গৌতম বুদ্ধের আশ্রমে গৌতম বুদ্ধের এক শিষ্য সব সময় মন খারাপ করে থাকতো। তার মন খারাপের কারণ ছিল সে কারোর বলা ছোটো বড়ো কথা সহ্য করতে পারত না। সে যখন গ্রামবাসী বা নগরবাসীর কাছে ভিক্ষা চাইতে যেত তখন এমন অনেক বাড়ি থাকতো যেখান থেকে তাকে ছোটো বড়ো কথা শোনানো হতো, তাকে অপমান করা হতো। কেউ তাকে বলতো এত হাট্টাকাট্টা যুবক হয়ে তোমার ভিক্ষা করতে লজ্জা করে না, ভালো কাজ করতে পারো তো কোনো। কেউ তাকে বলতো পরিবারকে ছেড়ে এরকম সন্ন্যাসী হতে তোমার লজ্জা করে না। এরকম বিভিন্ন ছোট বড় কথা তাকে কিছু কিছু মানুষের থেকে শুনতে হতো, সবার থেকে কিন্তু নয়, কিছু কিছু মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু যাদের থেকে এই অপমান গুলি শিষ্যটি পেতো, তাদের প্রতি তার একটা রাগ ক্ষোভ তৈরি হতো। সে চাইতো সবাইকে জবাব দিতে কিন্তু গৌতম বুদ্ধ সবসময় ক্ষমার কথা বলেন, তিনি সবসময় সহ্যের কথা বলেন এবং ভিক্ষা চাইতে গিয়ে যে যাই বলুক তাকে ঘুরিয়ে অপমান কেউ যেন না করে। গৌতম বুদ্ধ তার সব শিষ্যদের সেই কথা বলে দিয়েছিলেন সেই কারণে সে চেয়েও তাদের কিছু বলতে পারতোনা। কিন্তু বাইরে থেকে কিছু না বললে কি হবে তার মনের মধ্যে এই সব জিনিস গুলি নিয়ে সব সময় যুদ্ধ চলত, কখনো খুব রাগ হতো কখনো মনে হতো সে যেন সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ভুল করেছে। তো তার সহ্যের সীমা যখন একদম ছাড়িয়ে গেল, সে বুদ্ধের কাছে গিয়ে তার মনের মধ্যে চলা সব ব্যাপারটা খুলে বলল। বুদ্ধ সব শুনে তাকে বললেন আমাদের মনের মধ্যে চিন্তা করার অনেক শক্তি আছে। মনের মধ্যে চিন্তা যদি সঠিক হয় সেটা যেমন আমাদের সফলতা চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে যেতে পারে তেমনি চিন্তা যদি ভুল হয় সেটা আমাদের অনেক বড় ক্ষতিও করবে।
এরপর সেই শিষ্য আর গৌতম বুদ্ধ দুজনে একটি গ্রামে ভিক্ষা করতে গেল সেখানে বুদ্ধকে দেখে সবাই খুব আদর যত্ন করল। আর বুদ্ধের সাথে যেহেতু সেই শিষ্যটি ছিল তারও খুব আদর যত্ন করল। অপমান তো দূরের কথা সেদিন যা সম্মান পাওয়া গেল তা শিষ্য আগে কখনো পায়নি। সে মনে মনে ভাবল এটাই তো রাজার পুত্রের সঙ্গে থাকার সুবিধা। সবাই জানে যে গৌতম বুদ্ধ একজন রাজপুত্র, এনাকে অপমান করবে এমন সাহস কার আছে! অপমান তো আমাদের মত ছোটখাট মানুষদের হয়, আমাদেরকে কেউ কেউ তো মানুষ বলে ভাবেই না। বুদ্ধ সেই শিষ্যের মুখের হাসি আর আনন্দ দেখে মুচকি হাসলেন। তো সেই গ্রামে ভিক্ষা নেওয়ার পর সেখান থেকে একটু দূরে আরেকটি গ্রামে তারা ভিক্ষা করতে গেলেন। শিষ্য তো খুব আনন্দের সঙ্গে সেখানে গেল সে ভাবল এখানেও তাদের খুব সম্মান করা হবে । আগের গ্রামের মতোই তাদের আদর যত্ন করা হবে। কিন্তু, এই গ্রামে ঠিক উল্টোটা হলো এই গ্রামের কিছু মানুষ বুদ্ধকে দেখতে পারত না। তারা তাকে অপছন্দ করত। তাই এই গ্রামের কিছু মানুষ তাদেরকে রীতিমতো আজেবাজে কথা শোনালো। কেউ কেউ তো বুদ্ধকে এত অপমান করল যা ওই শিষ্যকে কেউ কোনদিন করেনি। শিষ্যটি দেখল যে ওই গ্রামের লোকেরা বুদ্ধকে অপমান করছে কিন্তু, বুদ্ধ একইরকম শান্ত রয়েছে। তিনি সেই মানুষদেরকে আশীর্বাদও করছে তাদের কল্যাণ চাইছে আর হাসিমুখে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এইসব দেখে সেই শিষ্য খুব অবাক হয়ে গেল। এরপর ভিক্ষা নেওয়া হয়ে গেলে গৌতম বুদ্ধ সেই শিষ্যকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। ফিরে আসার পর শিষ্যটি লক্ষ্য করলো বুদ্ধির মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই, তিনি অন্যদিন যেমন থাকে আজও তেমনি আছে। সে মনে মনে ভাবল বুদ্ধের কি এত অপমানের পরেও একটুও খারাপ লাগলো না, তিনি এত শান্ত রয়েছেন কি করে? এরপর ওই শিষ্য আর ধৈর্য ধরতে না পেরে বুদ্ধকে বলেই দিল – হে বুদ্ধ!! আমার মনে হয় আমাদের ওই গ্রাম কে বহিষ্কার করা উচিত। আমাদের কারোরই ওই গ্রামে আর ভিক্ষা করতে যাওয়া উচিত নয়। ওই গ্রামের সেইসব মানুষদের বহিষ্কার করা উচিত যারা আপনাকে আমাকে অপমান করেছে। আমার তো তখন থেকে রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই গিয়ে ওদের কিছু কথা শুনিয়ে আসি। আপনি কি করে এত শান্ত রয়েছেন? আপনার কি ওদের কথা একটুও খারাপ লাগেনি?
বুদ্ধ হেসে বললেন – আচ্ছা ধরো তুমি একটা কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়তে গেলে, তো পৃথিবী কি তার প্রতিবাদ করবে? শিষ্য বলল– না। বুদ্ধ বললেন আচ্ছা ঠিক আছে ধরো কোনো ব্যক্তি একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে নদীতে আগুন লাগাতে চাইছে সে কি নদীতে আগুন লাগাতে সক্ষম হবে? শিষ্যটি বলল– না। বুদ্ধ বললেন কেন? শিষ্য বলল– কারণ নদীতে জ্বলার গুণ নেই। বুদ্ধ বললেন কেউ মাটি খুঁড়তে আসলে পৃথিবী তার প্রতিবাদ করেনা কিন্তু তাই বলে পৃথিবী কিন্তু দুর্বল নয়। পৃথিবী চাইলে সবাইকে নিজের মধ্যে সমাহিত করে নিতে পারে। নদীতে কেউ জ্বলন্ত মশাল নিয়ে আগুন লাগাতে চাইলে নদী জ্বলে না। কিন্তু এর দ্বারা এটা প্রমাণ হয়না যে নদী শক্তিশালী নয়। নদী চাইলে কিন্তু এক নিমেষে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনই তোমাকে কেউ অপমান করলে বা ছোট করতে চেষ্টা করলে তুমি কিন্তু ছোট হয়ে যাচ্ছ না। তোমাকে ছোট অনুভব করাচ্ছে তোমার মনের মধ্যের চিন্তা আর রাগ। তুমি যদি নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে যাও তাহলে তুমি এই মানুষগুলোকে উপেক্ষা করতে শিখে যাবে। আর এরা তখন একবার দুবার তিনবার অপমান করার পর আর কোনো আনন্দ পাবে না।
রবীন্দ্রনাথকেও কম অপমানের শিকার হতে হয় নি। স্বয়ং দিজেন্দ্রলাল রায় লেগেছিলেন তার পেছনে। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নাটক লিখে তা মঞস্থ করিয়েছিলেন। তখনো নোবেল পান নি কবি। পাবেন কি পাবেন না এমন নাটকীয়তায় তাঁকে অপদস্থ করার নাটকটি মানুষ নেয় নি। উত্তেজিত জনগণ পায়ের জুটা ছুঁড়ে মেরে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলে ডি এল রায় নীরবের হল ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। এরপর খুব বেশীদিন বাঁচেন নি তিনি। অন্যদিকে ১৯১৩ সালে বাঙালির জীবনে প্রথম নোবেল এনে দেন রবীন্দ্রনাথ।
এই সব মান অপমানের গল্প আমার বানানো কিছু না। এগুলো সবাই জানেন। অথচ এর থেকে কোন পাঠ নেই না আমরা। রাজনীতি সমাজ অর্থনীতি সব কিছুতেই অপমান করা অপমান করে আনন্দ পাওয়া আমাদের স্বভাব। আমাদের নিজের মানুষ শাসক বা সাধারণ যেই হোক না কেন তার অপমানে এতো বিকৃত আনন্দ আগে দেখি নি।
দিনশেষে আমাদের দেশ মানুষ আর ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঙ্গলই বড় কথা। অনুগ্রহ করে নিজেদের ছোট দেশ ছোট সমাজের বড় কাউকে অপমান করবেন না। তাঁকে অন্য কেউ তাচ্ছিল্য করলে বা ছোট করলে সবাই মিলে জবাব দিতে পারাটাই শক্তি। তখন ই অন্যরা আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানাতে বাধ্য হবে।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কবি।