(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমাদের বাস চলছিল। বিশাল মহাসড়ক ধরে ছুটছে আমাদের লেটেস্ট ডিজাইনের বাস। বাসটি ডাবল ডেকার নয়, তবুও বেশ উঁচু। নিচে লাগেজ স্পেস করার ফলে বাসের সিটগুলো কিছুটা উঁচুতে। আমাদের মনে হচ্ছিলো আপার ডেকে বসেছি। এতে করে বেশ ভালোভাবেই সবকিছু দেখে দেখে যাচ্ছিলাম। প্রচুর শুকনো খাবার গাড়িতে। ইচ্ছে হলেই হাত বাড়িয়ে নেয়া যাচ্ছিলো খাবার। আমাদের প্রটোকলে থাকা ফ্রাঞ্চি এবং শাসার আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে আমরা মাতোয়ারা। দুই চীনা তরুণী আমাদেরকে কিছু একটা খাওয়াতে পারলেই যেনো বর্তে যায়। বাদাম কিংবা বিস্কুটের প্যাকেটের দিকে আমরা হাত বাড়ানোর আগেই তারা সিট থেকে ছিটকে এসে হাতে তুলে দেয়। বাড়িয়ে দেয় পানি কিংবা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল।
বাসে কোন গান বাজানো হচ্ছে না। এখানে বাসে গান বাজানো যায় কিনা তাও আমি জানি না। তবে মনে হলো, এতোদেশের এতো রকমারি মানুষ দেখে ঠিক কোন দেশের গান বাজাবে তা বুঝতে না পেরেই হয়তো ড্রাইভার চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছেন। আমরা হ্যাংঝো থেকে তাইজু যাচ্ছি। দূরত্ব প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার। এতো দীর্ঘ পথে গাড়িতে গান না বাজলে কেমোন যেনো ঝিমুনি আসে। তাই আমি মোবাইলে গান শুনতে শুরু করলাম। বাইরের নানা দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত চোখ, অন্তর কাঁদছিল দেশের জন্য। কেমোন একটি হাহাকার টের পাচ্ছিলাম আমার চট্টগ্রামের জন্য, আমার দেশের জন্য। পরিবার পরিজনের জন্যও অন্তর হু হু করছিল। ইউটিউবে একটির পর একটি দেশের গান শুনতে শুনতে আমার ভিতরের হাহাকার যেনো আরো বাড়ছিলো। তাড়া করছিলো আবেগ। ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গায়’ কিংবা ও আমার দেশের মাটি বা একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’ ইত্যাদি ইউটিউবে শুনছিলাম।
পথে বেশ সুন্দর একটি স্থানে আমাদের বাস থামলো। রেস্টুরেন্ট। বিশাল একটি এলাকা নিয়ে রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ, পেট্রোল পাম্প, ওয়াশরুম সবই একইসাথে। আবার রেস্টুরেন্টও একটি নয়, বেশ কয়েকটি। ফুড কোর্টের মতো। আলাদা ক্যাফেও রয়েছে। লায়ন ফজলে করিম ভাই কি খাবো জানতে চাইলেন। বললাম, ফ্রেশ হবো এবং একটি কফি নেবো। আমরা ওয়াশরুমের দিকে হাঁটলাম। ফ্রেশ হয়ে সামনে একটি ক্যাফে পেলাম। লাকিন ক্যাফে। ‘লাকিন’ চীনাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি ব্র্যান্ড। স্টারবাকর্সেও তারা পেছনে ফেলে দিয়েছে। এটি চীনাদের নিজস্ব ব্র্যান্ড। পুরো চীনে প্রায় ২০ হাজার ক্যাফে রয়েছে এই কোম্পানির। কফিপ্রেমি মানুষ হিসেবে আগে থেকেই ‘লাকিন’ সম্পর্কে টুকটাম জানতাম বিধায় ‘লাকিন ক্যাফে’ দেখে আর দ্বিতীয়টির দিকে চোখ দিলাম না, ঢুকে পড়লাম। স্টারবাকর্সের মতোই কাগজের ওয়ান টাইম মগে কফি নিলাম। দামও বেশ চড়া। কফিতে চুমুক দিতেই তিতা একটি স্বাদ শরীর মনে দারুণ দোলা দিয়ে গেলো। সাথে দারুণ গন্ধ। লায়ন ফজলে করিম কফি না নিয়ে ‘নায়–চা’ খোঁজ করলেন। লাকিন ক্যাফেতে বিশেষ ধরনের এই চা না পেয়ে তিনি অন্যদিকে হাঁটলেন। ভাবীও ওনার পিছু নিলেন। তবে যাওয়ার আগে অনেকটা জোর করেই আমার কফির দাম মিটিয়ে গেলেন।
‘নায়–চা’ ( আমি বলি নাই–চা) বিশেষ ধরনের একটি চা। আমাদের দুধ চা’র মতোই সব উপকরণই দেয়া আছে। শুধু চায়ের সাথে ছোট ছোট মার্বেলের মতো কিছু ফুড বাল্ব ছেড়ে দেয়া হয়। সাকু দানার বড় ভার্সন। চায়ে চুমুকের সাথে সাথে দু’চারটি করে প্লাস্টিক দানার মতো গোল্লা মুখে যায়। ওগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হয়। করিম ভাই আমাকে দুয়েকবার খাইয়েছেন। কিন্তু এক নির্ভেজাল প্রেমিকের বুকে অন্য নারীর বসতি তো আর সহজে হয়না। তাই কফির পরিবর্তে ‘নায়–চা’কে ঠিকঠাকভাবে অন্তরে নেয়া সম্ভব হয়নি।
আমি মগভর্তি লাকিন কফি নিয়েই বাসে চড়লাম। রয়ে সয়ে কফিতে চুমুক দেয়ার মজাই আলাদা। তেতো স্বাদের লাকিন আমার ভালোলাগার জায়গাটা বেশ দখল করতে যাচ্ছে বলেও মনে হলো। আমি খুব আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম যে, লায়ন ফজলে করিম এবং ডালিয়া ভাবীও মগ হাতে নিয়ে বাসে উঠলেন। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে জানালেন যে, ‘নায়–চা’ পেয়ে গেছেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমাদের মতো মোড়ে মোড়ে কিংবা অলিতে গলিতে চায়ের দোকান চীনের কোথাও দেখিনি। তারা প্রচুর চা খায়, তবে গ্রিন টি। দিনভর তারা এই চা নিয়ে মাতোয়ারা থাকে। ঘর থেকে বেরুনোর সময়ই ফ্লাঙ ভর্তি গরম পানি এবং গ্রিন টি’র পাতা নিয়ে আসে। তা দিয়েই দিন কাবার করে দেয়।
আমাদের বাস আবারো যাত্রা করেছে। তাইজুর দিকে ছুটছি আমরা। তাইজুতে জ্যাক কোম্পানির হেডকোয়ার্টার। বিশ্বের গার্মেন্টস এঙেসরিজ প্রস্তুতে শীর্ষস্থানীয় এই কোম্পানি তাদের হেডকোয়ার্টার দেখানোর জন্য আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রধান কারখানায় রোবটসহ গার্মেন্টস খাতের নানা ইলেক্ট্রনিঙ ডিভাইজের উৎপাদন এবং কার্যকারিতা আমাদের দেখানো হবে বলে ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি। গার্মেন্টস সেক্টরের রোবট তো ইতোমধ্যে দেখা হয়ে গেছে, এখন সেই রোবট কিভাবে বানায় সেটা দেখতে পাবো ভেবে কিছুটা এঙসাইটেড আমি। বাসের সাথে সাথে আমার মনও যেনো ছুটছিল!
আমাদেরকে জ্যাক সদর দপ্তর ঘুরিয়ে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানালো ফ্রাঞ্চি। এতে আমাদের কোন অসুবিধা হবে কিনা তাও জানতে চাইলো। আমরা প্রায় সবাই ‘নো’ বলে উঠলাম। ফ্রাঞ্চি জানালো যে, হেডকোয়ার্টার এবং কারখানা ঘুরিয়ে লাঞ্চের পরে আমাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা সবাই আবারো সায় দিলাম। গাড়ি চলছে। তবে গতি আর আগের মতো নেই। রাস্তাও মহাসড়কের মতো চওড়া নয়। দুই পাশে প্রচুর কারখানা চোখে পড়ছিল। বুঝতে পারলাম যে আমরা জ্যাক টেকনোলজির হেডকোয়ার্টারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
অল্পক্ষণের মধ্যে বিশাল একটি গেটে প্রবেশ করলাম আমরা। জ্যাক টেকনোলজির হেডকোয়ার্টার। অনেকগুলো ভবন, বহুতল। শাসা এবং ফ্রাঞ্চির ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। আমরা বাস থেকে নামলাম। আমাদের আগেও কয়েকটি বাস এসেছে। সবগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি বাসের অদূরে মানুষের জটলা। জটলা মানেই নিজেদের মধ্যেই খোশগল্প করছে। বুঝতে পারছিলাম যে, তারাও নিশ্চয় আমাদের মতো। পৃথিবীর কোন না কোন দেশ থেকে এসেছে। জ্যাক হেডকোয়ার্টার দেখানো হবে আমাদের সকলকেই।
সব মিলে শ’ দেড়েক মানুষ। আমাদের সবাইকে এয়ারফোন দেয়া হলো। যেটি আগেও ব্যবহার করেছিলাম। একজন সবকিছুর বর্ণনা করবেন, তার স্পিকার থেকে ভেসে আসা কথা আমরা সবাই একসাথে শুনবো। এতে কাউকে চিৎকার করতে হয় না, আবার কাউকে কথা শুনার জন্য বক্তার পেছনে পেছনে দৌড়ানো লাগে না। কিছুটা পেছনে পড়ে গেলেও ওয়ারলেস এয়ারফোনে সামনের বক্তার সব কথাই স্পষ্ট শুনা যায়। এয়ারফোনে দুইটি চ্যানেল রয়েছে। আমাদের সবাইকে এক নম্বর সেট করতে বলা হলো।
জ্যাক টেকনোলজির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা স্পিকারে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের সকলকে স্বাগত জানালেন। স্যুটেড বুটেড ওই নারী কর্মকর্তা এয়ারফোনে তাকে শুনা যাচ্ছে কিনা তাও কনফার্ম করলেন। ভদ্রমহিলা বেশ স্মার্ট, ইংরেজীও বেশ বোধগম্য। বয়স কত হবে বুঝতে পারছিলাম না। চেহারা বা শরীরের গঠন দেখে চীনা তরুণীদের বয়স বিবেচনা করা বেকুবি। তাই সেই চেষ্টা না করে তার কথা শুনতে লাগলাম।
তিনি আমাদের সকলকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারের মূল ভবনের লবির দিকে হাঁটতে লাগলেন। তিনি আগে, আমরা পঙ্গপালের মতো পেছনে। আগেই বলেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গার্মেন্টস মালিক এবং সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক একটি টিমের সদস্য হিসেবে জ্যাক টেকনোলজির হেডকোয়ার্টার এবং কারখানা পরিদর্শন করতে এসেছি আমরা। বাংলাদেশের চারজন গার্মেন্টস মালিক থাকলেও একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে কিছুটা সংখ্যালঘু মনোভাব কাজ করছিল ভিতরে। কিন্তু জ্যাক সদরদপ্তরের বিশাল লবিতে পৌঁছে গর্বে বুকটা ফুলে ওঠলো। চোখজোড়া কেমন যেন আদ্র হয়ে গেল।
সফরকারী বিশাল টিমটাকে জ্যাক সদরদপ্তরে স্বাগত জানাতে অভিনব এক পন্থা অবলম্বন করেছে কোম্পানিটি। জ্যাকের নারী কর্মকর্তাদের বিশাল একটি দল দু’পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে টিমে থাকা সদস্যদের নানা দেশের পতাকা নাচিয়ে স্বাগত জানানো হচ্ছিল। আমার চোখজোড়া পাগলের মতো বহু রক্তে কেনা আমার জাতীয় পতাকার খোঁজ করছিল। পেয়ে গেলাম। আমার পুরো শরীরে শিহরণ খেলে গেলো। দেখলাম, পুতুলের মতো সুন্দর একটি চায়নিজ মেয়ে আমার সোনার বাংলার পতাকা নাড়াচ্ছে। আমার চোখজোড়া কেমন যেন ভিজে গেল। মেয়েটিকে কাছে ডেকে নিলাম। তার একহাতে চীনের পতাকা অন্যহাতে আমার। তাকে বললাম, এটা আমার পতাকা। তোমাকে ধন্যবাদ আমার পতাকাটি সুন্দরভাবে ধরবার জন্য। পতাকার মাঝের লালবৃত্ত দেখিয়ে তাকে বললাম, এটা আমাদের রক্তের প্রতীক। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা বুকের তাজা রক্তে সাগর বানিয়ে আমাদের এই পতাকা এনে দিয়েছিলেন।
সে বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
পরে গ্রুপ ছবি তোলার সময় কলম্বিয়ান তরুণী গারিডো নিজের দেশের পতাকার তিনটি রঙ দেখিয়ে বললো, এটি স্বর্ণ, এটি মহাসাগর– আটলান্টিক এন্ড প্যাসিফিক এন্ড লাস্ট ওয়ান ইজ ব্লাড।
আমার মনে হলো, রক্ত ছাড়া বুঝি কোন দেশের পতাকা হয়না, রক্ত ছাড়া বুঝি স্বাধীনতা আসে না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।