(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অস্ট্রেলিয়ার রূপে মুগ্ধ আমি, সেই মুগ্ধতা বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে সানশাইন কোস্টের অপরূপ রূপ। কী সুন্দর, শান্ত এবং নিরিবিলি একটি এলাকা, সাগর যেখানে পাহাড়ের সাথে মিতালী পাকায়, প্রেম করে! কী অসাধারণভাবেই না পাহাড় নেমে এসেছে সাগরের কোলে, আর কী দারুণভাবেই না সাগর পাহাড়কে কোলে নিয়ে উল্লাস করছে! আমার মনে হলো, পাহাড়ের উচ্চতা আর সাগরের গভীরতা মিলেই জন্ম নিয়েছে সানশাইন কোস্টের সৌন্দর্য!
আমাদের গাড়ি চলছিল। সানশাইন কোস্ট পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম দক্ষিনে, ব্রিজবেনের পথে। ওখান থেকে যাবো গোল্ডকোস্টে। দূরত্ব প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার। শুধুমাত্র আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার জন্যই ভাগিনি তাবাসসুম এবং তার বর সাজ্জাদ ছয়শ’ কিলোমিটার গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের কষ্টের কথা ভেবে আমার খারাপ লাগছিল, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অচিন এই দেশে নিজেকে দারুণ নিরাপদও মনে হচ্ছিল।
সাজ্জাদকে অনুরোধ করেছিলাম যেনো একটু ব্রিজবেন ঘুরিয়ে তারপর আমাকে গোল্ড কোস্ট পৌঁছায়। সেজন্যই একটু আগে ভাগে সানশাইন কোস্ট ছাড়তে হচ্ছে। নাহয় সন্ধ্যা পর্যন্ত সানশাইন কোস্টের অসাধারণ বিচে সময় কাটিয়ে তবেই যাত্রা করতে পারতাম।
আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে ব্রুস হাইওয়ে ধরে দক্ষিণের দিকে নামতে শুরু করল। সানশাইন কোস্টের গাছ–গাছালির শ্যামল সবুজ রং থেকে হাইওয়ে নামতে না নামতেই দৃশ্যটা বদলে যেতে লাগল। উঁচুনিচু পাহাড়, ফার্মল্যান্ড, দূরে পাহাড়ের সারি, এটা নাকি মালেনির পাহাড়ি ধারা। অস্ট্রেলিয়ার এ রাস্তার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। রাস্তাটি একেবারে শান্ত, বিশাল। এমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সড়ক দুনিয়ায় খুব বেশি আছে বলেও মনে হচ্ছিলো না।
দুপুর গড়াতে শুরু করেছে। আমাদের গাড়ি চলছে। যত দক্ষিণে যাচ্ছিলাম, ততই সূর্যের আলোতে প্রকৃতির রং পাল্টে পাল্টে যাচ্ছিলো। ম্যাপলটন আর ইওমান্ডি শহরের মাঝের উপত্যকাগুলো হয়ে উঠছিল সোনালি। আমাদের গাড়ি ব্রুস হাইওয়েতে, দারুণ গতিতে অসাধারণ সতর্কতায় গাড়ি চালাচ্ছিলো সাজ্জাদ।
ইউমান্ডি মার্কেটের মোড়টা পেরোনোর পর সাজ্জাদ বললো, চলেন, লাঞ্চ করে নিই। ক্ষুধা লেগেছে। তাবাসসুমও একইসুরে কথা বললো। কিন্তু চারদিকের এতো সৌন্দর্য আমাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, থামতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিলো, যত সামনে যাবো ততই নতুন কিছু দেখতে পাবো।
সাজ্জাদ আমাদের একটি রেস্টুরেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে চলে গেলো। ভারতীয় রেস্টুরেন্ট, সাথে পাকিস্তানি খাবারও আছে। ভারত–পাকিস্তানের পরস্পর বিরোধী অবস্থান যেনো অস্ট্রেলিয়ায় এসে মিটে গেছে। দুই দেশের খাবারই একই রেস্তোরায় সার্ভ করা হচ্ছে!
সাজ্জাদ আসার পর আমরা রেস্তোরার ভিতরে গেলাম। খুব একটি বিলাসী রেস্টুরেন্ট নয়, তবে খাবারের যেসব ছবি দেয়ালে পোস্টার করে সেঁটে রাখা হয়েছে সেগুলো বেশ টানছিল। কাউন্টারে বসেছিলেন, এক তরুণ। পাকিস্তানের বলে মনে হলো। টেবিলে বসতে সুন্দরী এক তরুণী ম্যানু নিয়ে আসলেন। ইংরেজীতে খাবারের অর্ডার নিলেন। বললেন, এটি পাকিস্তানী রেস্টুরেন্ট। সব খাবারই হালাল। আমরা চিকেন, গার্লিক নান, ভেজিটেবল, সালাদ নিলাম। পরে কফি দিতে বললাম।
খাবার সার্ভ হওয়ার পর মুখে দিয়ে বুঝলাম, স্বাদটা আমাদের দেশের মতোই, পুরনো। একটু ঝাল বাড়াতে বলেছিলাম, এমনভাবে বাড়িয়েছে যে বেশ খবর হচ্ছিলো। মুরগির টুকরোগুলোতে মশলা একেবারে ভিতর পর্যন্ত ঢুকে গেছে। নানটাও ভালো, বেশ নরোম, তবে মচমচে।
খাবার শেষে বিলটা দেয়ার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সাজ্জাদ এমন জোর করলো যে, জগতে কোন জামাই শ্বশুরের হাত এভাবে আগে কোনদিন চেপে ধরেছে কিনা কে জানে! আমরা গাড়িতে উঠলাম, শুরু হলো দক্ষিণমুখী যাত্রা। আমরা হাইওয়ে ধরে এগুতে লাগলাম। রাস্তায় এখন অনেক গাড়ি, দুইপাশে অসংখ্য ভবন। শহুরে আবহ। উঁচু ব্রিজ, বড় বড় ট্রাফিক সাইন চোখে পড়ছিল। নর্থ লেকস পেরোতে না পেরোতেই বুঝলাম ব্রিজবেন পৌঁছাতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
সানশাইন কোস্ট থেকে যাত্রা করে পথে খাওয়া দাওয়া করেও আমরা দুই ঘন্টার কম সময়ে ব্রিজবেন পৌঁছে গেলাম। ব্রিজবেন নদীর ওপর দিয়ে যাওয়া স্টোরি ব্রিজে উঠতেই পুরো শহরের দৃশ্য চোখের সামনে খেলা করে উঠলো। স্টিল স্ট্রাকচারের তৈরি শতবর্ষী ব্রিজটি ব্রিজবেনের আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। স্টোরি ব্রিজের বহু গল্প রয়েছে। তবে এই ব্রিজটি নিয়ে ব্রিজবেনবাসী বেশ গর্ব করে, যত্ন করে।
ব্রিজ পার হয়ে আমরা সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, অনেক মানুষজনও। গগনচুম্বী ভবন, নদীর দু’পাড় জুড়ে ভবনে ভবনে যেনো ছড়াচ্ছে নান্দনিকতা। নীল আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা। কী যে সুন্দর লাগছিলো ব্রিজবেন শহর!
আমরা ব্রিজবেন শহরের এ রাস্তা ও রাস্তায় ঘুরলাম। নানাকিছু দেখলাম। শেষে গিয়ে থামলাম ব্রিজবেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্টস্পট সাউথ ব্যাংক পার্কল্যান্ডসে, ব্রিজবেন নদীর পাড়ে। এখানেই রয়েছে ব্রিজবেন সাইন, যেখানে বিশালাকৃতির ইংরেজি হরফে নদীর পাড়ে লেখা রয়েছে ‘ব্রিজবেন’। রাতে যাওয়ার সময় এই ব্রিজবেনসাইনে এলইডি লাইটের আলো কী চমৎকারভাবেই না আমাকে টানছিল!
আমরা ব্রিজবেন সাইনের ওখানে নানাভাবে ছবি তুললাম, ঘুরলাম। এখানেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র কৃত্রিম বিচ। যেটি নদীর পাড়ে মানুষ তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়ায় হাজার হাজার বিচ থাকার পরও ব্রিজবেনে মানুষকে কেন কৃত্রিম বিচ বানাতে হলো কে জানে! মনে হলো, শহরকে সুন্দর করতে বিশেষ এই বিচ তৈরি করা হয়েছে। বিচটি যে মানুষই বালু এনে তৈরি করেছে তা বলে না দিলে আমি বুঝতে পারতাম না। একেবারে সাগরের বিচের মতোই, সাদা সাদা বালু, বিচজুড়ে চকচক করছে। বিচটি খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, বহু শিশু কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ বিচে বসে শহরের বুকে সাগরের পরশ অনুভব করছে। নদীর পাড়ে চমৎকার একটি ওয়াকওয়ে, গোলাপী রঙের ফুলে ফুলে পুরো ওয়াকওয়ে যেনো ছেয়ে আছে। কত বড় ওয়াকওয়ে! একবার এদিক থেকে ওদিকে গেলেই হাঁটার কাজ সেরে যাবে। শহরের বুকে নদীর পাড়ে এমন একটি ওয়াকওয়েও থাকা শহরবাসীর ভাগ্য বলতে হবে। কাছেই ‘দ্য হুইল অব ব্রিজবেন’। লন্ডন আই’র মতো। পুরো শহর ৩৬০ ডিগ্রিতে দেখার জন্য অনেকেই হুইল অব ব্রিজবেনে চড়েন। চাকাটি নিচ থেকে পর্যটক নিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে, উপরেরগুলো ক্রমে নিচে নেমে আসে। যারা উপরে উঠে যায় তারা ওখান থেকে শহর দেখে, দেখে শহরের চারদিক। আমাদের হাতে সময় না থাকায় চাকায় চড়লাম না। নিচের সবকিছুই ঘুরে ফিরে দেখছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো ছোট পরিসরের একটি বাগানেও ঘুরে দেখলাম। এটিও কী এখানে বানানো হয়েছে, নাকি আগে থেকে ছিল কে জানে!
আমরা যখন সেখানে ঘুরছিলাম, তখন সাজ্জাদ বললো, কাছেই একটি বিখ্যাত মিউজিয়াম আছে। কুইন্সল্যান্ড মিউজিয়াম কুরিল্পা নামের মিউজিয়ামটিতে ডাইনোসরসহ প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণীর কঙ্কাল থেকে শুরু করে কুইন্সল্যান্ডের জীববৈচিত্রের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য সাজিয়ে রাখা আছে। সাজ্জাদ বললো, আমরা আগে দেখেছি, কিন্তু আংকেলকে না দেখালে খারাপ লাগবে। সাংবাদিক মানুষ, নিশ্চয় পছন্দ করবেন।
আমি কোনকিছু না ভেবেই বলে বসলাম, দেখবো। মিউজিয়ামের পরতে পরতে যেভাবে পৃথিবীর অতীত সাজিয়ে রাখা হয়, ইতিহাস যেভাবে দেখানো হয় তা না দেখলে সত্যিকারভাবে একটি দেশ দেখা হয়ে উঠে না।আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। মিউজিয়ামের পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম নদীর পাড়ে হাঁটছে মানুষ, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ কফি হাতে বসে পড়েছে নদীর দিকে মুখ করে। কী অনাবিল এক সুখ যেনো চারদিকে।
মিউজিয়ামের প্রবেশপথে বড় অক্ষরে নাম লেখা রয়েছে, কুইন্সল্যান্ড মিউজিয়াম কুরিল্পা। দরজা ঠেলে ঢুকতেই ভিতর থেকে শীতল বাতাসের ধাক্কা, এসি মনে হয় একেবারে লো করে রাখা হয়েছে। টিকিট কাউন্টারের পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা গাইড আমাদের স্বাগত জানালেন। তিনি বললেন, ওয়েলকাম টু দ্য হোম অব ডাইনোসর। ডাইনোসরের বাড়ি, বলে কি ব্যাটা! আমি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে টিকেট কাউন্টারে গেলাম। সাজ্জাদ ছুটে এসে আমাদের জন্য টিকেট করে নিল। নির্দিষ্ট গেট পার হতেই প্রথমেই চোখে পড়ল এক বিশাল কঙ্কাল, ডাইনোসরের। একদম ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন এখনো জীবিত! প্ল্যাকার্ডে লেখা মাট্টাবুরাসরাস, অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ডাইনোসর। এই ডাইনোসরটি ছিল মধ্য জুরাসিক কিংবা প্রাথমিক ক্রেটাশিয়াস যুগের তৃণভোজী ডাইনোসর। কুইন্সল্যান্ডের মাট্টাবুরা শহরের পাশে থমসন নদীর তীরে এই ডাইনোসরের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছিল। তাই এটির নাম দেয়া হয়েছে মাট্টাবুরাসরাস। এটির জীবাশ্ম বিশ্লেষন করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ছিল, ওজন ছিল ৩ টনের মতো। পেছনের পায়ের তুলনায় সামনের পা দুটি ছোট। নাকের হাড় বেশ বড়। এই নাকের হাড়ই নাকি এই প্রজাতির ডাইনোসরকে অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য প্রজাতির ডাইনোসর থেকে আলাদা করেছে। মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখা কঙ্কাল দেখতেও ভয় লাগছিলো। বিশাল চোয়াল, শক্তিশালী পা, আর লম্বা লেজ দেখে মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ধেয়ে আসলো! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।












