(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মুগ্ধতা আচ্ছন্ন করছিল আমাদের। শরীর মন ফুরফুর করছিল। দীর্ঘক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটির কোন প্রভাবই টের পাচ্ছিলাম না। প্রাসাদের ভিতরে বাইরে ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে বিস্মিত হচ্ছিলাম। বিমোহিত হচ্ছিলাম ছিটেফোঁটায় সৌন্দর্যে। এই ভবনের ভিতরে বাইরের সবকিছু জানলে বা জানাতে পারলে কেমন লাগতো কে জানে!
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবছিলাম সম্রাটদের কথা, সম্রাজ্ঞীর কথা! তাদের জীবন জৌলুশের কথা ভাবছিলাম। কী আলীশান এক একটি জীবন! কী সমৃদ্ধি! জীবন এবং যৌবনের জয়গান রচিত হতো ভবনটির এখানে সেখানে! লালকেল্লা থেকে বেরিয়ে আসলেও অন্তর জুড়ে কেবলই নানাকিছু ঘুরপাক খাচ্ছিল।
ছুটছিল আমাদের গাড়ি। দিল্লীর রাজপথ ধরে ছুটছিলাম। সড়ক জুড়ে নানা ব্যস্ততা। ছুটছে হাজার হাজার গাড়ি, দলে দলে মানুষ। তাদের পাশাপাশি ছুটছিলাম আমরাও। ‘লালকেল্লা কেমন দেখলাম’ জানতে চাইলেন ড্রাইভার। উত্তর দিতে গিয়ে মুগ্ধতা লুকাতে পারলাম না। ইতিহাসের অমর সাক্ষী এই লালকেল্লা যে দিল্লীর অতি গর্বের ধন তাও ড্রাইভার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন। কোটি কোটি ডলার আয় হচ্ছে এক লালকেল্লা দিয়ে। সম্রাট শাহজাহান নিজেও ভোগ করে গেছেন, ভোগ করেছেন পরবর্তী অনেকে। অতীতের সেই ভোগ বিলাসের কিছু আর অবশিষ্ট না থাকলেও কোটি কোটি ডলার আয় হচ্ছে। যা দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও হালজামানার রাজাদের ভোগ বিলাস চলছে!
ড্রাইভার ইন্ডিয়া গেটের সামনে আমাদের নামিয়ে দিলেন। বললেন, এখানে পার্কিং নেই। আমাকে দূরে চলে যেতে হবে। আপনারা আশপাশটা ঘুরেটুরে দেখুন। শেষ হলে ফোন করলে আমি তুলে নেবো।
ইন্ডিয়া গেট আমরা আগেও এসেছি। ঘুরেছি, দেখেছি। তবে এসব স্থাপনা যতবার ইচ্ছে দেখা যায়। হাজারবার দেখায়ও পুরানো মনে হয় না। আদল এবং নামে গেট হলেও ইন্ডিয়া গেট আসলে একটি স্মৃতি সৌধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত ৯০ হাজার ভারতীয় সেনা সদস্যের স্মৃতিরক্ষার্থে এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। দিল্লী শহরের প্রাণকেন্দ্রে সৌধটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯২১ সালে, নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩১ সালে। প্যারিসের আর্ক দ্য ত্রিয়োম্ফ আদলে নির্মিত এই সৌধের নকশা করেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস। ইন্ডিয়া গেটের আগে নাম ছিল ‘অল ইন্ডিয়া ওয়ার মনুমেন্ট’। পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় ইন্ডিয়া গেট।
শুরুতে ইন্ডিয়া গেটের নিচে রাজা পঞ্চম জর্জের একটি মূর্তি ছিল। পরবর্তীতে সেটিকে সরিয়ে দিল্লী করোনেশন পার্কে স্থাপন করা হয়। প্রায় ১৪০ ফুট (৪২ মিটার) উঁচু ইন্ডিয়া গেটের পেছনের দিকে স্থাপন করা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’। একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়। বেশ মনছোঁয়া একটি স্থাপনা। চারকোনা একটি মঞ্চের উপর সুন্দর একটি কালো বেদি। বেদির উপর দাঁড় করিয়ে রাখা কুচকুচে কালো একটি রাইফেল। রাইফেলের মাথায় সৈনিকের হেলমেট। কোন সৈনিক নেই, কেউ নেই। কেমন অদ্ভুদ এক শূন্যতায় বেদির উপর শুধু রাইফেল আর হেলমেট। তাও কাৎ হয়ে পড়ে যাওয়া লাওয়ারিশ রাইফেল নয়, মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়ে রাখা অস্ত্র। পাশে জ্বলছে আগুন। বেদিকে ঘিরে চারপাশে চারটি কুন্ড থেকে রাতে দিনে আগুন জ্বলে। অনেকটা আমাদের শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণের মতো।
ইন্ডিয়া গেট নির্মিত হয়েছে বেলে পাথর ও মার্বেল দিয়ে। গেটের দেয়ালজুড়ে হাজার হাজার সৈনিকের নাম। যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর হয়ে জীবন দিয়েছেন। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী ইন্ডিয়া গেট পরিদর্শন করেন। তারা শ্রদ্ধা জানান জীবন দেয়া সৈনিকদের। অনেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নামগুলো পড়েন। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নাম রয়েছে ইন্ডিয়া গেটের দেয়ালে। রহিম করিম গনেশ জর্জ সবার নামই রয়েছে কাতারে কাতারে। সকলেই সমানভাবে শ্রদ্ধা পান, পেয়ে আসছেন বহু বছর ধরে। জাতীয় দিবসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিয়া গেটে এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্যালুট করেন ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’কে।
ইন্ডিয়া গেটের ধারেকাছে ভীষন কড়াকড়ি। বহু সৈনিক, পুলিশ। বিশেষ কোন তোড়জোড় আছে কিনা কে জানে। আমরা হেঁটে হেঁটে সবকিছু দেখছিলাম। পাশে একটি যাদুঘরও রয়েছে।
দিল্লী শহরের প্রাণকেন্দ্র রাজপথের বিশাল এলাকা নিয়ে ইন্ডিয়া গেট। চারপাশে বহু জায়গা। রাস্তাগুলোও বিশাল। এত বিশাল যে ধূ ধূ করে। ইন্ডিয়া গেট থেকে কাছেই ভারতীয় সংসদ ভবন। এর অদূরেই ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন। ইন্ডিয়া গেটের সামনে থেকেই দেখা যাচ্ছে বিশাল রাষ্ট্রপতি ভবন, গোলাকার সংসদ ভবন। স্ত্রীর হাতটি হাতে নিলাম। আলতো করে চাপ দিয়ে বললাম, চল, রাষ্ট্রপতি ভবন দেখে আসি। হাঁটতে পারবে? মাথা নেড়ে সায় দিল স্ত্রী। চোখে চোখ রাখলো। সেই চোখের ভাষা যেন বলছিল, তুমি পাশে থাকলে যোজন যোজন হাঁটতে পারি। আমরা গল্পে গল্পে হাঁটছিলাম। বিশেষ কোন তাড়া নেই, নেই বিশেষ কোন তোড়জোড়। সফরসঙ্গিদের হোটেলে রেখে সকালে বের হয়ে এসেছি আমরা। এখন কে যে কোথায় আছেন! আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সাথে দুই দফায় কথা হয়েছে, ফোনে। তিনি বিশেষ কোথাও যাননি বলে জানালেন। কোন এক শপিং মলের নাম উল্লেখ করে বললেন, ওখানেই বসে আছেন। ম্যাডাম মিসেস কামরুন মালেক, লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরীও স্যারের সাথে রয়েছেন। অপরদিকে লায়ন মনজুর আলম মনজু এবং রাশু ভাবী অন্য কোন এক শপিং মলে গিয়েছেন বলেও জানালেন এডিটর স্যার। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং লায়ন সুপ্রভা বৌদি হোটেল থেকে বের হননি। উনারা রেস্ট নিচ্ছেন। এডিটর স্যার আমাকে সবকিছু মন ভরে দেখার পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘এগুলো আমাদের অনেকবার দেখা। সবগুলো দেখা। কোনকিছু দেখার বাকি নেই। তুমি দেখে নাও।’
স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে বিশাল রাস্তাটির একপাশ ধরে হাঁটতে লাগলাম। ইচ্ছে করলে গাড়ি ডেকে নেয়া যেতো। আমাদের ড্রাইভারও ধারে কাছে কোথাও আছে। তবুও কেন জানি না, আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। হাত হাতে নিয়ে হাঁটা!! এর যেন কোন তুলনা হয়না। আহা, বেশ আফসোস হচ্ছে। জীবনে কত হাজার হাজার মাইল পথ হেঁটেছি। কিন্তু কখনো হাতটি এমন করে হাতে নেয়া হয়নি। দেশে এভাবে হাঁটতে পারি না। সময়ও হয়না। যে যার মতো ব্যস্ত থাকতে হয়। সকাল থেকে গভীর রাত, কিভাবে যে চলে যায়! সবকিছু ভুলে ভুলে উড়ে উড়ে হারিয়ে যায়!! সংসার, সন্তান, চাকরি, পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজন নিয়ে বয়ে যায় জীবন। সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মাঝেও সুখ আছে, তৃপ্তি আছে। তবে স্বার্থপরের মতো একা একা থাকার মাঝেও বুঝি বিশেষ ‘প্রাপ্তি’ আছে। কত না পাওয়া নিয়ে কতজনের জীবন বয়ে যায়!!
হাঁটছিলাম আমরা। রোমাঞ্চে ভর করে পথ চলছিলাম। চারপাশে কেউ আমাদের চিনে না, কেউ না। কেউ আমাদের দিকে তাকাচ্ছেও না। কারো কোন আগ্রহ নেই আমাদের প্রতি, আমাদেরও। বাহ, কি দুর্দান্ত এক স্বাধীনতা!
রাষ্ট্রপতি ভবনে বেশ কিছু অংশ ঘুরে দেখা যায়। তবে সেজন্য পূর্ব থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অনলাইনে আবেদন করতে হয়। বেশ লম্বা প্রক্রিয়া। আগে থেকে রেজিস্ট্রেশন করে যাওয়া ছাড়া তাৎক্ষনিকভাবে বাইরের অংশ দেখা যায়। ভিতরে প্রবেশের সুযোগ থাকে না।
ভীষণ কড়াকড়ি দেখলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে। পুলিশী ব্যারিকেড, কাঁটাতারের। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খোলা চোখে যতটুকু দেখা যায় তাই দেখছিলাম। এমন বিশাল একটি ভবনের সামনে দাঁড়ানোই বড় ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল। ভিতরে রাজা থাকবেন। বাদশা থাকবেন। আমরা আম জনতা দূর থেকে দেখবো, এটাইতো নিয়ম।
ভবনটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৯১২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৯২৯ সালে সম্পন্ন হয় বিশাল এই ভবনের নির্মাণ কাজ। প্রতি ফ্লোরে দুই লাখ বর্গফুট আয়তনের ভবনটির স্থপতি এডউইন লুটিয়েনস। ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয়’র বসবাসের জন্য ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভারতে ব্রিটিশদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটির বসবাস ছিল এই ভবনে। এখান থেকেই শাসিত হতো বিশাল ভারত। এখান থেকেই লুটপাট এবং শোষণ বঞ্চনার নানা প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হতো, হয়েছে। সেই ভাইসরয় হাউজই ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রপতি ভবন হয়ে যায়। সেই তখন থেকেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্রপতি নান্দনিক এই ভবনটিতে বসবাস করেন। রাষ্ট্রপতি পাল্টান, পাল্টে যায় বহুকিছু। কিন্তু ভবনটির নান্দনিকতা কখনো পাল্টায় না। অক্ষয় থাকে এই ভবনের অপরূপ সৌন্দর্য।
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মুঘল গার্ডেন্স, মুঘল বাগান। নানাজনের কাছ থেকে এই মুঘল বাগানের বর্ণনা শুনেছি। তবে দেখার সুযোগ হয়নি। শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনেই নয়, মুঘল গার্ডেন্স পুরো ভারতেরই নাকি অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান। মুঘলদের অস্থিত্ব বিপন্ন করা ব্রিটিশ বাহিনী বাগানটির নাম কেন যে মুঘলদের নামে রাখলো তা বুঝতে পারছিলাম না। ১৯১৭ সালে বাগানটির নকশা চূড়ান্ত করা হয়। বিশাল প্রাসাদের পশ্চিমপ্রান্তে মুঘল গার্ডেন্সের অবস্থান। শত শত প্রকারের ফুল রয়েছে বাগানটিতে। শুধু গোলাপই ফোটে নাকি ১৫৯ রকমের! টিউলিপ থেকে গাঁদা, রজনী গন্ধা থেকে হান্সাহেনা, মুহুয়া থেকে চম্পা কি নেই দুনিয়ার অন্যতম সেরা এই বাগানে!! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।