দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২ জুলাই, ২০২৫ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসে ভিসার আবেদন করতে পেরে মনটি কিছুটা হালকা হলো। ভিসা দেবে কি দেবে না, সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে আমি যে করতে পারলাম, সেটাই সান্ত্বনা। তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর যাত্রা নিয়েও কিছুক্ষণ ভাবলাম। আগে একটি ভিসার জন্য কত দৌড়ঝাঁপ করতে হতো! অথচ এখন বিমানবন্দরে বসেই ভিসার আবেদন করা সম্ভব হচ্ছে! তথ্য প্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রা বছর কয়েক আগেও অকল্পনীয় ছিল। অবশ্য হংকং ভ্রমণে একসময় ভিসারই প্রয়োজন হতো না, হতো না আরো অনেক দেশ ঘুরতে। আমাদের বাপ চাচারা রেঙ্গুনে গিয়ে ব্যবসা করেছেন, চাকরি করেছেন, কেউ কেউ রেঙ্গুনের রঙিলাকেও বগলদাবা করে নিয়ে এসেছেন, কেউ কেউ কাঁদিয়ে বেঁচেছেন। অথচ পাসপোর্ট ভিসার কোন ব্যাপার ছিল না। আর এখন সেই মিয়ানমারের ভিসার জন্য কত কিছুই না আমাকে জমা দিতে হয়েছিল!

আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসছিল। মনিটরে দেখলাম যে, ফ্লাইট সিডিউল ঠিকঠাক আছে। কোন গেট থেকে আমাদের বিমানে চড়তে হবে তার নম্বর বোর্ডিং কার্ডে দেয়া আছে। আমি লায়ন ফজলে করিম ভাই, ডালিয়া ভাবী, লায়ন বিজয় শেখর দা’সহ নির্দিষ্ট গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কাছের গেটটির নম্বর খেয়াল করে দেখলাম যে, আমাদের গেটটি পেতে বেশ কিছুদূর হাঁটতে হবে!

বিশাল এয়ারপোর্ট, দারুণ সব আয়োজন পরতে পরতে। আলোকোজ্জ্বল, তকতকে ঝকঝকে চারদিক। মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো একটি আবহ। অনেক দোকান। থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। বিকিকিনি চলছে দেদারসে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান দেখে ঢুঁ মারতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সময় কমিয়ে আসায় লোভ সামলে নিলাম। কফির গন্ধ মৌ মৌ করছিল, কিন্তু ওদিকে আর এগুলাম না। মানুষ ছুটছে, কেউ কেউ দৌড়ের উপর রয়েছেন। কাউকে আবার ব্যাটারিচালিত বিশেষ ধরনের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার কেউ কেউ সোফায় কিংবা চেয়ারে বসে অলস ঝিমুচ্ছে। বড়ি ম্যাসেসের মেশিনে বসেও কেউ কেউ সময় কাটাচ্ছে।

আমার ভেতরে একধরনের রোমাঞ্চ কাজ করছিল। বহুদিনের স্বপ্নের দেশে প্রথমবারের মতো যাচ্ছি। এই রোমাঞ্চ আসলেই একটু অন্যরকম। আমার বাড়তি রোমাঞ্চের অন্য একটি কারণও রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ভ্রমণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সাত মহাদেশেই পা ফেলতে যাচ্ছি আমি। যা আমার এক জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি বলেও মনে হচ্ছিলো।

একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চোর ডাকাতদের নির্বাসনের স্থান অস্ট্রেলিয়া যে দিনে দিনে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা বিস্ময়কর। একটি দেশ আস্ত একটি মহাদেশ। সাগর মহাসাগর বেষ্টিত দেশটিতে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো বৈচিত্র্য।

অনেকদিন ধরে অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে টুকটাক খবরাখবর রাখলেও ভ্রমণ পরিকল্পনার পর দেশটি সম্পর্কে বেশ কিছু লেখাপড়া করি। আর দেশটির নানা বিষয়ে পড়তে গিয়ে বার বার রোমাঞ্চিত হয়েছি। আজ সেই বৈচিত্র্যময় ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দেশটিতে সশরীরে যাচ্ছি। কী যে ভালো লাগছে।

যতটুকু জেনেছি, মহাদেশটির ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। বহু বহু বছর আগে এই মহাদেশটিতে অ্যাবরিজিনাল ও টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারদের বসবাস শুরু হয়। যারা দেশটির আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে টিকে রয়েছে। তারা নিজেদের ভাষা, কাহিনি, শিল্প ও আচারঅনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তোলে, যা পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত সংস্কৃতিগুলোর একটি।

আধুনিক যে অস্ট্রেলিয়া তার গোড়াপত্তন শুরু হয় মূলত ১৭৭০ সালে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বিপদসংকুল, দুর্দান্ত আর রহস্যময় এক অভিযাত্রার ফসল আজকের বর্ণিল অস্ট্রেলিয়া। দুর্দান্ত এক অভিযাত্রী ছিলেন ব্রিটিশ নৌঅফিসার ক্যাপ্টেন জেমস কুক। ১৭৬৮ সালের কোন এক সুন্দর সকালে তিনি যাত্রা করলেন এক বিশাল সমুদ্রযাত্রায়। তার জাহাজের নাম ছিল এইচএমএস এন্ডেভোর। জাহাজটিতে নাবিক ছিলেন ৯৪ জন। এদের মধ্যে সৈন্য, বৈজ্ঞানিক, শিল্পী ছিলেন। ক্যাপ্টেন কুকের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের টেরা অস্ট্রালিস নামের কল্পিত এক মহাদেশ জয় করা। কিন্তু ১৭৭০ সালের এপ্রিল মাসে জাহাজটি এসে পৌঁছালো এক অজানা উপকূলে, যেখানে নীল জলরাশি ছুঁয়ে আছে শান্ত সবুজ বনভূমি। কিন্তু পথিমধ্যে নানা অসুস্থতায় কুকের সফরসঙ্গীদের অন্তত ৩০ জন মারা যান। যাদের লাশ ফেলে দেয়া হয় সাগরে।

নতুন কুল পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন নাবিকেরা। পানিতে ভাসতে ভাসতে তারা এক অবর্ণনীয় অবস্থার মধ্যে ছিলেন। সাথীদের মৃত্যুতে তারা ছিলেন ব্যথিত। নানা ধরনের অসুস্থতায় কেউ কেউ ছিলেন একেবারে কাবু। তাদের কেউ খুঁজছেন নতুন উপকূল, কেউবা অজানা উদ্ভিদের নমুনা, কেউ আঁকছেন পৃথিবীর নতুন মুখ। কুকের জাহাজ যখন উপকুলে ভিড়লো তখন কুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেশ কয়েকজন আদিবাসী। যাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল বর্শা, লক্ষ্য ছিল কুকের জাহাজ। কুক তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়ালেন না। তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাহাজটিকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে নিয়ে সাগরে নোঙর করলেন। পরবর্তীতে আদিবাসীদের সাথে ইশারা ভাষায় সমঝোতার মতো করা হয়। কুকের জাহাজ কুলে ভিড়ে। এই ঘটনাকে অনেকে বলেন ‘শান্তিপূর্ণ প্রথম সাক্ষাৎ’। কিন্তু পরবর্তী উপনিবেশ স্থাপনের ফলে এই আদিবাসীদের জীবন ব্রিটিশেরা দুর্বিষহ করে তোলে। তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃসহ কালো অধ্যায়।

কুক যে জায়গাটিতে প্রথম কুলের নাগাল পেয়েছিলেন সেটির নাম দেন বোটানিবে। কারণ কুকের সঙ্গে থাকা উদ্ভিদবিদ জোসেফ ব্যাংকস ও ড্যানিয়েল সল্যান্ডার ওখানে অজস্র অজানা গাছপালা খুঁজে পেয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন কুকের ওই কুল পাওয়ায় শুধু গাছপালাই নয়, পরবর্তীতে ইউরোপীয় বিশ্বের কাছে অস্ট্রেলিয়ার দরজা খুলে দেয়। তিনি এই অঞ্চলের নাম দেন নিউ সাউথ ওয়েলস, তিনি সেটিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত করেন। অস্ট্রেলিয়ার রাজপথ থেকে অলি গলি সর্বত্রই আজো ব্রিটিশের জয়জয়কার। রাস্তা ঘাটের নামেও ব্রিটিশ প্রাধাণ্য।

কুক ১৭৭১ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যান, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া পথচিহ্ন আজও অস্ট্রেলিয়ার মানচিত্রে স্পষ্ট। সেই বোটানিবে আজ একটি আধুনিক উপশহর, আর সেই এন্ডেভোর জাহাজের প্রতিকৃতি জায়গা পেয়েছে জাদুঘরে। জাহাজটির নোঙর পরিণত হয়েছে পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় পণ্যে।

১৭৮৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসে প্রথম ব্রিটিশ বন্দি উপনিবেশ স্থাপন করা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের দাগী আসামী, চোর, ডাকাত, আন্দোলনকারীদের এনে রাখা হয় এখানে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পুরো মহাদেশে ইউরোপীয়দের বসতি বিস্তার লাভ করে। একই সাথে দিনে দিনে বাড়তে থাকে আদিবাসী নিপীড়ন। সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয় আদিবাসীরা। কিন্তু ততদিনে শক্তিশালী ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আর আদিবাসীদের বর্শায় ছিল না। কেউ কেউ এমনও বলেন যে, যদি ১৭৭০ সালের ক্যাপ্টেন কুকের জাহাজটিকে আদিবাসীরা কুলে ভিড়তে না দিতো, কিংবা তাদের সাথে খাতিরে না জড়াতো তাহলে আদিবাসীদের ভাগ্যবিপর্যয় এতো নির্মম হতো না। তবে কুকের ওই জাহাজ গন্তব্য ভুলে অস্ট্রেলিয়ার উপকুলে না পৌঁছালে হয়তো আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার দেখাও বিশ্ব পেতো না। এগুলো যদি, কিন্তুর ব্যাপার। বাস্তবে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের অনন্য একটি দেশ। ধনে জনে সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির প্রকৃতি এবং পর্যটন চলছে হাত ধরাধরি করে। আর অস্ট্রেলিয়ার এই নতুন পথের জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯০১ সালে। ওই বছর ছয়টি কলোনি একত্রিত হয়ে অস্ট্রেলিয়ান কমনওয়েলথ গঠন করে। দেশটি তখন থেকে একটি স্বায়ত্তশাসিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশটি অভিবাসীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়া থেকে প্রচুর অভিবাসী দেশটিতে ভিড় করে। এর ফলে অস্ট্রেলিয়ায় গড়ে ওঠে একটি বহুজাতিক সমাজ। যেখানে শুধু আদিবাসী বা ব্রিটিশ নয়, তাবত দুনিয়ার নানা সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করেন। যারা অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতিকে শুধু সমৃদ্ধই নয়, বর্ণিলও করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতি অসাধারণ, সাগর মহাসাগর এবং দশ হাজারের কাছাকাছি দ্বীপের এক অনন্য জনপদ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বিচ রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার। গুগল বলছে, অস্ট্রেলিয়ার বিচের সংখ্যা ১০ হাজার ৬৮৫টি। প্রতিদিন একটি করে বিচে ঘুরলেও সব বিচ ঘুরে শেষ করে একজন মানুষের ২৯ বছর লাগবে! একটি দেশের এতোগুলো বিচ থাকে! একটি দেশের পর্যটনকে এসব বিচ কী পরিমাণ সমৃদ্ধ করেছে! বর্তমান অস্ট্রেলিয়া উন্নয়ন, বহুত্ববাদ ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করছে। তবুও আদিবাসীদের বৈষম্যের শিকারের অভিযোগ থেকে দেশটির নিস্তার মিলেনি। যাক, বিষয়গুলো নিজের চোখে দেখা হবে, বিচে বিচে ঘোরা হবে, পাহাড়ে কিংবা দ্বীপ চষে বেড়ানো হবে। এসব নিয়ে অনেক গল্পও হবে। আপাতত মেলবোর্নের ফ্লাইট ধরার জন্য নির্দিষ্ট গেটের দিকে হাঁটছিলাম হংকং বিমানবন্দরে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধঅন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা-ভাবনা