(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘুরতে ঘুরতে পা ব্যথা করছিল। সকাল থেকেই ছুটছি। শুধু মনের জোরেই হাঁটছিলাম এবং নতুন নতুন জিনিস দেখছিলাম। খুঁজছিলাম ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। আমার ঘরনির অবস্থা আরো খারাপ। বেচারী এমনতিই দুর্বল। তার উপর দিনভর ছোটাছুটিতে অবস্থা শোচনীয়। এখানের পরিস্থিতি এমন যে, হাঁটার কোন বিকল্প নেইম ইচ্ছে করলেও টুক করে রিকশায় উঠে যাওয়া কিংবা গাড়ি নেয়া সম্ভব নয়। আবার না দেখে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটি আরো কঠিন। এতদূর এসে সবকিছু না দেখে ফিরে যাবো? অসম্ভব। অতএব হাঁটছিলাম, ঘুরছিলাম আর সমানতালে কাহিল হচ্ছিলাম। আমাদের গাইড তাড়া দিচ্ছিলেন। সবকিছু দেখতে আরো অনেক সময় দরকার। এত আস্তে আস্তে হাঁটলে তো বহু কিছুই দেখা যাবে না। সন্ধ্যার আগে ফিরতি পথ ধরারও একটি তাড়া রয়েছে আমাদের। আমার মনে হলো, এত কম সময় নিয়ে সম্রাট আকবরের স্মৃতিধন্য ফতেহপুর সিক্রি আবিষ্কার সম্ভব নয়। আমরা শুধু দেখছিলাম, মন ভরে হৃদয় জুড়ে দেখতে হলে অনেক বেশি সময় দেয়া দরকার ছিল। শুধু ফতেহপুর সিক্রির জন্য একটি আস্ত দিন রাখতে পারলে দারুণ হতো বলেও মনে হলো আমার। ভবিষ্যতে কখনো যদি সুযোগ জুটে যায় তাহলে গোটা দিন এই সিক্রিতেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম।
ফতেহপুর সিক্রির সবকিছুই আলীশান। এত আলীশান যে কয়েকশ’ বছর পর এসেও চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে। এই প্রাসাদ এবং দুর্গ নির্মাণে ওই সময়ে খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ রুপির সমমানের মুদ্রা। এক কোটি চল্লিশ লাখ রুপি! মনে মনে হিসেব কষার চেষ্টা করলাম যে, ওই সময় এত টাকা দিয়ে কি কি করা যেতো! গাইড বললেন, ভারত বর্ষের বেশ বড় একটি অংশ কিনে নেয়া যেতো। ওই টাকায় ফতেহপুর সিক্রিতে ২ হাজার ৯০০টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতে নাকি সম্রাট সম্রাজ্ঞীসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়ে বসবাস ছাড়াও ৬০ হাজার সৈন্যের বিশাল এক বহর বসবাস করতেন। দিল্লির লালকেল্লার চেয়েও অনেক বড় ফতেহপুর সিক্রি!! জৌলুশও নাকি অনেক বেশি ছিল। জৌলুশ যে ছিল তাতো এখনো টের পাচ্ছি! কি রাজকীয় সব আয়োজন! কত কত্ত ভবন। এক একটি রাণীর জন্য এক একটি মহল!!
প্রায় দেড়শ’ ফুট উঁচু একটি পাহাড়ী অঞ্চলে ছয় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা ফতেহপুর সিক্রি পুরো ঘুরে দেখা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। সেই আশা ছেড়ে দিয়ে আমরা কেবল মূল ভবনের দরোজা, ভবন, মসজিদ, রাণীর বসতঘর, সম্রাটের থাকার ঘর, রাণীর হাওয়া খানা, নবপন্ডিতের বৈঠক খানা, তানসেনের সেতার বাজানোর জায়গা, পানিতে বিশেষ কায়দায় সাউন্ড সিস্টেম, দ্বীন ই ইলাহির ইবাদত খানা প্রভৃতি দেখছিলাম। গাইড জানালেন, ফতেহপুর সিক্রির অন্যতম দর্শনীয় জিনিস হচ্ছে এটির প্রধান গেটের দরজা। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় দরজা। দরজাটি সম্রাট আকবর দক্ষিণাত্য থেকে নির্মাণ করিয়ে এনেছিলেন। গুজরাট বিজয়ের প্রতিক হিসেবে এই দরজাটি নাকি আনানো হয়েছিল। এই দরজা দিয়ে অনায়াসে হাতি প্রবেশ করতে পারতো। এটি এক একবার খুলতে এবং বন্ধ করতে ২৫/৩০ জন সৈনিক লাগতো। এত বড় দরজা কখন খোলা হতো, কখনই বা বন্ধ করা হতো কে জানে!
আমাদের গাইড বললেন, সম্রাট আকবরের পুরো নাম জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট। ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে উনার খ্যাতি রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসের মহান শাসকদের অন্যতম সম্রাট আকবর ‘মহামতি আকবর’ নামেও পরিচিত। আমি তাড়াতাড়ি বললাম যে, আকবর নামের মানুষেরা ভালো মানুষ হয়। গাইড কিছু না বুঝে মাথা নাড়লেন। আমার ঘরনি টিপ্পনি কেটে আমার কথার সারমর্ম গাইডকে বুঝিয়ে দিলেন। গাইড আমার কথায় সায় দিলেন। তিনি বললেন, সম্রাট আকবর পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেণ। মাত্র তের বছর বয়সে সম্রাট! আমি ওই বয়সে কি করতাম চিন্তা করলাম। সম্রাট আকবর বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে ভারত পাকিস্তান আফগানিস্তানসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকেন। ১৫৬০ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁকে সরিয়ে দেন। এরপর থেকে তিনি নিজেই সকল সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করতে থাকেন। একের পর এক যুদ্ধ জয় করে ১৭ বছরের এক যুবক ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে সাম্রাজ্য বিস্তার করে দোর্দন্ড প্রতাপের সাথে শাসন করতে থাকেন।
সম্রাট আকবরের বিখ্যাত নবরত্ন ছিল। এই নবরত্নের নানা বুদ্ধিও তিনি গ্রহন করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ তানসেন। পৃথিবীর সেরা এই সেতারবাদক সম্রাটকে সেতার শুনাতেন। পানির একটি জলাধার তৈরি করে সেখানে বিশেষ কায়দায় তানসেনসহ অন্যান্যদের বসার ব্যবস্থা এবং পানিতে সুরের যাদু সৃষ্টি করার দারুণ এক ম্যাকানিজম তৈরি করা হয়েছিল। সম্রাজ্ঞীসহ অন্দরমহলের নারীরাও যাতে সেতার শুনতে পান তার ব্যবস্থাও ছিল। গাইড আমাদেরকে একে একে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখাচ্ছিলেন। জলাধারে ওস্তাদ তানসেন ছাড়াও রাজা টোডরমল, বীরবল, আবুল ফজল, কবি ফৈজি, আব্দুল রহিম খান, ফকির আজিওদ্দিন, সেনাপতি মানসিংহ, মোল্লা দো-পিঁয়াজা নবরত্ন হিসেবে বিবেচিত হতেন।
সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিসেবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করার এক পর্যায়ে দীন-ই-ইলাহি নামের একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেন। একই সাথে হিন্দু খ্রিষ্টান এবং মুসলিম স্ত্রী নিয়ে সংসার করতেন তিনি। সব স্ত্রীকে স্ব স্ব ধর্মপালনে দিতেন অগাধ স্বাধীনতা। ফতেপুর সিক্রির উত্তর দিকের দেওয়ান-ই-খাস মহলে সম্রাট আকবরের ইবাদতখানা। ওখানে তিনি বিভিন্ন ধর্মের বৌদ্ধাদের নিয়ে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। যেখান থেকে ১৫৮২ সালে তিনি দ্বীন ই ইলাহি প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু মুসলিম মিলে কিছু লোকজন সম্রাট আকবরের ধর্মমতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করলেও বিশিষ্ট ধর্মীয় বৌদ্ধারা তাঁর এই মত মানেন নি। এই নয়া মত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্রাট আকবর বিতর্কিত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে দ্বীন ই ইলাহির প্রসার এবং প্রচার দুইটিই মুখ থুবড়ে পড়ে। এই মত বিলীন হয়ে যায়।১৬০৫ সালে তার মৃত্যু হয়। সম্রাট আকবরের সমাধিও আমরা দেখলাম। অতি জৌলুশহীনভাবে পড়ে আছে শ্বেত পাথরের সমাধি। একটি কক্ষের মাঝখানে শ্বেতপাথরের কবর। কক্ষটির চারদিকের দেয়ালে নানা কারুকাজ। তবে দীর্ঘদিনের অনাদর এবং অবহেলার চাপ স্পষ্ট।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা গিয়ে হাজির হলাম হযরত সেলিম চিশতি (রঃ)র মাজারে। সম্রাট আকবর একটি সন্তানের আশায় যেই আওলিয়ার দরবারে ছুটে এসেছিলেন, যেখান থেকে শুরু হয় ফতেহপুর সিক্রির জৌলুশ আমরা সেই অলির দরবারে এসে দাঁড়ালাম। ফতেহপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদের এক পাশেই এই মাজার। ছাদসহ সবকিছু শ্বেত পাথরের তৈরি মনোরম মাজার জুড়ে পবিত্র এক আবহ। অন্যরকমের একটি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল চারদিকে। একপাশে কাইয়ালি গানের আসর বসেছে। টুংটাং বাজনায় স্মরণ করা হচ্ছে শেখ সেলিম চিশতীকে। বর্ণনা করা হচ্ছে মহান এই আওলিয়ার মহত্ব। চত্বরটির একপাশে একটি জলাধার। শান বাঁধানো। পাহাড়ের উপর এমন সুন্দর আয়োজন! চারদিকে সুনসান অবস্থা। প্রখ্যাত একজন অলির দরবারের পবিত্র আবহের মাঝে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম আমরা। সন্ধ্যার আগ দিয়ে যখন আমরা ফতেহপুর সিক্রি ছাড়ছিলাম, তখন আকাশজুড়ে ছিল অন্যরকমের এক রক্তিম আভা! (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।