দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছুটছে আমাদের গাড়ি। বিশাল চওড়া ওয়ানওয়ে মহাসড়ক ধরে ছুটছিল আমাদের বাহন। গাড়ি যতটা না সুন্দর, তার থেকে ঢের বেশি সুন্দর রাস্তা। এমন মসৃন সড়ক আমাদের দেশে কোথাও আছে কিনা জানি না, তবে চট্টগ্রামে একটিও নেই। থালার পিঠের মতো রাস্তা, পিচঢালা। রাস্তার দু’পাশের নান্দনিকতাও অন্যরকম। প্রচুর বড় বড় গাছ রাস্তার দুইপাশে। গাছগুলোর বিশাল ঢালপালা দুপাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাস্তার মাথার উপর। এতে রাস্তার উপর নান্দনিক একটি ছাদ তৈরি হয়েছে। একই সাথে তৈরি হয়েছে ছায়াঢাকা এক মায়াবী পরিবেশ। শুধু বড় বড় গাছই নয়, ফাঁকফোঁকরেও প্রচুর ছোট ছোট গাছগাছালী রয়েছে। কোথাও কোথাও ফুলের গাছও। সড়কের দুপাশে কোথাও বাড়িঘর, কোথাও দোকান পাট আবার কোথাও শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে ধানী জমি, ফসলের মাঠ। সবকিছু আমাদের মতো, তবে সবকিছু যেন আমাদের থেকে আলাদা।
চীনের অন্যতম শিল্পসমৃদ্ধ অঞ্চল তাইজু যাচ্ছি আমরা । ক্ষেত খামারের বুক ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া মহাসড়ক ধরে ছুটছে আমাদের গাড়ি। তবে আমরা সরাসরি তাইজু শহরে যাবো না। পথে পথে, ঘাটে ঘাটে আরো নানা কিছু করার পর গন্তব্যে পৌঁছাবো। আমাদের দলপতি লায়ন ফজলে করিম ইতোমধ্যে পুরো দিনের প্ল্যান তৈরি করেছেন। প্রিন্ট করে আমাদের হাতে হাতে দিয়েও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিদিনের প্ল্যান প্রতিদিন সকালে তিনি দিয়ে দেবেন। সারাদিন ওই প্ল্যানে চলবে পথচলা। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, অত্যন্ত টাইট প্রোগ্রাম। একেবারে মিনিট সেকেন্ড হিসেব করা। অবশ্য আমি জানি যে, আমাদের দিনকাল এত টাইট থাকবে না, কাজীর গরু কেতাবের মতো আমরাও প্রোগ্রামের সব টাইট-টুইট কাগজে থাকবে, আমরা আমাদের মতো করে দিন পার করতে থাকবো, সবকিছুই করবো। আমরা আমাদের দিনটিকে আনন্দময় করতে যখন যা করা দরকার তার সবটুকুই করতে থাকবো, করবো। অর্থাৎ দিনের পুরোটা সময় আমরা আনন্দের সাথে থাকবো।
ছুটন্ত গাড়িতে আপাতত একটু ঝিমিয়ে নিলে মন্দ হবে না। লায়ন ফজলে করিম দলের সবাইকে নিয়ে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন। তারা চীনের গার্মেন্টস ব্যবসার হালচাল নিয়ে কথা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। চট্টগ্রামের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শরিফ ভাই এবং ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হেলাল ভাই বেশ জমিয়ে তুলছিলেন। কোন মেশিনের সক্ষমতা কেমন, কোন মেশিনের কাজ কেমন, শ্রমিক মজুরী এবং সংকট কোন পর্যায়ে ইত্যাদি নানা কিছু তারা আলোচনা করছিলেন। আমাদের সফরসঙ্গী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী লায়ন আবদুল বারিক শ্রমিক সংকটে নাস্তানুবাদ হওয়ার কথা বললেন। তিনি বললেন, সবকিছু গুছিয়েও শুধুমাত্র শ্রমিকের অভাবে কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন শুরু করা যাচ্ছে না। মেশিন পত্র সব ঠিকঠাকভাবে স্থাপন করেও শ্রমিকের অভাবে চালাতে পারছেন না। চট্টগ্রামের গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক সংকটের কথা বহুদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না যে, লক্ষ লক্ষ বেকারের এই দেশে গার্মেন্টসে শ্রমিক সংকট হবে কেন! কারখানা প্রতিষ্ঠা করেও শুধুমাত্র শ্রমিকের অভাবে চালু করতে না পারার ঘটনা দুঃখনজক।
যাক, ব্যুফে ব্রেকফাস্টের ভরপেট নাস্তার পর একটু বিরতি দিয়ে দুই কাপ কফি খেয়েছি। বিদেশে এই অভ্যাসটিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই আমি। নাস্তায় অগুনতি আইটেম, কোনটি খাই বা না খাই তাতে কিছু যেন যায় আসে না। কিন্তু দুই কাপ কফি না হলে যেন আমার চলে না। নাস্তা শেষ করে সাথে সাথে এক কাপ এবং মিনিট পাঁচেক বিরতিতে দ্বিতীয় কাপ। এই দ্বিতীয় কাপের কফিটি আমি বেশ রয়ে সয়ে খাই, তৃপ্তির সাথে স্বাদ নিই, উপভোগ করি।
কফির প্রথম কাপটি নিজে গিয়ে তুলে আনলেও দ্বিতীয় কাপের জন্য আমি প্রায়শঃ কোন ওয়েটারকে অনুরোধ করি। তারা এনে দেয়, বানায়ও দারুণ করে। চীনের এই হোটেলটিতে এক তরুণীকে ডেকে যখন দ্বিতীয় কাপের অনুরোধ করলাম, তিনি মুখে কিছু না বলে শুধু হাসলেন। বাহ, মন ছুঁয়ে যাওয়া মিষ্টি হাসি। অল্পক্ষন পর এক কাপ ধুমায়িত কফি নিয়ে আমাদের টেবিলে আসলেন তরুণী। সুগার আলাদ, সুগারের পাশাপাশি জিরো ক্যালের দুইটি প্যাকেটও এনেছেন তিনি। দারুণ সুন্দরী একটি মেয়ে, স্মার্টও। এখন দেখছি বুদ্ধিও চমৎকার। আমি চিনি খাবো নাকি জিরো ক্যাল খাবো তা তাকে বলা হয়নি। জিরো ক্যালের এক প্যাকেটে আমার তিতা কফির চিনি ঠিকঠাক হবে নাকি বেশি চিনি লাগবে সেজন্য তিনি দুইটি প্যাকেট নিয়ে এসেছেন। বুদ্ধি না থাকলে এমনটি হতো না। অবশ্য এই ধরনের তারকাখচিত হোটেলগুলোর অধিকাংশ কর্মকর্তা কর্মচারী হোটেল ম্যানেজমেন্টের উপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসেন। আমি যেটাকে বুদ্ধি বলছি সেটি হয়তো তাদের শিক্ষার প্রথম ছবক! তরুণীকে বিনীতভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি কফি উৎসবে মেতে উঠেছিলাম।
দুই কাপ কফি শরীরের ভিতরে নানা সমীকরণ ঘটাচ্ছে। শিরায়, রক্তে নিশ্চয় ক্যাফেইনের কাজ চলছে। স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত রাখতে ক্যাফেইনের কোন বিকল্প নেই। তিক্ত স্বাদের এই বস্তুটি কী করে যে আমাকে এমন করে টানে কে জানে! শরীরে ক্যাফেইন ঘুরপাক খাচ্ছে তাই এত তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে না। অবশ্য এমন লম্বা জার্ণিতে রাস্তার দিকে তাকাতে তাকাতে ঘুম চলে আসে, শরীরে ঝিমুনী আসে। এমন ঝিমুনি দারুণ লাগে, ঘোর লাগা চোখে সবকিছু দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি খুব খারাপ লাগে না।
গাড়ির ভিতরে বেশ গল্প চলছিল। সমমনা মানুষগুলো বেশ জমিয়ে তুলেছেন। উৎসবের আবহ সবার মাঝে। ছায়া ঢাকা চমৎকার রাস্তা ধরে ছুটছি আমরা, দুই পাশে ক্ষেত খামার, বাড়ি ঘর, দোকানপাট। সবই যেন পেছন দিকে ছুটছিল। ক্যাফেইনের প্রভাব কিনা জানি না, তবে শৈশবের নানা স্মৃতি আমাকে তাড়া করতে শুরু করলো। কত কিছু যে মনে পড়ছিল! আহা, কি করে সব সোনালী দিন হারিয়ে গেল!! বাসে চড়ে শহরে আসার সুন্দর সময়গুলোর কথা মনে পড়লো। বাবার সাথে বাসে চড়ে শহরে আসতাম। বাবা সবসময় আমাকে ভিতরের দিকে জানালার পাশে বসাতেন। নিজে বসতেন আইল সিটে। আমার একটি হাত ধরে রাখতেন। আমি জানালায় চোখ দিয়ে পাহাড় দেখতাম, গাছ গাছালী দেখতাম। টেলিফোনের খুঁটি, বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্কুল ঘর— কত কিছু যে দেখতাম। সবই যেন পেছনে দৌঁড়াতো! সবই পেছনে ছুটে চলে যেতো। গাছ গাছালী, ক্ষেত, ক্ষেতের গরু, চাষী সবই কেবলই ছুটতে থাকতো। এমনকি স্কুলের পাকা দালান, সরকারী বাংলো, ওষুধ বানানোর বড় কারখানা, ঘুম ভেঙ্গে দেয়া হুইসেল দেয়া বড় বড় কারখানাগুলোও দৌঁড়াতো পেছনে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মাথার ভিতরে চক্কর দিয়ে উঠতো, মগজে মগজে কেমন যেন ঘুরপাক শুরু হতো! চোখ বন্ধ করে রাখতে হতো।
তখনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস দেশে আসেনি। জানালা খুলে রাখা হতো। জানালা দিয়ে হো হো করে বাতাস আসতো। চুল উড়তে থাকতো। আমি প্রায়শ জানালার বাইরে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বাতাসে চুল উড়াতাম। দারুণ মজা লাগতো। বাবা আলতো করে আমার মাথাটি টেনে নিতেন, ভিতরে রাখতে বলতেন। আহারে বাবা, এখন আর কেউ তেমন করে বলেনা। এখন আর কেউ হাত ধরে বাসের সিটেও বসে থাকে না। বাবার কথা ভাবতে গিয়ে মনটি ভিজে যাচ্ছিল। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। গাড়ি ছুটছিল সামনে, কিন্তু আমার মন কেবলই পেছনে দৌঁড়াচ্ছিল। (চলবে) লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসো হে বৈশাখ
পরবর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধায় স্মরণ : শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ