(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গাইডের পাশে পাশে ঘুরছিলাম। সারাক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন। সম্রাটের হেরেমখানা থেকে রসই ঘর পর্যন্ত সবই। মোতি মসজিদের বর্ণনাও দিলেন দারুণভাবে। হিন্দীভাষী গাইডের বহু কথাই বুঝতে পারছিলাম না, অনুমান করছিলাম। তিনি হিন্দির সাথে ইংরেজি মিশিয়েও কথা বলছিলেন। ওগুলো আবার বেশ ভালো বুঝা যাচ্ছিল। লালকেল্লার সবকিছুই গাইড চিনেন, জানেন। পুরো লালকেল্লা একেবারে নখদর্পণে। এই লালকেল্লার উত্থান পতনের পুরো ইতিহাসই গাইডের মুখস্থ। অবশ্য ‘গাইডের’ কাজটি এমনই। একজনকে পথ দেখানো সহজ কথা নয়। পথের সকল আঁক-বাঁক আগে নিজেকে ভালো করে জানতে হয়। পরে অন্যজনকে ওই পথ দেখানো সম্ভব হয়। দর্শনীয় স্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে বা সবকিছু না জানলে দর্শনার্থীকে গাইড দেয়া সম্ভব হয় না। আবার সবকিছু জানলেই শুধু হয়না, নির্ভুলভাবে জানতে হয়। বিশেষ করে তথ্য উপাত্ত নির্ভুল না হলে গাইড হিসেবে সফল হওয়া কঠিন।
আমাদের গাইডও অনেক কিছু জানেন। নির্ভুলভাবে জানেন। ইতিহাসের পরতে পরতে ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকা সব তথ্যই তার ঠোঁটস্থ। ইতিহাস বিকৃতি আছে, চরিত্রহরণ আছে, আছে আরো নানাকিছু। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের গাইড বেশ নির্মোহভাবে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরছিলেন। গল্পের ছলে কথা বলছিলেন তিনি। টিপ্পনিও কাটছিলেন। সম্রাটের হেরেম থেকে শোয়ার ঘর কিংবা রাণীদের গোসলখানা নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে নিজের মতো করে রস চালিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। আবার মোতি মসজিদ নিয়ে কথা বলার সময় কেমন সশ্রদ্ধ একটি ভাব তার চোখে মুখে। গাইড হিসেবে ভদ্রলোক যে বেশ সফল তা বুঝতে পারছিলাম। আমার স্ত্রীও বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখছিল সবকিছু। গাইডের কথা শুনছিল। হিন্দী কিংবা ইংরেজিতে তার সমস্যা নেই। যত সমস্যা আমার। মাঝে মধ্যে গাইডের বয়ান সে আমাকে অনুবাধ করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে সবকিছু দেখছিলাম আমরা। দারুণ এক সময় কাটাচ্ছিলাম। অবাধে ঘুরছিলাম। লালকেল্লার এক চত্বর থেকে অন্য চত্বরে যাচ্ছিলাম। বেশ কিছু জায়গায় দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষেধ। ওসব জায়গায় বেশ কড়াকড়ি। সশস্ত্র পাহারা রয়েছে। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ উঁকিঝুঁকি মেরে ভিতরের নানা কিছু দেখার চেষ্টা করছিলেন। উঁকি মেরে অন্দরমহলের নানা কিছু দেখারও চেষ্টা হলো। তবে আমরা উঁকি ঝুঁকি মারলাম না। গাইডও ‘না’ করলেন। বললেন, ওভাবে কিছু দেখা যায় না, শুধু শুধু কষ্ট। অহেতুক কষ্ট করে কোন লাভ নেই। তাছাড়া যা দেখার তাতো উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। যেগুলো নিষিদ্ধ সেগুলো নিষেধ করার নিশ্চয় কোন কারণ আছে। আমরা এক কামরা থেকে অন্য কামরায় যাচ্ছিলাম, যাচ্ছিলাম এক স্থান থেকে অন্যস্থানে। বিশাল লালকেল্লার হেথায় হোথায় কত কিছু যে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে! কতটুক আর দেখা যায়! একদিনে বিশাল এই কেল্লার সবকিছু দেখা অসম্ভব। মাঠের খোলা চত্বর থেকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কামরা পর্যন্ত সবখানেই ঐতিহ্যের ছাপ, সমৃদ্ধির পরশ। রুচি এবং শিল্পের এক অপরূপ সমন্বয় চারদিকে। রাজার হালে বসবাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই আড়াইশ’ একরের কিছু বেশি জায়গাটিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কোন কিছুরই কমতি ছিলনা কোনদিকে। মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে নির্মিত হয়েছিল লালকেল্লা। চাইলে আরো বহু বেশি বিস্তৃত করে দুর্গটি নির্মাণ করতে পারতেন সম্রাট শাহজাহান। অথচ তিনি ২৫৬ একর জায়গায় অষ্টকোনী লালকেল্লা গড়ে তোলেন দারুন দক্ষতায়। সম্রাট শাহজাহান থেকে পরবর্তী বেশ কয়েকজন সম্রাট এখানে বসবাস করে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন।
গাইড জানালেন যে, মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন এক সময় ৩২ লাখ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। লোকসংখ্যা ছিল ১৫ কোটির মতো। যা ওই সময়কার পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। আহা, পৃথিবীতে কত কম মানুষ ছিল! মাত্র ৬০ কোটি মানুষের দখলে আস্ত পৃথিবী!! আমার ভিতরটি হাহাকার করে উঠলো!
মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল ১৫২৬ সালে। সম্রাট বাবর এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। রাজধানী গড়ে তোলা হয়েছিল আগ্রাতে। পরবর্তীতে ফতেহপুর সিক্রি এবং লাহোর ঘুরে পুনরায় রাজধানী নিয়ে আসা হয়েছিল আগ্রাতে। ১৬৪৮ সালে আগ্রা থেকে রাজধানী নিয়ে আসা হয় শাহজাহানাবাদ বা বর্তমান পুরান দিল্লীতে। সম্রাট শাহজাহানের হাত ধরে লালকেল্লায় যেই শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল তা ১৮৫৭ সালে সাম্রাজ্যের পতনের মাঝ দিয়ে শেষ হয়। এই লালকেল্লায় বহুমুখী ষড়যন্ত্র হয়েছে। হয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। ভোগ বিলাসে মত্ত মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের ইতিহাস ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে এখানে। অদক্ষ শাসকের হাতে পড়ে নানামুখী অব্যবস্থাপনায় একসময় বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনীতির শক্ত ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য। পরাজয় ঘটতে থাকে তাদের। সংকোচিত হয়ে যায় তাদের ক্ষমতা এবং সাম্রাজ্য। জৌলুশ হারানো মুঘল সাম্রাজ্যের অবস্থা শেষকালে একেবারে ম্রিয়মান হয়ে যায়। শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সাম্রাজ্য কেবল শাহজাহানাবাদ (বর্তমান পুরান দিল্লী) শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ৩২ লাখ বর্গকিলোমিটারের সাম্রাজ্য নেমে এসেছিল মাত্র কয়েক কিলোমিটারে! অবিশ্বাস্য ওই পতন বিস্ময়কর!! কি করে সম্ভব! কি করে আস্ত একটি সাম্রাজ্য তিল তিল করে হাতছাড়া হয়ে যায়!! শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদূর শাহ, ক্ষমতা এবং জৌলুশ হারিয়ে অক্ষম এক শাসক হিসেবে দিনাতিপাত করছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্য বিস্ময়ের আরো অনেক কিছু তখনো বাকি ছিল। ওই সময় সিপাহীদের মহাবিদ্রোহ শুরু হয়। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর ওই বিদ্রোহের সমর্থনে একটি ফরমান জারি করেন। কিন্তু ভাগ্য এখানেও প্রবঞ্চিত করে সম্রাটকে। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ১৮৫৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর লালকেল্লা ত্যাগ করে বের হয়ে পড়েন। রাজ্য, রাজপ্রাসাদ, ক্ষমতা সব ছেড়ে রাস্তায় নেমেও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের শেষরক্ষা হয়নি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাটের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ব্রিটিশ বাহিনী সম্রাটকে ধরে আবারো লালকেল্লায় নিয়ে আসে। ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজ্যচ্যূত সম্রাটের বিচার শুরু হয়। একসময় যেখানে সম্রাট ঝরোখা দর্শন দিতেন, যেখানে সম্রাটের সকাল সন্ধ্যা জৌলুশে ভরে উঠতো, সেই দেওয়ানি খাসের সামনে বসানো হয় আদালত, ব্রিটিশ কোর্ট। ওই বছরের ৭ অক্টোবর সম্রাটকে রাজদ্রোহী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয় ব্রিটিশ কোর্ট। বিচারে সম্রাটের উপাধি ‘বাহাদুর’ কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি তাঁকে নির্বাসন দন্ড দেয়া হয়। ব্রিটিশ বাহিনী সম্রাটকে হত্যা করতে পারতো, কিন্তু কেন যে বুড়ো সম্রাটকে হত্যা করা হলো কে জানে। সম্রাটকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয় বার্মার রেঙ্গুনে (বর্তমান মায়ানমার)। সেখানেই তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে হতভাগ্য মুঘল সম্রাট লিখে গিয়েছিলেন, ‘কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর/ দফনকে লিয়ে দো গজ জমিনভি মিল নহি সকি।’- ‘জাফর, তুমি এতই দুর্ভাগা, ভালবাসার দেশে তোমার কবরের জন্য দু’গজ মাটিও জুটল না।’ রেঙ্গুনে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে কথাটি খোদিত রয়েছে।
হতভাগ্য সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসনে পাঠিয়ে লালকেল্লার পুরো কর্তৃত্ব নেয় ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী। লালকেল্লাকে তারা ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয়ের পর লাল কেল্লাতেই যুদ্ধবন্দীদের বিচার হয়। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত কেল্লাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে ছিল। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো লাল কেল্লাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।
গেটের কাছে এসে গাইড আমাদের থেকে বিদায় নেয়ার আগে চা কফি খাবো কিনা জানতে চাইলেন। আমার নিজেরও কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। মনে হলো, দীর্ঘক্ষণ বকবক করতে করতে গাইডেরও ক্ষুধা লেগেছে। উনার ফি যদিও দেয়া হয়েছে তবুও আমি কফি খাবো বলে জানালাম। তিনি আমাদের একটি কফি শপে নিয়ে গেলেন। একেবারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। তিনটি বার্গার এবং কফির অর্ডার দিলাম। বেশ রয়ে সয়ে কফি খেতে খেতে মনে হচ্ছিল আহারে সম্রাট! আহারে রাজা! আহারে ক্ষমতাবান মানুষ। সময়ের ব্যবধানে সবই বুঝি অচিন হয়ে যায়, সবই বুঝি যায় হারিয়ে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।