(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সকালে ব্যুফে ব্রেকফাস্টে খাবারের আয়োজন দেখে চোখ কপালে উঠার উপক্রম হলো। কাচঘেরা রেস্তোরাঁয় বন্য পশু পাখীর সাথে ব্রেকফাস্ট! কাচের বাইরে হেলে দুলে হাঁটছে হরিণ, বক, ময়ুর, রঙিন হাঁস। কখনো তারা আড়চোখে কাচের ভিতরে আমাদের দেখছে, কখনো বা নিজেদের মতো করে আয়েশ করছে। নিজেরা ঝগড়াঝাটি থেকে খুনসুটি সবই করছে। কত আয়োজনে যে নাস্তা করা যায় তা ছয়–তারকা হোটেলটি আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে। কত রকমের খাবার যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তবে খাবারের চেয়ে হোটেলটির প্রকৃতিপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। বনের ভিতরে এতো নান্দনিক একটি স্থাপনা গড়ে তোলা হলেও বনের কোন ক্ষতি করা হয়নি। পাহাড়কে পাহাড়ের আদলে রেখে, শত বর্ষী গাছগুলোকে অক্ষয় রেখে তারা নির্মাণ করেছে বহুতল ভবন। আবার এই বহুতল মানে একেবারে আকাশ ছোঁয়া নয়, ছয় তলা–সাত তলা উচ্চতা। রিসোর্টটিতে নাকি রুম রয়েছে দেড় হাজারের মতো। চীনা পরিমাপের প্রায় ৫ হাজার মিউ বা আমাদের ৮২০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা রিসোর্টটি থীম পার্ক, ওয়াটার পার্কসহ আধুনিক বিনোদনের নানা কিছু রয়েছে।
৮২০ একর মানে কতটুকু জায়গা মনে মনে তার হিসেব কষলাম। পুরো একটি গ্রাম! আস্ত একটি গ্রাম নিয়ে গড়ে তোলা চাইম লং রিসোর্ট! নাস্তা সেরে রুমে ফিরলাম। ফেরার পথে কিছুটা ঘুরপথে রিসোর্টটি দেখে আসলাম। কোথাও খাল, খালের উপর পাথরের সাকু, কোথাও ঝুলন্ত ব্রিজ! পাহাড় থেকে ঢালু করে পথ নামানো হয়েছে, কিংবা পাহাড়ে পথ তুলে দেয়া হয়েছে। দুইপাশে গাছ গাছালী। সাপের আনাগোনা কেমন আছে কে জানে!
লায়ন ফজলে করিম ভাই সুইমিং পুলে যাওয়ার তাগাদা দিলেন। এমন বনের ভিতরও সুইমিং পুল! নিশ্চয় মন্দ হবে না। তৈরি হয়ে পুলের পথ ধরলাম।
সুইমিংপুলটি নিচে। লবি থেকে এ্যারো দিয়ে মার্কিং করা আছে। রিসোর্টের মুল ভবনের পেছনে বিশালাকৃতির সুইমিং পুল, বেশ সুন্দর। বনের ভিতরে স্বচ্ছ নীল জলরাশির যেনো ছোটখাটো একটি সমুদ্দর! দু’পাশ একটু বাঁকানো। বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু কিশোরদের জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এদের ওয়াটার পার্ক আসলেই অনন্য। সেখানে শিশু কিশোরদের আয়োজনের আধিক্য অন্য সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে।
আমি পুলে নেমে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটার পর করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী আসলেন। ভাবী পুলে নামবেন না, করিম ভাই ঝাঁপ দিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুল ভর্তি নারী পুরুষ। অসংখ্য তরুণ তরুণী। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে সুইমিং করছে, কেউবা করছে জলকেলি।
অনেকক্ষন পুলে ডুবলাম, ভিজলাম, সাঁতার কাটলাম। কিছুটা ঠান্ডাও লাগলো। চা, কফি কিংবা গরম শরবত হলেও খাওয়ার জন্য পরাণটি আনচান করছিল। করিম ভাইয়ের অবস্থাও আমার মতো। তিনি এখন আর ‘নায় চা’ নিয়ে ব্যস্ত নয়, গরম কিছু হলেই যেনো চলে—!
পুলে নামা অতিথিদের সেবাযত্নের কমতি নেই। সব আয়োজনই ধারে কাছে রয়েছে। পুল থেকে উঠে হাত বাড়াতেই বিশাল বিশাল তোয়ালে পেয়ে গেলাম। চীনা সুন্দরীরা তোয়ালের যোগান দিচ্ছেন। পাশেই শাওয়ার রুম। সেখানে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দেখি করিম ভাই কফি যোগাড় করিয়ে ফেলেছেন। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো, জীবনটি আসলেই অনেক সুন্দর!
এই হোটেলরই মালিকানাধীন ওয়াটার পার্ক রয়েছে। যেখানে হোটেলের অতিথিদের পাশাপাশি বাইরেরও প্রচুর লোকজন বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাতে আসেন। চাইম লং রিসোর্টের ওয়াটার পার্ক চীনের পর্যটকদের নিকটও নাকি বেশ জনপ্রিয়। শুধু গোয়াংজু নয়, চীনের দূর–দূরান্ত থেকেও বহু পর্যটক পরিবার পরিজন নিয়ে অবসর কাটাতে এই বিনোদন কেন্দ্রে ভিড় করেন। আমি হোটেলটির অতিথিদের দেখে বুঝতে পারছিলাম যে, এটিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের লোকজন যত আসে তার থেকে ঢের বেশি রয়েছে স্থানীয় অতিথি। এটিকে একটি শুভলক্ষন বলে মনে হলো আমার। বিদেশী নির্ভরতা কম থাকায় এমন কোটি কোটি ডলারের বিনিয়োগও ঝুঁকিমুক্ত। স্থানীয়রাই এই বিনিয়োগকে রক্ষা করবে। বিদেশী নির্ভরশীল হলে এই প্রজেক্ট বহু আগেই লালবাতি জ্বালাতে হতো। দৈনিক কত কোটি টাকা খরচ এই রিসোর্টের! কোনভাবেই হিসেব করতে পারলাম না।
এমন বিখ্যাত একটি হোটেলে এনে রাখবার জন্য জ্যাক কোম্পানিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম। ছয় তারকা হোটেলের নাম আগে শুনলেও এর আগে কোনদিন ছিলাম না। সিঙ–স্টার হোটেলে নিশিযাপন তো আমাদের মতো চুনোপুটির জন্য একেবারে সহজ ব্যাপার না!
রুমে ফিরে আসলাম। রুমে ফেরা মানেই তো সেই বনবনানী এবং পাহাড়ি পথ ধরে এলোমেলো হাঁটা। কত পথ যে মাড়ালাম! রুমে ফিরে আমি আবারো কফিমেকার চালিয়ে দিলাম। করিম ভাইর কফি’টা ঠান্ডার মধ্যে দারণ লেগেছে, তবে আয়েশ করে খাওয়ার যে তৃপ্তি তা দেয়নি। কফি বানিয়ে জানালার পর্দা পুরোপুরি সরিয়ে দিলাম। চোখের সামনে খলখল করে উঠলো প্রকৃতি। হোটেলের পাশেই ছোটখাটো একটি পাহাড়, ঠিক আমার জানালার কয়েকশ’ গজ পরেই। আর এই কয়েকশ’ গজ জমি জুড়ে রয়েছে শত সহস্ত্র গাছ। শতবর্ষী গাছও মনে হলো আছে। পাহাড়ের ঢালুর পুরোটাই গাছ গাছালী। হোটেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় পুরানো গাছের সাথে নতুন নতুন সব গাছ লাগিয়েছে। গাছে গাছে খেলা করছে রকমারি পাখি। কোনটিরই নাম জানি না। তবে আমাদের দোয়েল–কোয়েলের মতো অসংখ্য পাখির উড়াউড়ি মন ভরিয়ে দিল।
হিল ভিউ রুমের ডিভাইনে হেলান দিয়ে পাখির কলকাকলীর মাঝে কফির মগে চুমুক দেয়ার তৃপ্তি একটু অন্যরকম। কফি খেতে খেতে আমি কখনো পাখি কখনোবা গাছ গুনছিলাম। কিন্তু বনের ভিতরে এই কাজটি যে কত কঠিন তা বেশ টের পেলাম। গাছ এবং পাখি গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
টেলিফোনে ঘুম ভাঙ্গলো। টের পেলাম যে, বিছানায় না গিয়ে আমি ডিভাইনে ঘুমিয়ে গেছি, অর্ধেক মগ কফি ডিভাইনের পাশে পড়ে আছে। আহারে এতো কষ্ট করে বানানো কফি না খেয়ে ফেলে রেখেছি। ফ্রেশ হয়ে এসে কফির মগে চুমুক দিলাম। কোল্ড কফি, খারাপ লাগলো না। ফোন দিয়ে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছেন লায়ন ফজলে করিম ভাই। লাঞ্চে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিয়েছেন তিনি। বললেন, সূর্য, শাসা ফ্রেঞ্চিসহ সবাই হোয়াইট টাইগার রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছেন।
সূর্য? সূর্য কি এসে পৌঁছেছে? সূর্য হচ্ছে লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের ছোট ছেলে। সে বেইজিং লেখাপড়া করে। মা–বাবার সাথে দেখার কথা জন্য সূর্য বেইজিং থেকে দুই হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে গুয়াংজু এসেছে। এখানে দুই–তিনদিন মাবাবার সাথে থেকে আবারো বেইজিং ফিরে যাবে।
এ্যারো মার্ক দেখে দেখে আমি হোয়াইট টাইগার রেস্টুরেন্টে গেলাম। নিচতলায় রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে প্রবেশের আগেই বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণীর ছবিসহ নানা কিছুতে ভর্তি দেয়াল। আছে গাছ–গাছালীর ছবিও। রেস্টুরেন্টে ঢুকে আমাদের সকলকেই পেয়ে গেলাম। সূর্য এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। বন্ধুর ছেলে হলেও দীর্ঘদিনের পারিবারিক সুসম্পর্কের কারণে ধ্রুব বা সূর্যকে নিজের সন্তানের মতোই লাগে। হোয়াইট টাইগার রেস্টুরেন্ট নামটি দেখে আমি খুব বেশি আশ্চর্য হয়নি। চারদিকে যেহারে প্রকৃতিকে সম্মান জানানো হয়েছে তাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের সবচেয়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টটির নাম এমন রাখতেই পারেন। রেস্টুরেন্টের প্রবেশমুখের একপাশে পাথরের বাঘ ও হরিণের ভাস্কর্য, অন্যপাশে খাঁচাবিহীন বক। আশ্চর্যের বিষয়, বড় বড় সাদা বকগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে, অথচ তারা ওড়ার চেষ্টা করছে না!
ব্যুফে লাঞ্চ। তাই যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমি সূর্যকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম। কারণ সূর্য বহু বছর ধরে চীনে লেখাপড়া এবং বসবাস করছে। সুতরাং চীনা খাবারের ব্যাপারে তার উপর চোখ বন্ধ করে আস্থা রাখা চলে।
চারজনের একটি টেবিলে বসে খাবার শুরু করলাম। বিপরীত পাশটাতে করিম ভাই ভাবীকে নিয়ে বসতে পারবেন। সূর্য আমার পাশের চেয়ারটায়। তবে তারা কেউ তখনো ফিরে নি। আম কাচের পাশে বসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মুখে খাবার পুরলাম। কিন্তু খাবার আর নিচের দিকে নামছিল না। আমার মুখ হা হয়ে গিয়েছিল। কামড় দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
কাচের ওপাশে দুইটি সাদা বাঘ আরাম করে বসে আছে! একজন হাই তুলছে, অন্যজন তখনো হাড় চিবোচ্ছে! মনে হলো, চীনারা তো কৃত্রিমতা তৈরিতে ওস্তাদ, তবে কি এগুলোও কোনো কৃত্রিম বাঘ? এমন আস্ত বাঘ বানানো কি সম্ভব! আমি খাবারের কথা ভুলে গিয়ে বাঘগুলোকে চিন্তা করতে লাগলাম। অনেকভাবে সেগুলোকে দেখলাম। কিন্তু না! এগুলো কৃত্রিম নয়, একেবারে আসল বাঘ। একটু পরে দেখি, তারা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে, বাঘের খুনসুটি!
চোখের সামনে জ্যান্ত বাঘ, মানুষ খাওয়া ভুলে বাঘের ছবি তুলতে লাগলো। ব্যাপারটি এমন যে, খাঁচাবন্দী মানুষ, আর উন্মুক্ত বাঘ। যেনো বাঘই চিড়িয়াখানায় মানুষ দেখতে এসেছে। কাচের এপারে এতো মানুষ দেখে হঠাৎই কাচের ওপর থাবা দিয়ে দিল একটি বাঘ। কাচটি ভাঙলো না, কিন্তু মনে হলো, আমার বুকটি অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। আজ যদি কাচটা ভেঙে যেত, তাহলে আমিই হয়তো বাঘের লাঞ্চ হয়ে যেতাম! দ্রুত জানালার পাশ থেকে রেস্টুরেন্টের মাঝখানে দিকের একটি টেবিলে চলে গেলাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।