিল। আমেরিকার এই স্বভাব পৃথিবীর বহু ক্ষতি করেছে।
ভারতের আধিপত্যবাদ ও অপ্রতিবেশী সুলভ আচরণ নিন্দনীয়। কিন্তু তার অগ্রগতি ও অগ্রযাত্রা মানতে হবে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরা সাথে চলতে না পারলে ক্ষতি হবে। তারা আমাদের কোলে তুলে নেবে এমনটি নয়। কিন্তু কাঁধে কাঁধ রাখার জন্য চাই পরিশ্রম চাই দেশপ্রেম।
এই দেশপ্রেম যে একটি জাতিকে কতটুকু এগিয়ে দেয় চীন রাশিয়াই তার প্রমাণ। ভারতও সে পথের যাত্রী। তাদের ঐক্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল করবেন এখন ইন্দোনেশিয়াও জ্বলছে। শুরু হয়ে গেছে ধ্বংস ও মারামারি। এই লেখা প্রকাশ কালে সে দেশে কি ঘটতে পারে অনুমান করা কঠিন। দুটো ধারাই এখন চলমান। একদিকে এগিয়ে যাওয়া অন্য দিকে ধ্বংসলীলা। কোন দিকে যাবো আমরা?
লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক।












