(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিদেশের মাটিতে সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর নিজেকে আবিস্কার করতে বরাবরই কিছুটা সময় লাগে আমার। ভিনদেশে অপরিচিত বিছানায় যে পুরোরাত ঘুমিয়েছি সেটা টের পেতে একটু এদিক ওদিক তাকাতে হয়, দুয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। এখানেও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি যে চীনের গুয়াংজুতে আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাইর ফ্ল্যাটে আরামে ঘুমিয়েছি সেটা টের পেতে কয়েক সেকেন্ড পার হয়ে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুটা লজ্জাও পেলাম। ঘুমে ঘুমে অনেক বেলা হয়ে গেছে। হোটেল হলে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু কারো বাসায় এতক্ষণ নাক ডেকে ঘুমানো! বিশ্রী ব্যাপার। অবশ্য ইউছুপ আলী ভাই আমার এমন বন্ধু যে- দু’জনের সম্পর্কে লাজলজ্জার লৌকিকতা বহু আগে আমরা পার করে দিয়েছি। তাই বেশ বেলা করে ঘুম থেকে জেগেও আমি আয়েশি ভাব নিয়ে রুমের দরোজা খুললাম। ইউছুপ আলী ভাই সাড়া পেয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘ঘুম হয়েছিল? সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। রেডি হয়ে আসুন। নাস্তা দিতে বলি।’ শাহীন ভাবীও এগিয়ে এলেন। আমার বেড টি’র অভ্যাস আছে কিনা জানতে চাইলেন। আমি হাসলাম। বেড টি নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ না থাকার কথা জানালাম। বললাম, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় হয়ে উঠছে, এমন গদ্যে বেড টি’র বিলাসিতা চলে না। তাছাড়া এত চড়া বেলায় বেড টি বড় বেমানান। নাস্তাই দিন। নাস্তার পরে বরং ঘনলিকারের এক কাপ দুধ চা খাওয়াইয়েন।
ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসতেই নাস্তার পসরা সাজাতে শুরু করলেন চীনা মহিলা। তিনি এই বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে বহুদিন ধরে কাজ করছেন। শাহীন ভাবী কিচির মিচির টাইপের শব্দমালায় কি কি সব নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। হা হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। একটি শব্দও বুঝতে পারছিলাম না।
ফ্ল্যাটের অন্যান্য বাসিন্দাদের খবর নিয়ে জানা গেল যে, তারা আমি ঘুমে থাকতেই অফিসে চলে গেছেন। তাদের নাস্তা পর্বও সাঙ্গ হয়েছে। অফিসে কাজের চাপ। তাই তারা চলে গেছেন। ইউছুপ আলী ভাই এতক্ষণে অফিসে চলে যেতেন। আমার ঘুম না ভাঙ্গায় তিনি আটকে গেছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নাস্তা সেরে আমরা বেরিয়ে যাবো বলেও জানালেন ইউছুপ ভাই। আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে বললাম, ‘দেরি করে ফেললাম! আগে ডেকে দিলেই পারতেন। ইউছুপ আলী ভাই বললেন, ‘আরে না, তেমন কোন তাড়া নেই। ধীরে সুস্থে গেলেই হবে। আমার তো এখানে কোন কাজ নেই। আমি থাকি হংকং-এ। এখানে অফিস তো ওরা চালায়। সুতরাং আমার এক ঘন্টা আগে পরে যাওয়ায় কিছু যাবে আসবে না।’
আমরা তিনজন নাস্তা করছিলাম। চীনা মহিলা গরম গরম সব খাবার এনে দিচ্ছিলেন। তুলতুলে নরোম পরোটার পাশাপাশি দারুণ টেস্টি পাউরুটি। মাংসের তরকারির সাথে ডিম পোজ। রকমারি ফল। পেঁপে কলা আমসহ নানা ফল! আম নাকি পুরো বছরই পাওয়া যায়! রসালো কমলাও রয়েছে টেবিলে।
নাস্তা পর্ব শেষে ইউছুপ আলীর ভাইর অফিসে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তিনি সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। অতপর আবারো শুরু হলো আমাদের বাঘ ভাল্লুক মারামারি। বললেন, বসেন, আরেক কাপ কফি খেয়ে তারপর যাবো। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ইউছুপ আলী ভাই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠায় আমি যেন বিব্রত না হই সেজন্য ইচ্ছে করেই ঘর ছাড়ছেন না। তিনি আমাকে বুঝাতে চাচ্ছেন যে তার অফিসে যাওয়া না যাওয়ায় এখানের সুবিধা অসুবিধার কিছুই নির্ভর করে না। কর্তার ইচ্ছেতে নাকি কীর্তন, এখানে ইউছুপ আলী ভাইর ইচ্ছেতেই আমার পথ চলা। আমার সহযাত্রী বন্ধু লায়ন ফজলে করিম ভাই পুরোদল নিয়ে গুয়াংজুর হেথায় হোথায় বেড়াচ্ছেন, আমি ইউছুপ আলী ভাইর ফ্ল্যাটে বসে আছি। তবে এতে আমার কিংবা ইউছুপ আলী ভাইর মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ আমি জানি যে, দিনশেষে ঠিকই ইউছুপ আলী ভাই আমাকে মন প্রাণ ভরে সবকিছু দেখার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমার খুব মনে পড়লো হংকং ট্যুর এর কথা। বছর দুয়েক আগে হংকং বেড়ানোর সময় হঠাৎ ইউছুপ আলী ভাই খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। উনি ঘর থেকে বের হতে পারছিলেন না, অনেকটা বিছানায় পড়ে ছিলেন। কিন্তু আমি গিয়ে হাজির হয়েছিলাম হংকং এর বাসায়। তিনি আমাকে নিয়ে বেরুতে না পারলেও আমার বেড়ানোর যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেজন্য ড্রাইভার আলাউদ্দিনকে গাড়িসহ আমার সাথে ট্যাগ করে দিয়েছিলেন। হংকং এর দিনগুলোতে কখনো ড্রাইভার আলাউদ্দিন আবার কখনো শাহীন ভাবী আমাকে নিয়ে হেথায় হোথায় ঘুরেছেন। হংকং এর আনাচে কানাচে আমি ঘুরেছিলাম। পাহাড়ের চূড়া থেকে সাগরের বুক পর্যন্ত কোন কিছুই বাদ যায়নি!
যাক, গুয়াংজুতে ইউছুপ আলী ভাই আমার সাথে রয়েছেন। সুতরাং এখানকার সবকিছুও রয়ে সয়ে আমার দেখা হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কাপ কফি শেষ করে ফুরফুরে মেজাজে ঘর ছাড়লাম। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম ইউছুপ আলী ভাইর গুয়াংজুর অফিসে। দারুণ অফিস। বেশ বড়। গুয়াংজুর মতো জায়গায় এত বড় অফিস দেখে আমার মনটি ভরে গেল। ইউছুপ ভাই এখানে থাকেন না, হংকং থেকে মাঝেমধ্যে আসেন। অথচ গুয়াংজু অফিসেও ইউছুপ আলী ভাইর জন্য চমৎকার একটি চেম্বার রয়েছে। আবারো কফির অর্ডার দিলেন ইউছুপ ভাই। অফিসেই কফি মেকার রয়েছে। দারুণ স্বাদের কফি বানিয়ে পরিবেশন করা হলো। ব্যবসার কিছু খোঁজখবর নিতে নিতে আমরা কফি শেষ করলাম। ব্যবসা মানে বাংলাদেশে গার্মেন্টসের কাঁচামাল রপ্তানি। দেশের বড় বড় বিভিন্ন গ্রুপের সাথে ইউছুপ আলী ভাই’র ব্যবসা রয়েছে। বহুদিনের ব্যবসা। বাংলাদেশে গার্মেন্টসের প্রসারের সাথে সাথে ইউছুপ ভাইর ব্যবসারও বিস্তৃতি ঘটেছে।
ঘন্টা খানেক অফিসে বসার পর ইউছুপ আলী ভাই বললেন, চলেন, আপনাকে গুয়াংজু ঘুরিয়ে আনি। অবশ্য এখানে আমি খুব বেশি কিছু আপনাকে দেখাতে পারবো না। জাহেদ ভাই কিংবা কায়সার পরে আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবে। এখন আপাতত শহর দেখি। আমরা বের হলাম। সার্বক্ষণিকভাবে গাড়ি তো রয়েছে। সুতরাং কোথাও যেতে আসতে কোন সমস্যা হচ্ছিল না। গুয়াংজুর রাজপথ ধরে চক্কর দিচ্ছিলাম আমরা। কখনো ফ্লাইওভারে, কখনোবা রাস্তায়, কখনোবা পার্ল নদীর বুকে বিশাল লম্বা সেতু ধরে ছুটছিলাম আমরা। অনেকক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরির পর আমরা একটি শপিং মলে ঢুকলাম। কী যে সুন্দর! কত বিশাল শপিং মল!
শুরুতে গুয়াংজুকে আমি ছোট ধরনের শহর মনে করলেও ঘুরতে গিয়ে টের পেলাম যে, চীনে ছোট কিছুই নেই। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের এই দেশটিতে সবকিছুই বড় বড়। প্রায় আড়াই কোটি মানুষের শহর গুয়াংজুও অনেক বড়। এই শহরের রেস্টুরেন্ট কিংবা শপিং মলও বিশাল বিশাল।
গুয়াংজু চীনের বিখ্যাত পার্ল নদীর তীরে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর, মেগাসিটি। এটি চীনের সবচেয়ে জনবহুল বন্দরনগরী। হংকং থেকে এই শহরের দূরত্ব মাত্র ১২০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে। ম্যাকাও থেকে এই শহরের দূরুত্ব ১৪৫ কিমি, উত্তরে। ক্যান্টন নামেও ব্যাপক পরিচয় রয়েছে গুয়াংজুর। সমৃদ্ধ একটি সমুদ্রবন্দরসহ গুয়াংজু যেন সম্পদে ভরপুর। বহু বহু বছর আগ থেকে গুয়াংজু চীনের অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি জনপদ। খীষ্ট্রের জন্মেরও বহু আগে এই শহরের গোড়াপত্তনের তথ্য উপাত্ত ঐতিহাসিকেরা আবিস্কার করেছেন। চীনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের যে যোগাযোগ তাও এই গুয়াংজু হয়ে সম্পন্ন হতো। শুধু সড়ক বা মহাসড়কই নয়, সমুদ্রবন্দর হিসেবেও গুয়াংজুর আধিপত্য বহু বহু যুগ আগের এবং একসময় তা ছিল একচেটিয়া। প্রায় তিন হাজার বছরের সমৃদ্ধ জনপদ গুয়াংজুর শপিং মল যে সেই সমৃদ্ধিরই ম্যাসেজ দিচ্ছিল।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।