দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইতিহাস এবং ঐতিহ্য মোড়ানো দিল্লী। দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরানো শহর। নানা ঘাত প্রতিঘাতের শহর। বিশ্বাসঘাতকতার শহর। রাজা রাজা যুদ্ধের শহর, সাম্রাজ্য থেকে সাম্রাজ্যের বিস্তারের শহর। মুম্বাইর পরে দিল্লীই ভারতের দ্বিতীয় জনবহুল শহর। পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ এই শহরটি যে কোন বিচারে ভারতের অতি খান্দানী একটি শহর। দিল্লীর চেয়ে সুন্দর শহর ভারতে হয়েছে। হয়েছে গোছানো এবং পরিকল্পিত শহর। কিন্তু ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধিতে দিল্লীর ধারে কাছে যাওয়ার মতো শহর আর একটিও ভারতে নেই। দিল্লীর অলিতে গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। ভালোবাসার ইতিহাস। সম্মান, সমৃদ্ধি এবং কল্যানের ইতিহাস। ঐতিহ্যের মুক্তো ছড়ানো রয়েছে শহরটির পরতে পরতে। প্রায় পনেরশ’ বর্গকিলোমিটারের মেগাসিটি দিল্লীতে পৌনে দুই কোটির মতো মানুষের বসবাস। শত শত বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিল্লীতে কয়েক লাখ কোটিপতি বসবাস করেন। বাস করেন শিল্পপতি, ব্যবসায়ী। একই সাথে অগুনতি অভাবী মানুষের কাফেলা হরদম পথ চলে দিল্লীতে। রাস্তায় রাস্তায়, মোড়ে মোড়ে বসে থাকে অসংখ্য অনাহারী মানুষ। করুণ আর্তি জানায় হাজারো অভাবী মুখ।
তারকাখচিত হোটেলে চমৎকার রুম আমাদের। কিন্তু জানালার পর্দা সরাতেই চোখের সামনে উন্মুক্ত বস্তী, অসংখ্য কাঁচা ঘর। বস্তীতে ঘরের দাওয়ায় বসে কাজ করছেন জীর্ণশীর্ণ মহিলা। তাদের হাড় জিরজিরে শরীরই বলে দিচ্ছে তেমন একটি সুখ নেই ঘরগুলোতে। উদোম শরীরের শিশু কিশোরের দল খেলার নামে হল্লা করছে। আমার স্ত্রী সেদিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। অতি অল্পতে কাতর হয়ে উঠা আমার ঘরনির কাছে অভাবী মানুষগুলোর কষ্ট যেন কিছুটা বাড়তি হয়ে ধরা দিচ্ছিল। আমি তার হাতটি হাতে নিলাম। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এর থেকে খারাপ অবস্থায় থাকে বলেও জানালাম। প্রতিরাতে একশ’ কোটিরও বেশি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার তথ্যটি আমার স্ত্রী ক্লাসে পড়ায়। সুতরাং তাকে ওসব নতুন করে জানানোর কোন মানে হয়না। পৃথিবীতে অভাবী মানুষের কাফেলা ক্রমে বড় হচ্ছে। ক্রমে বাড়ছে ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। এদের কষ্ট দূর করার উদ্যোগ কেউ কেউ নিতে পারেন, যারা ইচ্ছে করলেই পৃথিবীর বহু মানুষের কষ্টের ভয়াবহতা কমিয়ে দিতে পারেন। তারা চাইলেই পৃথিবী অনেক বেশি বাসযোগ্য হয়ে উঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাদের অনেকেই এসব হাড় জিরজিরে মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবছেন না। এদের কষ্ট দূর করার সামাণ্যতম চেষ্টাও করছেন না। তাদের হাতে অত সময়ও হয়তো নেই।
স্ত্রীকে সাথে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। আমাদের গ্রুপের সকলেই রুমে রয়েছেন। রেস্ট নিচ্ছেন। আমরা রেস্টের চেয়ে ধারে কাছে ঘুরে ফিরে দেখার উপর জোর দিলাম। হোটেলের কাছটা ঘুরে দেখার জন্য পথে নামলাম। পার্কিং এ আমাদের দুজনের জন্য আস্ত একটি গাড়ি থাকলেও ড্রাইভারকে ফোন করলাম না। আমরা হাঁটছিলাম। ফাইভ স্টার হোটেলের সন্নিকটে এমন বেহাল দশা সচরাচর কোথাও চোখে পড়ে না। দিল্লীর এই অভাবী দিকটি আগেও দেখেছি। এবারও বেশ চোখে পড়লো। অবশ্য ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর মুম্বাইতেও প্রচুর অভাবী মানুষ দেখেছিলাম। এত অভাবী মানুষ যে মুম্বাইর উজ্জ্বলতা ম্লান করে দিচ্ছিল!
দিল্লীতে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিলাম। চষে বেড়িয়েছিলাম চারদিক। মন ভরে ঘুরেছিলাম নয়া দিল্লী, পুরান দিল্লী। আমার স্ত্রীও এসেছিল একবার। তবে নয়া দিল্লী শহরের এই অংশটির কোন কিছুই আমরা চিনতে পারছিলাম না। অবশ্য চেনার কথাও নয়। প্রতিদিনই রূপ পাল্টায় দিল্লী। রঙ পাল্টে যায়। হাজার হাজার মানুষের নিত্য আনাগোনায় চেনা পথগুলোও হয়ে উঠে অচেনা।
দিল্লীর লোকসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বাড়ছে ভবন। শুধু পাশে নয়, উপরের দিকেও তরতর করে উঠে যাচ্ছে বহুতল অসংখ্য ভবন। অনেক ভবনেরই শীর্ষে ক্রেন দেখা যাচ্ছে। এটি নির্মাণাধীন ভবনের লক্ষন। এক একটি ভবন আরো উপরে উঠছে। শুধু ভবনের দিকে নয়, পাশের দিকেও বাড়ছে দিল্লী। সম্প্রসারিত হচ্ছে শহর। নতুন নতুন এলাকা শহরের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে প্রতিদিন। ভারতে দিল্লীই একমাত্র শহর যেটি পাশের রাজ্যের স্বতন্ত্র শহরগুলোকেও গিলে খেয়েছে। জ্বী, দিনে দিনে হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশের কয়েকটি শহর দিল্লীর অংশ হয়ে গেছে!
দিল্লী শহরের ইতিহাস বহু পুরানো। শত শত বছরের ইতিহাস জড়িয়ে আছে দিল্লীর সাথে। বহু বছর হিন্দু সম্রাট এবং রাজার শাসনাধীনে ছিল দিল্লী। ১১৯২ সালে মুহাম্মদ ঘোরি দিল্লীতে অভিযান চালিয়ে ক্ষমতাসীন হিন্দু রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানকে গদিচ্যুত করেন। পরবর্তীতে ধারে কাছের আরো বহু রাজাকে পরাজিত করে মুহাম্মদ ঘোরির বাহিনী। এরই জের ধরে টানা কয়েকশ’ বছর দিল্লীসহ উত্তর ভারত মুসলিম বিভিন্ন রাজবংশের শাসনে ছিল। তাঁরা দিল্লীতে একাধিক দুর্গ ও নগর নির্মাণ করেছিলেন। ওই সময়কালে দিল্লীতে সুফিবাদেরও বেশ প্রসার ঘটেছিল। ১২৯০ সালে মামলুক সুলতানিকে সিংহাসনচ্যুত করে খিলজি রাজবংশ দিল্লীর অধিকার নেয়। ওই সময় দিল্লীর বেশ বিস্তার ঘটে। ঘটে উন্নয়নও। দ্বিতীয় খলজি শাসক আলাউদ্দিন খিলজির অধীনে দিল্লীর মসনদের ক্ষমতা বেশ পোক্ত হয়। পরবর্তীতে মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে দিল্লী আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। অবশ্য তিনি দিল্লী থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন মধ্য ভারতের দৌলতাবাদে। এতে রাজ্য শাসনে কিছুটা সমস্যা হলে তিনি আবারো রাজধানী ফিরিয়ে আনেন দিল্লীতে। ১৩৯৮ সালে তৈমুর লং দিল্লী দখল করে নেন। পরবর্তীতে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় দিল্লীর মসনদের পালাবদল ঘটতে থাকে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় জুড়তে থাকে নতুন নতুন ঘটনা, যুদ্ধ, হিংসা, প্রতিহিংসা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা। ১৫২৬ সালে এসে দিল্লীর মসনদে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে মুঘল রাজবংশ। দিল্লী এবং আগ্রা থেকে মুঘল রাজবংশ তিনশ’ বছরেরও বেশি সময় দিল্লীতে পতাকা উড়িয়েছিল। মুঘল শাসনামলে সম্রাট শাহজাহান দিল্লীর পাশেই সপ্তম শহর হিসেবে ১৬৩৮ সালে শাহজাহানাবাদ নামের শহর গড়ে তোলেন। যেখান থেকে তিনি পরিচালনা করতেন রাজ্য। ওই শাহজাহানাবাদই এখন ‘পুরান শহর’ বা ‘পুরান দিল্লী’ নামে পরিচিত। বিভিন্ন যৌক্তিক কারনে মোঘল সাম্রাজ্য একসময় দুর্বল হতে শুরু করে। পরবর্তীতে বহু যুদ্ধ, হামলা, লুটতরাজ এবং ঘাত প্রতিঘাতের জের ধরে দিল্লী ব্রিটিশ রাজবংশের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে চলে যায়।
যাক দিল্লীর ইতিহাস নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা আমাদের হোটেলের চারপাশ একটু ঘুরে দেখতে বের হয়েছি। ঘুরছি। রাস্তা দিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি। হাঁটছে অসংখ্য পথচারী। আমরাও পাশ কেটে কেটে পথ চলছি। ফুটপাত কোথাও আছে, কোথাও নেই। আমাদের মতো। তবুও যতটুকু সম্ভব সতর্কতার সাথে পথ চলছি আমরা। হোটেল থেকে সামান্য দূরে একটি রাস্তার মোড়ে অনেক লোকজন। বেশ ভীড়। খেয়াল করে দেখলাম যে, ফুটপাত জুড়ে আমাদের মতো দোকান পাট বসে গেছে। বিক্রি করছে নানা ধরনের জিনিসপত্র। আমাদের মতো টং দোকানে বিক্রি হচ্ছিল চা, চটপটি। পুচকাও তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। বিক্রি করা হচ্ছে পানিপুরীও। আমি স্ত্রীর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম। পানিপুরী আমাদের দেশে পাওয়া যায় কিনা জানি না। তবে কোনদিন কোথাও পাইনি। কলকাতায় খেয়েছিলাম বহু আগে। বিখ্যাত এই পানিপুরী দিল্লীতেও আছে! পানিপুরীর বেশ সুনাম করে স্ত্রীকে বললাম, চল, পানিপুরী খাই। ঘরনি বেঁকে বসলো। এতো নোংরা পরিবেশে এই মানুষের হাত থেকে সে পানিপুরী খাবে না। আরে বাবা, দুনিয়ার কোথাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লোক পানিপুরী বিক্রি করে না। তাই বলে কি মানুষ খাচ্ছে না! রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তেঁতুল ডোবানো পানিতে হাত ডুবিয়ে পানিপুরী বিক্রি করতে হয়। এত পরিষ্কারের সুযোগ কোথায়! আমি বললাম, খাবো। সে খাবে না। এক পর্যায়ে আমার মন খারাপ ভাব দেখে বললো, আচ্ছা তুমি খাও। দুইটির বেশি খেও না। বিদেশে শরীর খারাপ করলে বিপদ হবে। কি যে বলে না পাগলীটা! দিল্লী আবার বিদেশ! আমি অর্ডার করলাম। মাঝবয়সী লোকটি আমার হাতে প্রথমে একটি বাটি দিল। তারপর একটি একটি করে পুচকা বাটিতে দিচ্ছিল। আমি খাচ্ছিলাম। টক দিয়ে প্রচুর ঝাল দেয়া পানিপুরী। দারুন।পুচকার মতো একসাথে সবগুলো সাজিয়ে প্লেটে দিলেই তো হয়, তা দেবে না। এতে কী পানিপুরীর কৌলিন্য নষ্ট হয়? কে জানে!
অনেক অনুরোধ করেও ঘরনিকে একটি পুচকা খাওয়াতে পারলাম না। আটটি ‘পুচকা’ একাই খেলাম। আমার কথামতো বেশ ঝাল করে তৈরি করে দিচ্ছিল। মুখ ভর্তি টেস্ট। আহা, কাকে যে বুঝাবো!
আরো কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে ফিরে আসলাম হোটেলে। নানা রাস্তায় হাঁটলেও পথ হারালাম না। ঠিকঠিক ফিরে এলাম। হোটেলে প্রবেশ করতেই সামনে পড়লো মঞ্জু ভাই। লায়ন মঞ্জুর আলম মনজু। সাথে রাশু ভাবী এবং বাচ্চা। মঞ্জু ভাই আমাদের সাথে সিমলা পর্যন্ত গেলেও ভাবীর জন্য আমাদের আগেই ফিরে এসেছিলেন দিল্লী। আমি রাশু ভাবীকে টিপ্পনি কাটলাম। ‘আবার শপিং এ ছুটলেন?’ রাশু ভাবী দারুন করে হাসলেন। বললেন, ‘ভাইকে জিজ্ঞেস করেন।’ জিজ্ঞেস করার আগেই মঞ্জু ভাই বললেন যে, তিনি স্ত্রী এবং সন্তানসহ হযরত নিজাম উদ্দীন আওলিয়ার মাজার জেয়ারত করতে যাচ্ছেন। সাথে সাথে ইউ টার্ন নিলাম আমি। বললাম, আমরাও যাবো। গাড়ি ডাকতে চাইলাম। কিন্তু মঞ্জু ভাই বললেন, ‘এক গাড়িতেই হয়ে যাবে। দুইটি নেয়ার দরকার নেই।’ হোটেলে না ঢুকেই গাড়িতে উঠে পড়লাম। সেভেন সিটার গাড়িতে বেশ আয়েশ করে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগাহের দিকে আমরা যাত্রা করলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি এবার বড় চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ