দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২ মার্চ, ২০২২ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হুয়াংফু নদীর তীরে সিচুয়ান রেস্তোরাঁয় বসে আছি আমরা। খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছে। কিচেনে তৈরি হচ্ছে খাবার। আমাদের গ্রীণ টি দেয়া হয়েছে। কুসুম গরমের গ্রীণ টি দারুণ লাগছিল আমার। আয়েশী ভাবে আলতো চুমুক দিচ্ছিলাম। তবে আমার চোখ ছিল রেস্তোরার বাইরে। কাঁচের জানালায় চোখ রেখে বাইরের সাংহাই শহর দেখার ব্যর্থ চেষ্টা চলছিল। কতদূর আর দেখা যাবে, নদীর পরই আটকে যাচ্ছে দৃষ্টি। সুউচ্চ সব ভবন, টাওয়ার। এরমধ্যে সাংহাই টাওয়ার ক্ষণে ক্ষণে চোখে পড়ছে। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এবং বড় এই শহরটিতে ভবনের অভাব নেই, অভাব নেই জৌলুশের। কল্পনা যতদূর উড়তে পারে তার বাস্তব দৃশ্যপট রয়েছে সাংহাইর পরতে পরতে।
আমাদের খাবার সার্ভ শুরু হয়েছে। প্রথমেই স্যুপ দেয়া হলো। চিংড়ির লেজ দেখে বুঝতে পারলাম যে, সী ফুডের ক্লিয়ার স্যুপ। অতএব খেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া আমাদের দলপতি লায়ন ফজলে করিম একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। অতএব সমস্যা হবে না। চীনের খাবার-দাবারের ব্যাপারে বহু সমস্যার কথা শুনেছিলাম। তাই কিছুটা সতর্ক থাকা। অবশ্য লায়ন ফজলে করিম সাথে থাকায় শুরু থেকে আমি অনেকটা নির্ভার রয়েছি।
ক্লিয়ার স্যুপ বরাবরই আমার প্রিয় খাবারগুলোর একটি। থিক স্যুপ থেকে ক্লিয়ার স্যুপই আমার বেশি পছন্দের। এখানে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো ব্যাপার ঘটে গেল। খাবার নিয়ে যখন ভিতরে ভিতরে আমি কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন তখন একেবারে নির্ভেজাল ক্লিয়ার স্যুপ আমাকে বেশ আনন্দিত করলো। স্যুপ মুখে দিয়ে তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের দলের কেউ কেউ ‘উঁহ-আহ’ শুরু করলেও বেশ সুখ সুখ লাগছিল আমার। দারুণ ঝাল। এমন ঝাল না হলে কি জমে! চামুচে চামুচে চুমুকে চুমুকে আমার তৃপ্তি যেন হুয়াংফু নদীর মতো বয়ে যাচ্ছিল।
হুয়াংফু নদীর পাড়েই বসে আছি আমরা, রেস্টুরেন্টে। জানালার কাচ দিয়ে দেখা যাচ্ছে নদী। কী অনাবিল স্রোতধারা বয়ে যাচ্ছে! পূর্ব চীনের এই নদী প্রায় ১১৩৪ কিলোমিটার লম্বা। নদীর দু’পাড়েই সাংহাই, বিশ্বের অন্যতম বড় এবং অতি বসতির মেগাসিটি। শুধু কী মেগাসিটি? সাংহাই তো রীতিমতো সুপার মেগাসিটি। তিন কোটির কাছাকাছি মানুষ বসবাস করে বিশ্বের অন্যতম বড় এই শহরে। আর হুয়াংফু নদী এই শহরটিকে যেন পলি দিয়ে উর্বরতা দান করে চলেছে।
জমকালো আয়োজনে লাঞ্চ সারলাম আমরা। ঝাল নিয়ে কারো কারো কিছুটা আপত্তি থাকলেও চরম তৃপ্ত সকলে। ক্ষুধা যতটুকু ছিল তার থেকে ঢের বেশি ছিল আগ্রহ। দেশে চীনা খাবারের জন্য হুড়োপুটি খাওয়া অনেকেই চীনে এসে নাকি খাবার খেতে পারেন না। তবে আমরা সিচুয়ান ফুড খেয়ে এমন কোন অস্বস্তি টের পেলাম না। ডেজার্ট হিসেবে বিন্নি চালের ভাতের মতো এক ধরনের ভাতের সাথে দুধের মিশেলে কি একটা যেন খেলাম। তাও অসাধারণ টেস্টি। থাইল্যান্ডে একবার ‘থিক রাইস উইথ ম্যাঙ্গো’ খেয়েছিলাম। চীনা রেস্টুরেন্টের এই খাবারটিও অনেকটি তেমনই, স্বাদও কাছাকাছি। তবে থাইল্যান্ডে চাক চাক আম থাকলেও এখানে আম ছিল না। খাবারটির কী যেন একটি নাম বলেছিল সুন্দরী ওয়েটার। রূপসীর চ্যাপ্টা নাকের রূপ দেখতে দেখতে খাবারটির নামই ভুলে গেছি! দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কেটে গেছে আমাদের। পথ থেকে পথে ছুটে চলার মাঝেও যে একটি আনন্দ আছে তা বেশ টের পেতে শুরু করেছি। এত ঘোরাঘুরির পরও নিজেদের বেশ চাঙ্গা লাগছিল। মন মেজাজ সবই ফুরফুরে। আমরা কি করবো, কোথায় যাবো, কিভাবে বাকি সময়টাকে আরো অনেক বেশি উপভোগ্য করবো তা নিয়ে এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে শুরু করেছেন লায়ন ফজলে করিম। বিশেষ করে আমরা কী এখনই হোটেলের পথ ধরবো, নাকি সাংহাই শহরের অলি গলিতে কিছুক্ষণ চষে বেড়াবো তা তিনি ঠিক করতে পারছিলেন না। হোটেল বহু দূরে। যেতেও অনেক সময় লাগবে। তাই পথে না নামলে হোটেলে পৌঁছতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যাবে। আবার এখনই হোটেলের পথ ধরলে সাংহাইর অপরূপ সুধা অধরা থেকে যাবে। ঘুমানোর বা আয়েশ করার কোন তাড়া ছিল না আমার, আমাদের। এতে করে হোটেলের চেয়ে সাংহাই শহরের অলি গলি কিংবা হুয়াংফু নদী আমাদের সকলেই বেশি টানছিল। অতএব আমরা সাংহাই শহর চষে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত নামার আগে যতটুকু দেখা যায়!
নদীর পাড়ে চমৎকার একটি বাগান। চমৎকার মানে দর্শনার্থী বান্ধব। হাঁটার, বসার এবং আড্ডা মারার নানা আয়োজন পার্ক জুড়ে। সবুজে সবুুজে একাকার! দারুণ সব গাছগাছালী পার্কে, দেশি বিদেশী গাছ। বিদেশী বললাম এই কারণে যে, এসব গাছ বিশ্বের নানা দেশে দেখেছি। গাছগুলোকে চাইনিজ বলে মনে হয়নি। দুর্বাঘাষ কী চাইনীজ? কে জানে, তবে পার্কের ওয়াকওয়েতে প্রচুর দুর্বাঘাস দেখা গেল। সিরামিক টাইপের ইটও বিছানো রয়েছে রাস্তায়। পাথরের বেঞ্চিও স্থাপন করা হয়েছে নানা পয়েন্টে। ইচ্ছে করলে হাঁটুন, ইচ্ছে করলে বসুন। দিগন্তে চোখ রাখুন, মন ভরিয়ে দেয়ার নানা আয়োজন চারদিকে। নদীর অপর পাড়ে সাংহাই টাওয়ারসহ নানা কিছু। সুউচ্চ এক একটি ভবন যেন হাতছানি দিচ্ছে। হুয়াংফু নদীর পাড় থেকে সাংহাই টাওয়ারসহ শহরের চমৎকার দৃশ্যপট দেখার ১৫টি পয়েন্ট রয়েছে। পার্কের মাঝ থেকে নদীর অপর পাড়ে দেখা মিলে দারুণ সুন্দর সাংহাই টাউন। আমরা একটি পয়েন্ট থেকে সাংহাই দেখলাম, ছবি তুললাম।
ব্যাগ ব্যাগেজ সব গাড়িতে রেখে পথে নেমেছিলাম আমরা। ঝাড়া হা পা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। পার্কের বেঞ্চিতে না বসে হাঁটছিলাম আমরা। অনেকক্ষণ ধরে নদীর পাড়ে পার্কে পার্কে ঘুরলাম। অসংখ্য নারী পুরুষ ও শিশু পার্কে। কত ধরনের আনন্দের মাঝে যে তারা সময় পার করছে! আনন্দের সাথে অর্থের একটি সম্পর্ক আছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে সাধারণ মানুষের আয় রোজগারও অনেক। শ্রমিকের মজুরীও বেশি। মাথাপিছু আয় প্রায় ১২ হাজার ডলার। এতে করে একজন সাধারণ শ্রমিকও নিজেকে আনন্দে রাখার প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করতে পারেন। রাষ্ট্র থেকেও নাগরিকদের আনন্দে রাখার নানা আয়োজন যত্র তত্র করে রাখা হয়েছে।
হুয়াংফু নদীর চরিত্র কেমন তা জানি না। তবে আপাতদৃষ্টিতে বেশ শান্ত মনে হচ্ছিল। নদীর বুক জুড়ে ভাসছে বেশ কয়েকটি ক্রুজিং ভ্যাসেল। এসব ভ্যাসেলে নাকি রাতের বেলা তৈরি হয় এক রঙিন দুনিয়া। নদীর বুকে তৈরি হয় ভিন্ন আবহ। জাহাজে জাহাজে তৈরি হয় আলো আঁধারী পরিবেশ। হরেক রকমের পানীয়ের সাথে বেলি ড্যান্স, পপ ড্যান্স কিংবা নানা চাইনিজ নাচে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন অনেকেই। জাহাজের ডেকেই হরেক রকমের বিনোদনের পসরা মেলে, ঝড় উঠে কেবিনে। অগুনতি ক্রজিং ভ্যাসেল নদীর বুকে সুখের পায়রা হয়ে ডানা মেলে।
হুয়াংফু নদীর পাড়ে ক্রুজিং ভ্যাসেলের দিকে তাকিয়ে আমার পরাণটি হু হু করে উঠলো। এই ভ্যাসেল শুধু সাংহাইর হুয়াংফুতে নয়, পৃথিবীর দেশে দেশে নদীতে নদীতে এমন ক্রুজিং ভ্যাসেলের আনাগোনা রয়েছে। মরুর দেশ দুবাই আবুধাবীতে কৃত্রিম নদী বানিয়ে তাতেই ঝড় তোলে এই ধরনের ভ্যাসেল। থাইল্যান্ডে খালের মতো সরু একটি নদীতে যেভাবে ক্রুজিং ভ্যাসেলের আনাগোনা চলে তা অনেকেরই জীবন ভরিয়ে তোলে। মিশনের নীল নদের ক্রজিং ভ্যাসেলের বেলি ড্যান্স দেখতে যেভাবে হাজার হাজার পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাতে অর্থনীতির চাকায়ও ঝড় উঠে।
আহা, পৃথিবীর অভাগা নদীগুলোর একটি হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। যেখানে রাতের বেলা চোরাকারবারীদের উৎপাত চলে। তেল চোরদের দাপটে অসহায় বোধ করেন অনেকেই। রাতের আঁধারে কর্ণফুলী নদীতে তেল চুরি করে, তেল পাচার করেও শহর দাবড়ে বেড়ায় অনেকেই। শুধু কী তেল চুরি! কত ধরনের অপকর্ম যে নদীর বুকে চলে তার কী ইয়ত্তা আছে! শুধু চোরাকারবারিই নয়, নদী খেকোদের দখলদারিত্বও চলছে বহুদিন ধরে। অথচ কর্ণফুলীর মতো একটি নদীকে পুঁজি করে প্রতি রাতে কোটি ডলারের বাণিজ্য চলে সাংহাইতে। সাংহাই শহরের অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে কর্ণফুলীর জন্য আমার প্রাণটি কেবলই যেন আকুলি বিকুলি করছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডায়াবেটিসের জরুরি অবস্থা হাইপো গ্লাইসেমিয়া
পরবর্তী নিবন্ধভাইরাস -এর সাথে বসবাস