(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘামে গরমে কাহিল হয়ে তাইজুর সাউথ গ্রেট ওয়ালের দীর্ঘপথ পাড়ি দিচ্ছিলাম আমরা। দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে হেঁটেছি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেও তা খুব বেশি প্রভাব ফেলছিল বলে মনে হচ্ছিলো না। ফিনিশিং পয়েন্টের কাছাকাছিতে পৌঁছে মনে হলো পরাণে পানি আসতে শুরু করেছে। ঘুরপথ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। দর্শনার্থীরা ওয়াল ঘুরে যেখানে নেমে সমতলের নাগাল পান ঠিক তার পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি সমৃদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র। অনেকগুলো দোকান, সবগুলোতে পণ্যে ঠাসা। নানা ধরনের চীনা পণ্যের পাশাপাশি রকমারি খাবার বিক্রি হচ্ছিলো দোকানগুলোতে। অধিকাংশই স্থানীয় খাবার। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছিল স্যুভেনির। হরেক রকমের স্যুভেনিরের পসরা দোকানে দোকানে। সাউথ গ্রেট ওয়ালের মিনি সংস্করণ দিয়ে তৈরি স্যুভেনিরের কদর সবচেয়ে বেশি। চীনার হাত পাখা থেকে শুরু করে ছোট ছোট ছাতাও বেশ জমিয়ে বিক্রি হচ্ছিলো।
খাবারের দোকানগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেও খাওয়ার সাহস হলো না। কি না কী বিক্রি করছে কে জানে! তাছাড়া আমরা হোটেলে ফিরে লাঞ্চ করবো। তাই এখানের খাবারের প্রতি বিশেষ কোন আগ্রহ দেখালাম না। তবে একটি দোকানে প্রচুর আইসক্রীম বিক্রি হচ্ছিলো। সাউথ গ্রেট ওয়াল ঘুরে গলা শুকিয়ে ফেলা অগুনতি মানুষ দোকানটি থেকে অনেকটা লাইন ধরে আইসক্রীম কিনছিলেন। আমরাও জনপ্রতি দুইটি করে আইসক্রীম নিলাম। চকবার টাইপের আইসক্রীম মুখে পুরে মনে হলো, দুনিয়াতে এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কাঙ্খিত আর কিছুই নেই, কিছু থাকতেও পারে না। আইসক্রীমের ঠান্ডা ঠান্ডা শীতল আবহে আমাদের ভিতরটি জুড়িয়ে যাচ্ছিলো।
বাসে চড়ে হোটেলে ফিরলাম আমরা। তাইজু শেরাটন। আলীশান এই হোটেলের বর্ণনা আগেই দিয়েছি। রুমে ঢুকে এসি একেবারে লো করে দিলাম। বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম। ঝরঝরে শরীরে লাঞ্চে যোগ দিলাম। ফাইভ স্টার হোটেলের লাঞ্চের বর্ণনা না দেয়াই ভালো। লায়ন ফজলে করিম ভাই, সোহেল ভাই এবং ডালিয়া ভাবী মিলে আমরা নির্দিষ্ট আইটেমগুলোই শুধু নিলাম। একটি বিষয় খুব চোখে পড়ছিল যে, লাল আলুর আধিক্য। চীনের সব হোটেলে এতো আলু কেনো থাকে বুঝতে পারলাম না। ছোটখাটো হোটেলে না হয় সস্তা এই খাবার মেনে নেয়া যায়, কিন্তু শেরাটনের মতো ফাইভ স্টার হোটেলের দামি থালায় সস্তা আলুর আধিক্য কী মেনে নেয়া যায়। তবুও প্রায় প্রতিটি খাবারে আমি ছোট হলেও এক টুকরো করে আলু তুলে নিতাম। শৈশবে মায়ের হাতে কয়লায় পোড়া আলু খেতাম। সেদ্ধ আলু কখনোই পছন্দ করতাম না। কিন্তু চীনে বেড়াতে এসে সেই আলুই নিয়মিত আমার পাতে ঠাঁই পেতে লাগলো।
লাঞ্চ শেষ করে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম। শাসা এবং ফ্রাঞ্চি জানালো যে, আমরা লেট চেক–আউট করবো। সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের বাস ছাড়বে। তাইজু থেকে ফ্লাইটে আমরা গুয়াংজু যাবো। রাতেই আমাদের ফ্লাইট। ডিনার ফ্লাইটেই হবে, গুয়াংজুর হোটেলেও আয়োজন থাকবে। তাইজু থেকে গুয়াংজুর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি। দুই ঘন্টারও বেশি ফ্লাই টাইম। আমরা ভালোয় ভালোয় পৌঁছে গুয়াংজুর হোটেলেই ঘুম দিতে পারবো। বিকেল বা রাতে ফ্লাইট হলে স্বস্তির কমতি থাকে না। ভোরে ঘুম থেকে জেগে ফ্লাইট ধরার তাড়ার চেয়ে বিকেল থেকে মাঝরাত অব্দি ফ্লাইট ধরা অনেক শান্তির। আমাদের ফ্লাইট রাত দশটা নাগাদ। হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট যেতে ঘন্টা খানেক লাগবে। ৬টার সময় যাত্রা করলে রয়ে সয়ে আমরা ফ্লাইটে চড়তে পারবো। ডোমেস্টিক ফ্লাইট হওয়ায় আমাদেরকে তিন ঘন্টা আগে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার মুখে পড়ার প্রয়োজন হবে না। রয়ে সয়ে সিকিউরিটি চেকসহ আনুসঙ্গিক প্রক্রিয়াগুলো সারলে হবে।
দিনে ঘামে গরমে একাকার হলেও সন্ধ্যায় হোটেল ছাড়তে গিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কবলে পড়লাম। আমরা যখন বাসে চড়ে রাস্তায় নামলাম তখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টির মধ্যে ফ্লাইটে চড়তে কেমন ভয় লাগছিল। বৃষ্টিতে দৃষ্টিসীমা কমে গেলেও ফ্লাইট চলাচলে কখনো সমস্যা হয়েছে বলে শুনিনি।
পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দেশ চীনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের দূরত্ব অনেক। পাঁচটি স্থানীয় সময়ের অঞ্চল রয়েছে দেশটিতে। যদিও সরকারিভাবে শুধু বেইজিংয়ের সময়কে পুরো দেশের স্থানীয় সময় হিসেবে ধরা হয়। চীনের পূর্ব দিকের ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে পশ্চিম দিকের শিনজিয়াং পর্যন্ত সরলরৈখিক দূরত্ব প্রায় ৫ হাজার ২শ’ কিলোমিটার। অপরদিকে উত্তরে রাশিয়ার সীমান্তের কাছের মোয়হে থেকে দক্ষিণের চীন সাগর পর্যন্ত সরলরৈখিক দূরত্ব প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার। রাস্তা বা রেলপথে এই দূরত্ব আরো বেশি। বিশাল ভৌগোলিক পরিসরের কারণে চীনের আবহাওয়া ও ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। কোথাও মেঘতো কোথাও নীল আকাশ, কোথাও বৃষ্টি তো কোথাও ভর চাঁদনি। তাই আমি নিজেকে আশ্বস্ত করলাম যে, তাইজুতে বৃষ্টি হলেও নিশ্চয় গুয়াংজুতে ফকফকা জ্যোৎন্সা আলো বিলুবে। আরো স্বস্তির ব্যাপার হলো, চীনের অপেক্ষাকৃত ছোট একটি রুটে আমরা যাচ্ছি। মাত্র দুই আড়াই ঘন্টার ফ্লাই টাইম। চীনের অভ্যন্তরীন রুটের অনেক ফ্লাইটই এর থেকে ঢের ঢের বেশি দূরত্বের। তাই অভ্যন্তরীন রুট হলেও চীনের পাইলটেরা বহু আন্তর্জাতিক রুটের পাইলট থেকে অভিজ্ঞ। তারা সাত ঘন্টারও বেশি সময়ের ফ্লাইট অপারেট করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। চীনের সবচেয়ে দীর্ঘতম অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটটি হাইনান প্রদেশের সানইয়া থেকে শিনজিয়াং প্রদেশের উরুমকি রুটে চলাচল করে। প্রায় ৫ হাজার ২শ’ কিলোমিটারের এই আকাশপথ পাড়ি দিতে বোয়িংয়ের লাগে ৭ ঘন্টার বেশি সময়। এতোসব আয়োজন চীনের রয়েছে, অতএব এই সামান্য বৃষ্টিতে ভড়কে যাওয়ার কোন মানেই হয় না।
স্বাভাবিকের চেয়ে কম গতিতে চলছিল আমাদের বাস। তাড়াহুড়া না থাকায় আমরাও অস্থির হচ্ছিলাম না। ফুরফুরে মেজাজে গল্পে গল্পে সময় পার করছিলাম। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো একটি খবর দিল শাসা। সে লায়ন ফজলে করিম ভাইকে চীনা ভাষায় জানালো যে, চীন সাগরে বড়সড় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। গুয়াংজুতে তান্ডব চালাচ্ছে। তাইজুতেও প্রভাব পড়েছে।
ফজলে করিম ভাই খবরটি আমাকে জানালেন। নিজের অজান্তেই কলজের মধ্যে একটি মোছড় দিয়ে গেলো। ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে বিমান নামবে কি করে! রানওয়েতে চাকা থাকবে তো! অবশ্য নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম যে, ঘূর্ণিঝড় হলেও পাইলট আকাশ পথের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ফ্লাইট উড়াবেন না। রাডারের সাহায্যে আগেভাগে সবকিছু জানার প্রযুক্তি বিশ্বে রয়েছে। চীনারাতো প্রযুক্তির মাষ্টার। তারা নিশ্চয় এতোগুলো যাত্রী নিয়ে একটি অনিশ্চিত যাত্রায় গা ভাসাবে না।
আমরা ভালোয় ভালোয় বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। চীনাদের সবকিছুই বড় বড়। তাইজুও বিমানবন্দরও। এটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে আমরা পৌঁছালাম ডোমেস্টিক টার্মিনালে। বাস থেকে নেমে ট্রলিতে লাগেজ বোঝাই করে চেকইন কাউন্টারের দিকে গেলাম। বিশাল লাইন। কিছুই করার নেই, তাড়াও নেই।
আমাদের ফ্লাইট ঠিকঠাক সময়ে উড়াল দেয়ার ঘোষণা প্রদর্শিত হচ্ছে। কিন্তু গুয়াংজুতে তান্ডব চললে ফ্লাইট কিভাবে ঠিকঠাক সময়ে যাবে বুঝতে পারছিলাম না। নাকি আমরা যেতে যেতে তান্ডব থেমে যাবে!
লাগেজ দিয়ে শুধু কেবিন ব্যাগটি নিয়ে ঝাড়া হাত–পা হয়ে গেলাম। সিকিউরিটি চেক করে ভিতরের দিকে যাবো এমন সময়ে আমাদের ফ্লাইট বিলম্বের এ্যানাউসমেন্ট দেয়া হলো। আমি সামনে না এগিয়ে ফ্লাইট সিডিউলের ডিসপ্লে বোর্ডের কাছে গেলাম। এক ঘন্টা বিলম্বে দেখাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এই ‘একঘন্টা’ কি এক ঘন্টা থাকবে, নাকি এভাবে বাড়তে থাকবে! বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো। পুরো আবহাওয়া কেমন যেনো ভিজে উঠছিল।
লায়ন ফজলে করিম ভাই বললেন, দেখতে দেখতে এক ঘন্টা পার হয়ে যাবে। চলেন, কোথাও গিয়ে বসি। আমি বললাম, বৃষ্টিভেজা পরিবেশ, চলেন ধূমায়িত এক কাপ কফি চালিয়ে দিই। ক্যাফে কোনদিকে আছে দেখার চেষ্টা করলাম। ফজলে করিম ভাই বললেন, ওদিকে আছে, চলেন। তিনি বললেন, কফি নয়, চলেন ‘নায় চা’ খাই। এই চায়ের মধ্যে বেচারা কী যে পেয়েছেন কে জানে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।