(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শেষ হয়েও যেনো হলো না শেষ! বলছিলাম আমাদের আড্ডার কথা। গল্পে এবং আড্ডার মাঝে জমকালো আয়োজনে লাঞ্চ সেরে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম আমরা। কিন্তু গল্প শেষ না হওয়ায় আবারো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে শুরু হলো আমাদের কথা বলা। রাস্তার পাশে চমৎকার ফুটপাত, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করার দারুণ জায়গা। রাস্তার পাশে গাছ-গাছালীও আছে। নানাজাতের বড় বড় গাছ। রাস্তা এবং ফুটপাতকে ছায়া সুশীতল করে রেখেছে গাছগুলো। গুয়াংজু চীনের ব্যস্ততম শহরগুলোর একটি। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ। রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করলেও কারো পথ চলায় তেমন কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। আমরা আমাদের মতো করে গল্প করছিলাম, নানা বিষয়ে খোঁজখবর করছিলাম। ফুটপাতের হেথায় হোথায় অনেকেই বসে আছেন, অনেকেই গল্প করছেন। ভর দুপুরে এভাবে অলস বসে থাকার লোকও চীনে রয়েছে! আমার কিছুটা খটকা লাগলো। কিন্তু ইউছুপ আলী ভাই বললেন যে, এদের মধ্যে অনেক বাঙালীও রয়েছেন। রয়েছেন ভারত নেপালসহ নানা দেশের মানুষ। চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষজনও রয়েছেন। তারা বিভিন্ন অফিসে চাকরি করেন, ব্যবসা করেন, অলস সময় পার করার পাশাপাশি কাজের সন্ধানে এসেও এখানে অপেক্ষা করেন, বসে থাকেন। আপনি এখান থেকে নানা কাজের মানুষ যোগাড় করে নিতে পারবেন। যাক, আমরা আড্ডা শেষ করলাম। আমার সহযাত্রীরা লায়ন ফজলে করিমের নেতৃত্বে চলে গেলেন, আমি আমার বন্ধু ইউছুপ আলীর সাথে থেকে গেলাম। এখন থেকে আমি ইউছুপ আলী ভাইর বাসায় অবস্থান করে গুয়াংজু বা চীনের অন্যান্য অঞ্চলে ঘুরবো। সহযাত্রীরা দুয়েকদিন গুয়াংজুতে ঘুরে দেশে ফিরবেন। ইচ্ছে করলে আমি তাদের সাথেও সামিল হতে পারবো।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে একই সাথে পথ চলেছি আমরা। কত গল্প, কত কথা, কত হৈ চৈ, হাসি-ঠাট্টা এবং খাওয়া দাওয়া চলেছে ছোটখাটো দলটিতে! ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠা সেই বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে কিছুটা খারাপ লাগছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের বন্ধু ইউছুপ আলীর আহ্বানও টানছিল বুকের গভীরে। ভিতরে কিছুটা দো’টানা টের পেলেও বন্ধুর বাসায় না থেকে বাইরে থাকার কোন সুযোগই ছিল না। অতএব লায়ন ফজলে করিম ভাইদের বিদায় দিয়ে আমি নতুন পথ ধরলাম। ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ইউছুপ আলী ভাইয়ের অফিসের কর্ণধার জাহেদুল ইসলাম। জাহেদুল ইসলাম সম্পর্কে ইউছুপ আলী ভাইয়ের ভায়রা। ইউছুপ ভাইর হংকং এবং গুয়াংজু অফিসের সব কর্মকর্তা কর্মচারীই চট্টগ্রামের, সবাই আত্মীয়-স্বজন। শুধুমাত্র আইনী কিছু ব্যাপার এবং ভাষাগত সুবিধার জন্য হংকং অফিসে দুইজন এবং গুয়াংজুতে একজন স্থানীয় নাগরিককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
চীন ফোনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যন্ত রক্ষণশীল। ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ভাইবার, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার ইনস্টগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দারুণ কৃপণ। নিজেদের ‘উইচ্যাট’ নামের একটি চার্জইঞ্জিন দিয়েই কাজ সারতে হয়। অবশ্য ভিপিএন নামের একটি এ্যাপস চালু করলে চীনের নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসআপসহ সব ধরনের এ্যাপস অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। ভিপিএন চালু করতে কিছু টাকা পয়সা খরচ করতে হয়। যেতে হয় নির্দিষ্ট দোকানে। ইউছুপ আলী ভাই আমার ফোনটি নিয়ে ভিপিএন চালুর ব্যবস্থা করলেন। দোকানের ছেলেটি কী করে ভিপিএন ব্যবহার করতে হয় তাও আমাকে শিখিয়ে দিলেন। আর নিমিষেই আমার ফোনে এতদিন বন্ধ থাকা ফেসবুক, হোয়াটসআপের ম্যাসেজগুলো একের পর এক আসতে লাগলো। দুনিয়াটা যেন খুলে গেল চোখের সামনে!
ভরপেট লাঞ্চের পর ঘুম ঘুম লাগছিল। কফির ক্যাফেইনেও ঘুমের ভাব কাটছিল না। ইউছুপ আলী ভাই এবং জাহেদ ভাইর সাথে নানা বিষয়ে গল্প করলেও ক্ষণে ক্ষণে হাই উঠছিল। ইউছুপ ভাই বললেন, চলেন বাসায় যাই, রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় বের হলে হবে। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি মনে হয় একেই বলে। আমার একটু ঘুমানো দরকার। বাসা ছাড়া যা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
ইউছুপ আলী ভাইর বাসা গুয়াংজু শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি আবাসিক এলাকায়। নিকটেই বেশ বড়সড় একটি শপিং মলও দেখা গেল। অত্যন্ত ব্যস্ততম এবং ব্যয়বহুল গুয়াংজুতে এত দারুণ লোকেশনে ইউছুপ ভাইর চমৎকার ফ্ল্যাটটি দেখে মুগ্ধ হলাম। ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে কাজের লোক দরোজা খুলে দিলেন, মাঝবয়সী একজন চীনা মহিলা। দৌড়ে আসলেন শাহীন ভাবী। ইউছুপ আলী ভাই শাহীন ভাবীকে নিয়েই হংকং থেকে গুয়াংজু এসেছেন। ভাবীকে বাসায় রেখে আমাকে আনতে গিয়েছিলেন। ভাবী আমাকে স্বাগত জানালেন। হংকং এর পর এবার গুয়াংজুতেও দেখা হয়ে যাওয়ায় বেশ খুশী হয়েছেন বলেও জানালেন। অবশ্য ভাবীর সাথে চট্টগ্রামেও দেখা হয়, কিছুদিন পরপরই দেখা হয়। শাহীন ভাবী আমাদের জন্য চা আনতে ভিতরে চলে গেলেন। এই সময় চা! দারুণ একটি ব্যাপার হবে বলেও মনে হলো আমার।
ইউছুপ ভাই আমাকে একটি রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ফ্রেশ হয়ে নেন। চা খেয়ে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিন। সন্ধ্যায় বের হবো।
আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফ্ল্যাটটি খেয়াল করলাম। বেশ বসসড় ফ্ল্যাট, চার রুমের। গুয়াংজুর মতো ব্যস্ত জায়গায় এতো বড় ফ্ল্যাট চাট্টিখানি কথা নয়। ইউছুপ আলী ভাই গুয়াংজু আসলে এই ফ্ল্যাটেই উঠেন। একটি রুম উনার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা। বাকি রুমগুলোর একটিতে জাহেদ ভাই থাকেন। থাকেন কায়সার ভাই এবং জোবায়েদ ভাইও। ইউছুপ আলী ভাইয়ের অফিসের জন্য সব লোকই চট্টগ্রাম থেকে নেয়া, আত্মীয় স্বজন। তারাই মিলেমিশে ফ্ল্যাটটিতে বসবাস করেন। সবার রান্না হয় একই পাতিলে, খাওয়া দাওয়াও একই সাথে। বেশ পরিবার পরিবার একটি ভাব রয়েছে অফিসের সকলের মাঝে, দারুণ সখ্যতাও। মালিক কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারীর ব্যবধানটি দেখলাম না, শাহীন ভাবীও সবার সাথে এত মিশেন যে কারো কাছেই তিনি মালিকের বউ নন, সবার প্রিয় ভাবী। অবশ্য জাহেদ ভাই’র স্ত্রীর বড় বোন!!
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে করতে পারছিলাম না। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন মনে হলো সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তড়িঘড়ি উঠে বসলাম। হাত মুখ ধুয়ে ড্রয়িং রুমে আসতে দেখি ইউছুপ আলী ভাই টিভি দেখছেন, পাশে শাহীন ভাবী। আমাকে দেখে বললেন, বসেন, চা দিচ্ছি। ফলমুলসহ নানা ধরণের নাস্তার আয়োজন, সাথে ধুমায়িত চা। এত মিষ্টি পেঁপে জীবনে কখনো খেয়েছি বলে মনে করতে পারছিলাম না। চমৎকার স্বাদ এবং ঘ্রাণ। এগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বলেও জানালেন ইউছুপ আলী ভাই।
ঘুম থেকে জেগে ঘন লিকারের দুধের চা বেশ কাজ দিল। আমার শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলো। মনতো আগে থেকেই চাঙ্গা হয়ে রয়েছে। শাহীন ভাবী রাতে কি খেতে চাই জানতে চাইলেন। কোন পছন্দ বা বাছবিচার নেই বলে জানিয়ে দিলাম। ইউছুপ ভাই বললেন, চলেন, আপনাকে একজন সাহাবীর মাজারে নিয়ে যাই। মাগরিবের নামাজ ওখানে পড়বো। সাহাবীর মাজার! গুয়াংজুতে! কিছুটা চমকিত হলাম। ইউছুপ আলী ভাই বললেন, জ্বী, বেশ বিখ্যাত একজন সাহাবীর মাজার রয়েছে এখানে। দুনিয়ায় থাকতে যেই দশজন ভাগ্যবান সাহাবী জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন ইনি তাদেরই একজন। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর রওজা মোবারক গুয়াংজুতে রয়েছে। তৈরি হোন, মাগরিব পড়ে জেয়ারত করে আসবো।
গুয়াংজু সফরের শুরুটা এত চমৎকার হবে ভাবতেই পারিনি। এত বিখ্যাত এবং ভাগ্যবান একজন সাহাবীর মাজার এখানে রয়েছে তাও আমার অজানা ছিল। বিষয়টি জানার পর নিজেকে ভাগ্যবান মনে হতে লাগলো এবং বেশ দ্রুতই আমি তৈরি হয়ে নিলাম।
আমার হাতের মোবাইলে এখন পুরো দুনিয়া। তাই গাড়িতে বসে আমি নেট দুনিয়ায় ঘাটাঘাটি করে হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর ব্যাপারে কিছু তথ্য উপাত্ত জেনে নিচ্ছিলাম।
যতই জানছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার গায়ের সব লোমই খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এমন বিখ্যাত একজন সাহাবীর মাজার এখানে! সৌদি আরব থেকে এতদূরের চীনে শুধু ইসলামের দাওয়াত দিতেই এসেছিলেন তিনি!
হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ছিলেন ইসলামের একেবারে সূচনাকালের সাহাবী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী ১৭তম ব্যক্তি। হযরত আবি ওয়াক্কাসের (রা.) আসল নাম আবু ইসহাক সাদ। তাঁর বাবার নাম আবি ওয়াক্কাস মালিক। আর মায়ের নাম আমিনা। সাদ (রা.) হযরত আবু বকর (রা.) এর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মূলত তাঁর অনুপ্রেরণায় সাদ (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকী (রা.) এর অনুপ্রেরণায় ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি মহানবী (সা.)এর মায়ের দিকের আত্মীয়ও ছিলেন। সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার মামা। ব্যক্তিগত জীবনে হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) অসীম সাহসী একজন সমরনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন মহানবী (সা.) প্রচন্ড অনুরক্ত, বিশ্বস্ত এবং ত্যাগী।
ইসলামের শুরুর দিককার প্রায় সব যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে দশজন জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন হযরত সাদ (রা.) তাঁদের একজন।
সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) পুরো জীবনটাই উৎসর্গ করেন ইসলামের জন্য। ৬৩৬ সালে পারস্য বিজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ওই বিজয়ের পর তাঁর পরিচিতি এবং খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কূটনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে তিনি দু’দফায় চীন সফর করেন। প্রথম তিনি চীনে আসেন ৬১৬ সালে। চীনে ইসলামের পরিচয়, প্রচার এবং প্রসার এই মহান সাহাবীর হাত ধরেই ঘটে। পরবর্তীতে ৬৫১ সালে চীন সম্রাট তুং এর আমন্ত্রণে তিনি দ্বিতীয় দফায় চীন সফর করেন। সম্রাটের আগ্রহে তিনি ক্যান্টনে বর্তমান গুয়াংজু শহরে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
ধারণা করা হয় যে, নৌ পথে চীনে যাওয়ার সময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে থেমেছিলেন এবং এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদান রয়েছে। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর জন্ম আনুমানিক ৫৯৫ সালে মক্কায় এবং মৃত্যুবরণ করেন আনুমানিক ৬৭৪ সালে চীনের গুয়াংজুতে। গুয়াংজুতে এই মহান সাহাবীর মাজার রয়েছে। একটু পরেই ওই মাজার জেয়ারত করতে যাচ্ছি আমি। বিষয়টি আমাকে বেশ চঞ্চল করে তোলে, কিছুটা আলোড়িতও। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।