(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমাদের গাড়ি ছুটছে। দিল্লী থেকে আগ্রার দিকে যাচ্ছি আমরা। আমরা মানে আমি এবং আমার স্ত্রী। পুরো টিমটি দিল্লীতে রয়ে গেছে। শুধু আমরা দুজন যাচ্ছি প্রেমের স্বর্গোদ্যান ‘তাজমহল’ দেখতে। দেখতে মুঘল সাম্রাজ্যের আরো নানা কিছু। আগেও তাজমহল দেখেছি। প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত হাতে নিয়ে ঘুরেছি তাজমহলের ভিতরে বাইরে। ঘুরেছি এখানে -ওখানে। দেখেছি আগ্রা ফোর্ডসহ ধারেকাছের আরো নানা কিছু। এবারও যাচ্ছি। অনন্য এই স্থাপনাগুলো যতই দেখিনা কেন ততই দেখতে ইচ্ছে করে। মন ভরে দেখা হয় না। মন উসখুস করতে থাকে।
তাজমহল দেখার সিদ্ধান্তটি একেবারে হুট করেই। আগে থেকে কোন পরিকল্পনাতে ছিল না। দিল্লী শহরে ঘোরাঘুরি করেই আমাদের ফিরে যাওয়ার কথা। ট্যুর প্ল্যানও ওভাবে করা হয়েছিল। দিল্লীতে নানা কিছু দেখে দেখে আমরা সময় পার করছিলাম। কিন্তু কত আর দিল্লীতে ঘোরা যায়, কত আর ঘুরবো! আমাদের প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে সার্বক্ষণিক গাড়ি রয়েছে, রয়েছে ড্রাইভারও। তাই ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরির অবাধ এক সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই গাড়ি এবং ড্রাইভারকে শহরের বাইরে নিয়ে গেলে বাড়তি কিছু খরচ গুনতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের ট্যুর অপারেটর লায়ন আনোয়ারুল আজিম বললেন, ওসব পরে দেখা যাবে। এখন যেখানে যেভাবে ইচ্ছে বেড়িয়ে নিন। গাড়ি ড্রাইভার সবই আপনার। আপনার মতো করে ঘুরে ফিরে দেখুন।
আমাদের গ্রুপে দলপতি হিসেবে রয়েছেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক, আমার প্রিয় এডিটর স্যার এম এ মালেক, ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক। উনাদের রেখে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়াটা বেমানান। তবুও দিল্লীতে স্যার ম্যাডামকে হোটেলে রেখে হেথায় হোথায় অনেক ঘুরেছি, ঘুরছি। সারাদিন যেখানেই থাকি না কেন সন্ধ্যায় ফিরে আসি হোটেলে। ডিনারে সবাই একই টেবিলে যোগ দিই। আর প্রতিরাতেই হোটেল লবিতে জম্পেস আড্ডা চলে। ডিনারের পর থেকে বেশ রাতঅব্দি চলতে থাকে বাঘ ভাল্লুক হাতি ঘোড়া মারামারি। দীর্ঘদিন ধরে স্যারের সাথে ঘুরতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি যে, দেশে বিদেশে প্রতিটিই ট্যুরেই এমনতর আড্ডা চলে। এই আড্ডাটাই দিনে দিনে অন্যরকমের এক আকর্ষণীয় ব্যাপারে পরিণত হয় আমাদের কাছে। প্রতিরাতের আড্ডায় আরব্য রজনীর গল্পের মতো কত কথা যে জানা যায়, কত যে গল্প! আমাদের টিমে রয়েছেন কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া, লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া, সাবেক গভর্নর লায়ন মনজুর আলম মনজু, লায়ন রাশেদা মনজুর রাশু, লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা। আমরা জুনিয়র টিম গল্প বলার চেয়ে শুনি বেশি। আমার স্যার এম এ মালেক এবং লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়ার অভিজ্ঞতার ঝুড়ি এতই সমৃদ্ধ যে সেখান থেকে টুকটাক যা পাই তাতেই আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি।
বিশাল রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। বিশাল মানে বিশাল। এত চওড়া রাস্তা ভারতে অনেক আছে, আমাদের তেমন বেশি নেই। চমৎকার রাস্তায় গাড়িতে চড়েও আরাম। অন্যরকমের আয়েশে বন্ধ হয়ে আসছিল চোখ। লায়ন আনোয়ারুল আজীম ভাই আমাদের জন্য একজন গাইডের ব্যবস্থাও করেছেন। আগ্রায় উনি আমাদের সাথে যোগ দেবেন। তাজমহল থেকে শুরু করে সবকিছু দেখিয়ে রাতে গাড়িতে তুলে দিয়ে উনি বিদায় নেবেন। আহা, রাজ দরবারে যাচ্ছি যেন রাজকীয় আয়োজনে। কি যে সুখ সুখ লাগছে!
দিল্লী থেকে আগ্রার দূরুত্ব ১৭০ কিলোমিটারের মতো। যমুনা এঙপ্রেসওয়ে নামের বিশাল একটি রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। এর বাইরেও নাকি আরো রাস্তা রয়েছে। ঘুরপথেও যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। আগেই বলেছি এঙপ্রেসওয়ে বিশাল চওড়া। সার্ভিস লেইনসহ আট লেনের রাস্তা। একশ’ বিশ থেকে দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটছে এক একটি গাড়ি। এঙপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালিয়ে আরাম, চড়েও শান্তি। একেবারে উড়ে চলার মতো গতিতে ছুটছে গাড়িগুলো। আমাদের ছোট্ট গাড়িও। ওয়ানওয়ে রোড। পাশাপাশি চলছে তিন চারটি গাড়ি। মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়ার কোন আশংকা নেই, তবে পেছন থেকে সজোরে লাথি মারার মতো অঘটন ঘটার শংকা সারাক্ষণই কড়া নাড়ে। যেহারে দামি দামি সব গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বের হয়ে যাচ্ছে তাতে যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে। তবে ভাগ্যক্রমে তেমন কোন ঘটনা ঘটছে না। আমরা দিব্যিই এগিয়ে যাচ্ছি। পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছি। প্রিয়তমা স্ত্রীকে পাশে নিয়ে এভাবে পথ চলার শান্তিটা একটু অন্যরকম। আহা, জীবনের কত স্বর্ণালী সময়ই না মিস করেছি!
দিল্লী থেকে কিছু পথ আসার পর পড়লো টোলপ্লাজা। টোল পরিশোধ না করে ওপারে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমন চটকদার রাস্তায় ছুটবেন আর টোল দেবেন না তা কি হয়! এঙপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালাতে টোল পরিশোধ করতে হয়। বেশ কয়েকশ’ রুপির টোল। ড্রাইভার বিশেষ কার্ড থেকে টোল পরিশোধ করলেন। দারুণ এক গতিতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। ক্রমে আমরা আগ্রার দিকে এগুচ্ছি। ক্রমে তাজমহলের কাছাকাছি যাচ্ছি।
গাড়ি ছুটছিল। মাঠের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে এঙপ্রেসওয়ে। ধূ ধূ মাঠ। কোথাও ফসলভর্তি ক্ষেত। দূরে পাহাড়, কোথাও বা নদী। ধারে কাছে কোথাও কোন বাড়ি ঘর নেই। কেমন ছিমছাম, নিরবতা। ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি চালানোর পর চালক গতি কমালেন। ইন্ডিকেটর দিলেন বামে। অর্থাৎ তিনি রাস্তা থেকে বামে যাবেন। কিন্তু এঙপ্রেসওয়ে তো সোজা সামনে দেখা যাচ্ছে। তাহলে ড্রাইভার বামে যাচ্ছেন কোথায়! এই ধরনের ট্যুর অপারেটরের গাড়িগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে কোন শংকা থাকে না। অঘটন যে ঘটে না তা নয়, তবে চালকের চৌদ্দগোষ্ঠীর ঠিকুজি ট্যুর অপারেটরের অফিসে সংরক্ষিত থাকায় এরা সাধারণত কোন ক্রাইমে জড়ান না। এক্ষেত্রেও কোন ধরনের ক্রাইমের আশংকা করছিলাম না আমরা। তবে ধূ ধূ মাঠে গাড়ি থামানোর সংকেত কিছুটা বেমানান লাগছিল। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন তিনি। বললেন, চা খাবো। সামনে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। এক্সপ্রেসওয়ের পাশে। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছে করছিল। কফি হলেও চলতো।
বামে ইন্ডিকেটর দিয়ে আধা কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে রেস্টুরেন্টের দেখা পেলাম। রেস্টুরেন্ট নয়, একটি ছোটখাটো বাজারের মতো। পাশাপাশি কয়েকটি রেস্টুরেন্ট, টয়লেট, দোকানপাট। সবকিছু মিলে একটি গুচ্ছ টাইপের শপিং এরিয়া। এঙপ্রেসওয়ে থেকে কিছুটা দূরে বাইপাস সড়কের মতো করে শপিং এরিয়াটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে।
চালক গাড়ি পার্কিং করে আমাদের একটি দোকানের সাইনবোর্ড দেখিয়ে দিলেন। বললেন, এখানেই থাকবেন। আমরা যেন চা খেয়ে এসে এখানেই তাদের জন্য অপেক্ষা করি। আমি ড্রাইভারকে আমাদের সাথে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি কেন জানি না, বিনীতভাবে ‘না’ করলেন। জাতপাতের কোন ব্যাপার স্যাপার আছে কিনা কে জানে!
আমরা দুজন একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। বিশাল রেস্টুরেন্ট। কয়েকশ’ মানুষ একই সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করতে পারবে। আমরা হালকা নাস্তা করলাম। কফিও খেলাম। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে স্যুভেনিরশপে ঢুঁ মারলাম। নানাকিছু দেখলাম, কিন্তু কিনলাম না। ফিরে এলাম গাড়িতে। চালক আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি নাস্তা করেছেন কিনা জানতে চাইলাম। বেচারা হাসলেন।
এবার ডানে ইন্ডিকেটর দিয়ে বের হয়ে আসলো আমাদের গাড়ি। আবারো উঠে গেল আট লেনের এঙপ্রেসওয়েতে। বিপুল গতিতে ছুটতে লাগলো। ছোট্ট গাড়িটির এত গতি! ড্রাইভার হিন্দি গান বাজাচ্ছেন সিডি প্লেয়ারে। একেবারে লো ভলিউমে বাজছে গান। আমরা আমাদের মতো করে গল্প করছি। বাংলায়। ড্রাইভার আমাদের কথা বুঝতে পারছিলেন না। তাই আমরা আমাদের মতো করে বেশ কথাবার্তা চালাচ্ছিলাম। আমাদের কোন কথাই চালক বুঝতে পারছিলেন না। আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে গল্পে গল্পে বিভোর হয়ে উঠেছিলাম। খুনসুটিও করছিলাম। নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। অনেক বেশি সুখীও। প্রিয়তমা স্ত্রীকে পাশে নিয়ে উড়ে বেড়ানোর সুখ আমাকে আচ্ছন্ন করছিল। মনে হচ্ছিল সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য তাজমহল বানিয়েছেন। আরো বহু কিছু করেছেন। কিন্তু তিনি কি স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে দেড়শ’ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলার রোমাঞ্চ কখনো অনুভব করতে পেরেছিলেন! ছুটছিল আমাদের গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। বাইরে ধূলোবালির কোন ঝামেলা নেই। নেই শীত গ্রীষ্মের সুখ অসুখও। নিজেদের মতো করে এমনতর ছুটে চলার আনন্দ আমাদের ভিতরে বাইরে অন্যরকমের সুর তুলছিল। (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।