দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৮ এপ্রিল, ২০২২ at ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

বাজার দর, নানা সামাজিক ইস্যু যাত্রা কোন পথে?

বলে রাখি দুনিয়ার সব দেশেই এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সিডনিতেও হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বাজারে গেলেই বোঝা যায় কতোটা বেড়েছে দাম। সবজী তেল জ্বালানী সবকিছু এখন আগের চাইতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু তফাৎ একটাই যেটুকু বেড়েছে তা যুদ্ধ এবং এখানকার বৃষ্টি ও বন্যার জন্য। আমাদের দেশে বিষয়টা ভিন্ন ধরনের । যে কোন উৎসব এগিয়ে আসলেই হু হু করে দাম বাড়ে জিনিসের। এখন তা স্পষ্ট।
নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই রোজার উত্তাপ। ছোলা থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, গরু ও মুরগির মাংস, গুঁড়া দুধ বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। অসাধু সিন্ডিকেট গত দুমাসে ধাপে ধাপে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। আর এই দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। একদিকে করোনায় কর্মসংকোচন, অন্যদিকে পণ্যমূল্য বেশি-সব মিলিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে।
প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে। এ জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা আগে থেকে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উলটো। প্রতিবছরের মতো এবারও সক্রিয় অসাধু সিন্ডিকেট। রোজা সামনে রেখে তারা জানুয়ারি থেকেই রমজানে ব্যবহৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্ডিকেট কা ‘রা? এতো দীর্ঘ সময় দেশ শাসনে এককভাবে থাকার পরও সরকার কেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? আসলে শষের্র ভেতরেই আছে ভূত। আর সে ভুত গলা টিপে ধরে আছে রাজনীতির। রাজনীতির দম বন্ধ বলেই সিন্ডিকেটের নামে যা খুশি তা করা যাচ্ছে। ভালো করে ভাবলে সরকারী দল বুঝতে পারবে ক্রমেই তাদের বলা কথা আর প্রচারের সাথে বাস্তবতার অমিল বাড়ছে। দূরত্ব এতো বেশী হয়ে পড়ছে যে মানুষের বিশ্বাসই টাল মাটাল।
বিদেশে বসে আমরা ধরে নিয়েছি সরকারের কথার ৭০ ভাগ সত্য হলেও দেশ এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। প্রায়ই শুনি খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের বাজার তো সরকারের পূর্ন নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কেন তবে টিসিবি লাইন? কেন মানুষের হাহাকার? পপতিঘর আলোকিত হবার কথা যে দিন শুনলাম পরদিন খবরে দেখি লোড শেডিং এর জ্বালায় নাকাল মানুষ। গ্যাস নাই তেল নাই এমন হাহাকার দেখছি টিভিতে। এই আগুন নেভানো না গেলে সরকারের ভাবমূর্তি কি আসলেই শক্ত থাকবে?
বাজার দরের পাশাপাশি এমন সব ইস্যু উঠে আসছে যা রীতিমত ভয়ংকর। যে অসামপ্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল তা এখন স্মৃতি। বিশেষত মন ও মননের যে পরিবর্তন তা ঠেকাতে পারে নি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার গৌরবকারী আওয়ামী লীগ। বলবো ঠেকানোর চেষ্টা ও তারা আর করেন না। এটা মানতে হবে দুনিয়া ব্যাপী পরিবর্তনের মূল দায় ডিজিটাল জমানার। আগে মানুষ কম জানতো কিন্তু সঠিক বিষয় জানতো। ডিজিটাল যুগ আবোল তাবোল অনেক বিষয় জানায়। শুধু জানায় না মানুষের মগজ ও ধোলাই করে দেয়। আমাদের দেশের যারা সাধারণ মানুষ বা দরিদ্র তাদের কিন্তু এগুলো স্পর্শ করে না। তারা এসব বোঝেন ও না। অন্যদিকে ধনী আমীর বা বিত্তশালীরা এসবের বাইরে। তারা আজ ঢাকায় তো কাল আছেন লন্ডনে। তাদের এসব শোনার সময় নাই। ফেঁসে গেছে মধ্যবিত্ত আর নিম্মবিত্ত। আচার সংস্কার বিশ্বাবস সব গুলিয়ে ফেলেছে তারা। এই যে টিপ নিয়ে এতো কথা আর এতো বিতর্ক এ আসলে মনোভাবের বিকৃতি। আর এই বিকৃতি রোধে সামাজিক মিডিয়া ফুঁসে উঠলো বটে সাহিত্য সংস্কৃতি কি সেভাবে রূখে দাঁড়ালো? না বিশিষ্টজনদের দেখলাম তা করতে? এর কারণ ও কিন্তু অপরাজনীতি। যা আস্তে আস্তে সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে। সংস্কৃতির শক্তি নাই এখন এসব রুখে দাঁড়াতে পারে। অথচ আমরা সবাই জানি এদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলন ছিল আওয়ামী লীগের শক্তিতে বলীয়ান। দীর্ঘ সময় দেশশাসন আর শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের বিশ্বাস আর আস্থাকে পুঁজি করে বাকীরা এখন নিস্প্রভ বলা চলে। সে কারণেই হয়তো বাদ প্রতিবাদ সবকিছু চলে গেছে সামাজিক মিডিয়ার দখলে। ভয় হয় এভাবে কতোদিন চলা সম্ভব?
অনেকে মনে করেন আমাদের লেখা এবং বলার বিষয় হওয়া উচিত বাজার দর বা ইউক্রেন যুদ্ধ। বাজার দর মানলাম বটে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধে আমাদের কি বলার আছে বা বলার থাকতে পারে? মুখে আমরা যাই বলি না কেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের জায়গা এখনো পেছনে। বহু পথ পাড়ি দিতে হবে আমাদের। গত সপ্তাহে অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্লামেন্ট ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানের একমাত্র বাঙালি বক্তা ছিলাম আমি। হলঘরটার চারদিকে কেবল ব ই আর ব ই। শুধু কি সাজানো? আপনি দেখলেই বুঝবেন এগুলোর ব্যবহার নৈমিত্তিক। কারা পাঠ করেন? এখানকার রাজনীতিবিদ এম পিরা। আমাদের অনুষ্‌ঢান থেকেই কয়েকজন এম পি চলে গেলেন সংসদে প্রশ্নের জবাব দিতে। সে কাজ সেরে আবার ফিরে ও এলেন কেউ কেউ। এই যে কতর্ব্যনিষ্ঠা আর পড়াশোনা এই হচ্ছে আধুনিকতার শক্তি। রাজনীতির প্রগতি ও এখানেই। আমাদের দেশের সাংসদেরা একসময় প্রচুর পড়তেন। তাঁদের পড়তে হতো জানতে হতো। এখনো হয়তো কেউ কেউ পড়েন কিন্তু তার ব্যবহার দেখি না। বলছিলাম আমদের দেশ আর সমাজ যদি শুদ্ধ ও প্রগতিশীল না হয় আমাদের কথা বাইরের দেশগুলো শুনবে কেন মানবেই বা কেন? হয়তো জানেন টাকা বা মুদ্রামানে কুয়েতি দিনার পাউন্ড ডলারের অনেক ওপরে কিন্তু সে জন্য কি আন্তর্জাতিক রাজনীতি বৃটিশ আমেরিকাকে বাদ দিয়ে কুয়েতের কথায় চলে? টাকা পয়সা একটি দেশের মানুষের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সে অর্থ লুটেরা বা বাজে মানুষের হাতে পড়লে তার গুরুত্ব লোপ পায়। বাংলাদেশের জন্য এটা মনে রাখা জরুরি।
টিপ ইস্যু বিজ্ঞান টিচারের বিপদ সাধারণ মানুষের দ্রব্যমূল্য নিয়ে নাভিশ্বাস সবই আমাদের আলোচনার বিষয়। এখানে একতা যদি জান বাঁচানোর হয় বাকীগুলো ও কোন না কোনভাবে প্রাণ বা সম্মানের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনেতিক অগ্রগতি তখন ই প্রশ্নবিদ্ধ বা বিপদের মুখে পড়ে যখন তার সমাজে গণতন্ত্র অসামপ্রদায়িকতা বিজ্ঞান মনস্কতা বাধা প্রাপ্ত হয়। এসব কিছুই তাই আলোচনার বিষয় আর তাতেই পাওয়া যেতে পারে উত্তরণের পথ। আশা করি বাংলাদেশের সুধীজন বিবেকরা তা বুঝবেন এবং সেভাবেই এগুতে পারবে দেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধবিকেএফকেএস’র পাঁচলাইশ শাখার সভায় কমিটি গঠিত