(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ছুটছে আমাদের গাড়ি। যাচ্ছি হ্যাঙঝো। অবশ্য জায়গাটির নাম হ্যাঙঝো নাকি হাংঝো তা বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের প্রটোকলে থাকা দুই তরুণী মুখের ভিতরে রেখে এমন করে এক একটি শব্দ উচ্চারণ করে যে, বুঝতে মাথা ঘুরে যায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে আমরা সুঝৌ থেকে ১৬১ কিলোমিটার দূরের অপর একটি চীনা শহরে যাচ্ছি। যেখানে যেতে আমাদের দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। এতে করে আগামী দুই ঘন্টা বিলাসবহুল বাসে বসে বাদাম চিবুতে চিবুতে আশেপাশের বর্ণিল জনপদে চোখ বুলানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। ফুরফুরে মেজাজে আমি সেই কাজটিই করছিলাাম।
আহা, কী বর্ণিল জগৎ! কী সুন্দর রাস্তাঘাট এবং ছোট বড় ভবন। সুউচ্চ ভবনগুলো চোখের পলকে পেছনে চলে যাচ্ছিল, তবে মনের ভিতরে যেনো জীবনের জন্য ঠাঁই করে নিচ্ছিল। আমার অন্তরের অনেক গভীরে কেমন কেমন যেনো করছিল। তবে তা প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আমার সোনার বাংলায় এতো কিছু থাকার পরও কেনো যে আমরা এভাবে এগুতে পারি নি কে জানে! ছয় লোনের রাস্তা ধরে ছুটছি আমরা। কিন্তু রাস্তায় একটি ছোট্ট গর্তও নেই। বিশ্বাস করেন, চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে শত শত মাইল বাসে– কারে চড়েছি, কিন্তু কোথাও একটি গর্তও দেখিনি। রাস্তা যে কিভাবে এতো মসৃন রাখা যায় তা চীনারা দেখিয়ে দিয়েছে। এমন নয়, আমরা তাদের ভিআইপি এলাকায় ঘুরেছি, কিন্তু আবাসিক, শিল্পাঞ্চল, উন্নত, অনুন্নত নানা এলাকায়ও চষে বেড়িয়েছি। আমার মনে হয়েছে তারা অন্যরকমের যত্নে এক একটি রাস্তা নির্মাণ করেছে এবং রাস্তাগুলোকে যত্নে রেখেছে।
নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছে গেলাম আমরা। হ্যাংঝো শহরের সুউচ্চ সব ভবনই জানান দিচ্ছিলো যে, আমরা চলে এসেছি। তবে আমাদের গাড়ি থামছিল না। বলা হলো যে, হ্যাংঝোতে আমরা হয়তো বেড়াবো, তবে এখানে প্রধান কাজ হচ্ছে গার্মেন্টস দর্শন। গার্মেন্টস কারখানাগুলো কি করে উৎপাদন চালাচ্ছে তা সরজমিনে আমাদের দেখানো হবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জ্যাকের মেশিনারিজ ব্যবহার করে গার্মেন্টস কারখানাগুলো কিভাবে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সাবলিল করেছে সেটি আমাদের দেখানো হবে। জ্যাকের অতিথি হিসেবে আমরা এসেছি। তারা যে শুধু শুধু আমাদেরকে রাজকীয় আতিথিয়তা দিচ্ছে না সেটি শুরু থেকে মাথায় ছিল।
আমাদেরকে একটি গার্মেন্টস কম্পউন্ডের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। বেশি উঁচু ভবন নয়, ছয় সাত তলা উচ্চতার বেশ কয়েকটি ভবন নিয়ে বেশ সুন্দর একটি গার্মেন্টস কারখানা। একটি ভবন থেকে অপর ভবনটি বেশ কিছুটা দূরে দূরে। আর খালি জায়গায় পার্কিংসহ নানা আয়োজন। তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছিল ফুলের বাগান, গাছগাছালী। একটি গার্মেন্টস কারখানাকেও এতো নান্দনিকভাবে রাখা যায় সেটি প্রথম দেখাতেই আমাকে বিস্মিত করলো।
বাস থেকে নামার পর আমাদের সবাইকে গলায় ঝুলানোর জন্য একটি করে ‘ভিজিটর পাস’ দেয়া হলো। সবার কানের জন্য দেয়া হলো একটি মেশিনসহ এয়ারফোন। স্পিকারে যিনি কথা বলছিলেন তার কথাগুলো ওই এয়ারফোনে আমরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। বিষয়টি দারুণ তো, কোন চিৎকার চেঁচামেচি করতে হচ্ছিলো না। হুড়োহুড়ি করে কাছে যাওয়ারও দরকার পড়ছিল না। আমরা হাঁটছিলাম, আর গার্মেন্টসের একজন মহিলা কর্মকর্তা সবকিছুর বয়ান দিচ্ছিলেন। আমরা অনায়াসে তা শুনতে পারছিলাম। ভদ্রমহিলা ইংরেজীতে কথা বলছিলেন। তাই আমাদের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিলো না। এখানে বলে রাখা ভালো যে, জ্যাকের অতিথি হিসেবে আমাদের সাথে বিশ্বের নানা দেশের আরো অন্তত পঞ্চাশ জনের মতো ভিজিটর যুক্ত হয়েছেন।
গার্মেন্টসটির বিভিন্ন বিভাগ আমাদের দেখানো হলো। কাপড় থেকে একেবারে ফিনিশিং পর্যন্ত। তৈরি পোশাক প্যাকেট করে রপ্তানির জন্য গাড়িতে তোলা পর্যন্ত নানা কার্যক্রম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হলো। যতটুকু দেখলাম তাতে আমার মনে হলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। চীনারা সেটাকে বলছে অটোমেশান। জ্যাক কোম্পানির তৈরি রোবট যে কী অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় পুরো সেক্টরটির নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে তা দেখে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়েও কিছুটা শংকিত হচ্ছিলাম। বিশ্বের বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের সুনাম রয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশকে ছাড়িয়ে আমরা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছি। বলাবাহুল্য চীন এক্ষেত্রে প্রথম স্থানে। আমাদের অগ্রগতির মুল চালিকা শক্তি হচ্ছে তুলনামুলক সস্তা শ্রম। আমাদের থেকে বহু বড় ব্যবধানে প্রথম স্থানে থাকা বিশ্বের শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ চীনে শ্রমিক সংকট প্রকট, শ্রমিকের দামও বেশ চড়া। চীনের এই সংকটের কারনে বহু চীনা শিল্পপতি বাংলাদেশ, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে, বিশ্বের তৈরি পোষাক রপ্তানিতে বহু বছর ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশে চীন প্রায় ১৬০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বছর কয়েক আগে এর পরিমান ২শ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। শ্রমিক সংকট এবং শ্রমের চড়া দামের কারণে চীনে বহু গার্মেন্টস কারখানার মালিক ব্যবসা গুটাতে বাধ্য হন, কেউ কেউ পুঁজি নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীন রোবটের মাধ্যমে শ্রমিক সংকটের ব্যাপারটি দ্রুত কাটাতে শুরু করেছে। শ্রমিকের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহার এবং এক একটি মেশিন দিয়ে ৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত শ্রমিকের কাজ সূচারু রূপে সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হওয়ায় চীনা বিনিয়োগ স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আশংকা করা অমুলক নয়।
চীনে বর্তমানে ১৪ হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ১ কোটি ১০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। অপরদিকে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বাংলাদেশের তৈরি পোষাক খাত চীনের থেকে বহু পেছনে। বাংলাদেশ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও কম তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। ৪ হাজারের মতো গার্মেন্টস রয়েছে এদেশে। কাজ করেন ৪০ লাখের মতো শ্রমিক।
রপ্তানি এবং কারখানার সংখ্যার দিকে বাংলাদেশ চীনের এক চতুর্থাংশ। কিন্তু শ্রমিক প্রায় অর্ধেক। চীনের কারখানাযগুলোতে ব্যাপক হারে অটোমেশান হওয়ায় কম শ্রমিক দিয়ে তারা বেশি পণ্য উৎপাদন করে প্রতিযোগিতামুলক বাজারে দ্রুত এগুচ্ছে। চীনের কারখানাগুলোতে শুরু হয়েছে রোবটিক উৎপাদন। শত শত শ্রমিকের কাজ করছে রোবট, মেশিন। পুরো কারখানা অটোমেশান করায় এদের কাজের গতি যেমন বেড়েছে তেমনি কমে গেছে উৎপাদন খরচ।
বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড জারার শীতের পোশাক তৈরি হচ্ছিল চীনের হাংজো শহরের পার্শ্বস্থ জিয়াজিং বেস্টিং ইন্টেলিজেন্ট ম্যানুফাকচারার্স নামের কারখানায়। কারখানাটি ঘুরে অটোমেশানের বিস্ময়কর কার্যক্রম দেখার সুযোগ পেলাম। কারখানাটি পুরোপুরি জ্যাক কোম্পানির মেশিনারিজ এবং রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কারখানায় দেখা গেলো, অটোমেটিক মেশিনে কম্পিউটার নির্দেশনায় ব্লেজারের শত শত পিস কাপড় মাত্র কয়েক মিনিটে কেটে ফেলা হচ্ছে। কাটা কাপড়ের পিসগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে হ্যাঙ্গারে। হ্যাঙ্গারটি নিজে নিজে সামনের দিকে যাচ্ছে। থেমে যাচ্ছে অপারেটরের সামনে। একজন অপারেটর তার জন্য নির্দিষ্ট অংশটি সেলাই করে দেয়ার সাথে সাথে হ্যাঙ্গারটি পরের অপারেটরের কাছে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে আবার পরের অপারেটরে। এভাবে কয়েকটি টেবিল হয়ে শেষ লাইনে এসে পুরো ব্লেজার হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। ফিনিসিং পয়েন্টে সব ঠিক আছে কিনা দেখার পর হ্যাঙ্গারের যাত্রা আয়রন এবং প্যাকেজিং এর দিকে। কারখানাটিতে জ্যাক কোম্পানির অতি বিস্ময়কর এক রোবটের দেখা মিললো। মাঝারী সাইজের স্যুটকেসের মতো দেখতে একটি মেশিন তার অন্তত ছয়গুন বড় কয়েক তাকের পণ্য বোঝাই র্যাক টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওয়্যার হাউজ বা গুদামে। আবার গুদাম থেকে বাইরেও একইভাবে র্যাক নিয়ে আসছে। এজিভি (অটোমেটেড গাইডেড ভ্যাহিক্যাল) নামের রোবট নিজে নিজে লিফট অপারেট করে পণ্য বোঝাই র্যাক নিয়ে দোতলা, তিন তলায়ও চলে যাচ্ছে। রোবটটি যে পরিমাণ পণ্য বোঝাই র্যাক নিয়ে কারখানার হেথায় হোথায় নিজে নিজে যাতায়ত করছিল সেই র্যাক বহন করতে কমপক্ষে ৬ জন শ্রমিকের দরকার হতো।
ঘোরলাগা চোখে নানা কিছু দেখছিলাম। একটি কারখানার যত লোকের দরকার রোবটিক ব্যবহার তা এক চতুর্থাংশে নামিয়ে এনেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের চারভাগের তিনভাগ মানুষের কাজই রোবট করছে!!
আমাদেরকে তাড়া দেয়া হলো। বলা হলো, অপর একটি কারখানা দেখতে যেতে হবে। একই এলাকার ইউপুফাং নামের অপর একটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেল এজিভি’র জয়জয়কার। বছরে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার (চারশ’ কোটি চীনা ইউয়ান) রপ্তানিকারক বেশ বড়সড় কারখানাটির ওয়্যারহাউজ পরিচালনা করছেন মাত্র দুজন তরুণী। ওয়্যারহাউজের ৯ তাক উচ্চতা পর্যন্ত পণ্য উঠানো নামানোর কাজ করছে এজিভি। ডেলিভারি পয়েন্টে ৯টি বিশাল বিশাল কাপড়ের রোল নিয়ে হাজির হলো এভিসি। যা ২০ জন মানুষের পক্ষেও বহন করা অসম্ভব।
অত্যন্ত স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এজিভি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে যা মানুষ দিয়ে করাতে অনেক বেশি সময় লাগতো। চীনের বাজারে মেশিনটির দাম ১৫ হাজার ডলার।
রোবট নিয়ে আলাপকালে একজন কর্মকর্তা জানালেন, এই রোবট আমাদের বহু কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে। আমাদের কারখানায় বর্তমানে ৫শ’র মতো শ্রমিক কাজ করেন। অটোমেশান না করে সব ম্যানুয়েলি করতে হলে অন্ততঃ দুই হাজার শ্রমিক লাগতো! দুই হাজার মানুষের মধ্যে ১৫শ’ জনের কাজ রোবট খেয়ে ফেলেছে। তাহলে ভবিষ্যতে সে যদি সব মানুষেরই কাজ খেয়ে ফেলে আশ্চর্য হওয়ার কি খুব বেশি কিছু থাকবে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।